ভাবনায়_তুমি পর্ব০৪ এবং শেষ পর্ব

যে স্বামী দিনের পর দিন তিয়াসাকে অত্যাচার নির্যাতন করে গেছে সেই স্বামীর অসুস্থতায় তিয়াসার কষ্ট হচ্ছে। বিয়ের পর প্রতিরাতেই স্বামী সাগরের হাতে মার খেয়েছে তিয়াসা। আজ ব্যতিক্রম কারণ সাগর মারাত্মকভাবে অসুস্থ। আর অভাগিনী তিয়াসা, সারারাত সাগরের মাথায় জলপট্টি দিয়েই যায়।
তিয়াসা খুব করে চাইছে সাগর ঠিক হয়ে যাক, সুস্থ হয়ে যাক। সে অনেক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হাজার হোক তার স্বামী। সমাজস্বীকৃত ভাবেই বিয়ে হয়েছে তাদের। সাগর যদি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে কি সে আবারও তিয়াসার সাথে আগের মত ব্যবহার করবে? নাকি তিয়াসার সারারাতের কষ্ট সাগরকে সঠিক উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে? সাগর যদি জানে যে স্ত্রীকে সে স্ত্রীর মর্যাদা না দিয়ে দাসীর মর্যাদা দিয়েছে সেই স্ত্রী-ই সারারাত ধরে তার সেবা করছে! প্রতিরাত তো নির্ঘুম কাটায় তার জন্য। আজ তার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল কিন্তু সে ঘুমায়নি। আরামে একটি রাত কাটানোর সুযোগ পেয়েও সে কাটায়নি। যে স্বামীর নিগ্রহের শিকার সে, সেই স্বামীর জন্য সারারাত জেগে আছে। সাগর কি বুঝতে পারবে? বুঝলে কি সাগর আবার আগের মত হয়ে যাবে? তিয়াসা তার কাঙ্ক্ষিত সংসার পাবে? যে সংসারের স্বপ্ন সে খুব ছোটবেলা থেকে দেখতো, স্বামী সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার হবে, অর্থবিত্তের অভাব ভালোবাসা দিয়ে কাটিয়ে দিবে, আর কিছু না থাকুক একে অপরের জন্য ভালোবাসা থাকবে ; তিয়াসা কি অবশেষে এরকম সংসার পাবে? তিয়াসা ভাবতে থাকে। ভেবে কূল পায় না। ভাবনার ছেদ ঘটে ফজরের আযান শুনে। তিয়াসা বুঝতে পারে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেছে। সাগরের জ্বরও এখন কমে গেছে। তিয়াসা উঠে ফজরের নামাজ পড়ে। বরাবরের মতোই আরো একটি নির্ঘুম রাত কাটায়।
সকালে সাগর ঘুম থেকে উঠে। কাল রাতে বেশ কবারই ঘুম ভেঙেছে তার। প্রতিবার দেখতে পেয়েছে তিয়াসা তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। অনুশোচনায় নিজের কাছেই ছোট হয়ে গেছে সে। প্রতিদিন ভাবে তিয়াসা শ্বাশুড়িকে খুশি করার জন্য সাগরের হাতে মার খেয়েও কিছু বলে না৷ প্রতিদিন পণ করে আর তিয়াসার গায়ে হাত তুলবে না। অথচ রাতের বেলা কি হয়ে যায় নিজেও বুঝতে পারে না। নেশাগ্রস্ত হয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একই ঘটনা ঘটে প্রতিবার। কেন? সাগর ভাবতে থাকে। কেন নিজেকে আটকাতে পারি না আমি। কেন এক স্ত্রীর স্মৃতি নিয়েই পড়ে আছি। তিয়াসাকে স্ত্রীর মর্যাদা না দেই, তার সাথে খারাপ ব্যবহার না করলেও পারি। প্রতিরাতে অকথ্য নির্যাতন করি তিয়াসাকে। অথচ সে কিছুই বলে না। নীরবে সয়ে যায় সবকিছু। মা হয়তো সব জানে না। কিন্তু কিছুটা হলেও তো আন্দাজ করতে পারে। কেন এমন করি আমি, কেন? স্বামী হিসেবে ব্যর্থ আমি। সন্তান হিসেবেও ব্যর্থ। ব্যর্থ ভাই হিসেবেও। আমি আসলেই মানুষ না। সৃষ্টিকর্তা কোনো জন্তু সৃষ্টি করতে গিয়ে হয়তো মানুষের অবয়ব দিয়ে ফেলেছিলেন। আমি সেই জন্তু। এর চেয়েও নিকৃষ্ট আমি। আমার বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। এ জগৎ আমার জন্য না। আমি সুন্দর পৃথিবীর আবর্জনা স্বরূপ। কেন বেঁচে আছি আমি? সাগর আর ভাবতে পারে না। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে সাগরের। নাস্তার টেবিলে বসে ছিল সাগর। ব্যাপারটি চোখ এড়ায় না তিয়াসার৷ সাগর হঠাৎ কেন কাঁদছে বুঝতে পারে না। এ নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসাও করে না।
খেয়ে উঠেই সাগর বেরিয়ে যায়। সাগরের মা জিজ্ঞাসা করেছিল কোথায় যাচ্ছে। প্রথমবার কিছু বলেনি। কিন্তু জোরাজোরি করার পর বলে অফিসে কাজ আছে। সাগরের মা বলেছিল ” আজ না গেলে হয় না? এত অসুস্থ শরীর নিয়ে কিভাবে যাবি?”
সাগর গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে বেরিয়ে যায়। সকাল থেকেই সে কিছু চিন্তা করতে পারছে না। নিজের জীবনের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। এরকম হলেই সাগর বারে চলে যায়। ড্রিংকস করে ইচ্ছামত। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। অসুস্থ অবস্থায়ই বারে গেল সাগর।
সাগর বেরিয়ে যাওয়ায় চিন্তিত হয়ে যায় তিয়াসা ও সাগরের মা। তিয়াসা জানতে চায়, “মা উনি কোথায় গেলেন?”
সাগরের মা দূর্বল গলায় বলেন, “অফিসের কথা বলে বের হল তো।”
-“এই অবস্থায় না গেলে হত না?”
-“মানা করেছিলাম তো। জরুরী কাজ আছে বলে চলে গেল।”
তিয়াসা আর কিছু বলে না। উৎকণ্ঠায় সময় কাটতে থাকে তাদের।
দুপুরের দিকে তিয়াসার মার ফোনে সাগরের নাম্বার থেকে কল আসে। তিয়াসার মা ফোন ধরেন। ওপাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠ শোনা যায় – “সাগরের কেউ বলছেন?”
-“জ্বি আমি সাগরের মা। কোনো সমস্যা? ”
-“সাগর হাসপাতালে ভর্তি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসুন।”
সাগরের মা অবাক হয়ে যান। জানতে চান, “কে আপনি? কি বলছেন এসব?”
অপরিচিত ব্যক্তি বলে, “এত কথা বলার সময় নেই এখন। সাগরের অবস্থা খুব খারাপ। আপনি দেরি করবেন না প্লিজ।”
সাগরের মা হাসপাতালের ঠিকানা জেনে নিয়ে দ্রুত তিয়াসার সাথে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সেই হাসপাতালে পৌঁছে সাগরের নাম্বারে আবার কল দেয়। দুবার কল দেওয়ার পর ওই লোক ফোন রিসিভ করে একটা রুমে আসতে বলে। সাগরের মা আর তিয়াসা সেখানে চলে যায়।
গিয়ে দেখে একটা বেডে সাগর শোয়া। জ্ঞান আছে নাকি নেই বোঝা যায় না। পাশে একজন ডাক্তারের পোশাক পরিহিত লোক। তাদের দেখেই জিজ্ঞাসা করে, “আপনারাই সাগরের ফ্যামিলির? আমি যার সাথে কথা বলেছিলাম? ”
সাগরের মা বলে, “জ্বি আমি সাগরের মা আর ও সাগরের ওয়াইফ। কি হয়েছে সাগরের?”
-“কি হয়েছে আমিও বলতে পারব না। এতটুকু জানি যে সাগর কিছুক্ষণ আগে রাস্তায় পড়ে ছিল। কয়েকজন পথচারী সাগরকে তুলে এখানে দিয়ে গেছে। এরপর থেকেই ওর চিকিৎসা চলছে। যতটুকু মনে হয় অতিরিক্ত মাদক সেবনের জন্যই এরকম হয়েছে। ”
তিয়াসা এবার কথা বলে, “এরকম কিছু তো হয়নি। উনি অসুস্থ ছিলেন গতকাল। আজ সকালে অফিসে জরুরী কাজ ছিল বলে অফিসে গিয়েছেন। ড্রাগস নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।”
ডাক্তার বলে, “হতে পারে তবে তার শরীরে যা হচ্ছে এগুলো অতিরিক্ত ড্রাগস নেওয়ারই ফল। আগে থেকেই নিতেন হয়তো। আজ বেশি নিয়ে ফেলেছেন। তার শরীর এবজর্ভ করতে পারেনি।”
সাগরের মা বলে, “কেমন সমস্যা হয়েছে ওর? সুস্থ হতে কতদিনের মত লাগবে? ”
-“প্রার্থনা করুন যাতে জীবিত ফিরে পান তাকে। কন্ডিশন খুবই খারাপ। ”
সাগরের মা আর তিয়াসা আৎকে উঠে। আর কিছু বলে না। সাগরের চিকিৎসা চলতে থাকে। বাহিরে উৎকণ্ঠায় সময় কাটতে থাকে সাগরের মা আর তিয়াসার।
সন্ধ্যার দিকে ডাক্তার এসে জানায় সাগরের জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু অবস্থা এখনো ভালো না। সাগরের মা আর তিয়াসা ভিতরে যায়। সাগরের মা সাগরের মাথার পাশে বসে। তিয়াসা পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সাগরের মা জিজ্ঞাসা করে, “তোর কি হয়েছিল? এই অবস্থা কেন?”
সাগর ক্ষীণ গলায় বলে, “মা আমায় মাফ করে দিও। সারাজীবন অনেক অপরাধ করেছি। জানি ক্ষমার অযোগ্য কিন্তু তবুও ক্ষমা চাই।”
-“কিসব যা তা বলছিস? তোর কিছুই হয়নি। ডাক্তার বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে?”
-“হয়েছে মা আমি জানি। পৃথিবী কিছুক্ষণ পরেই একটু পবিত্র হবে। একটা কুলাঙ্গার চলে যাবে।”
-“সাগর তুই থামবি?”
-“সত্যি বলছি মা। পারলে মাফ করে দিও। তিয়াসা কোথায়?”
তিয়াসা সাগরের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাগর ইশারায় কাছে ডাকে। সাগরের মা সরে গিয়ে তিয়াসাকে বসার জায়গা করে দেয়। তিয়াসা পাশে বসলে সাগর মৃদু গলায় বলে, “অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি জানি। কিন্তু সত্যিটা কি জানো, তোমাকে দেখার পর থেকেই মুগ্ধ হচ্ছি। এত কিছু কিভাবে সহ্য কর? প্রতিরাতে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। অথচ তুমি মা কষ্ট পাবে দেখে মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছো সব। জানো তিয়াসা, প্রতিদিন সকালে তোমাকে দেখে অনুশোচনা হত। তীব্র অপরাধবোধে ভুগতাম। কিন্তু রাতের বেলা আবার কি হয়ে যেত বুঝতাম না। কাল রাতে তুমি যখন সারারাত আমার সেবা করেছো তখনই বুঝতে পেরেছি আমি আসলে তোমার যোগ্য না। আমি ভালোবাসতে জানি না। ভালোবাসা নিতে জানি না। তাই তোমার ভালোবাসাকে এতদিন অগ্রাহ্য করে এসেছি। পারলে ক্ষমা করে দিও। ”
সাগর অনেক কষ্ট করে কথাগুলো বলে। থামার পর তিয়াসা বলে, “আমি কিছুই মনে করিনি। আপনি এসব চিন্তা বাদ দিন তো। আগে তাড়াতাড়ি সুস্থ হন এরপর সব দেখা যাবে।”
-“চাইলেই সব হয় না তিয়াসা। আমি সত্যিই আর থাকবো না। ডাক্তার তার বলা বলেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি আমার সময় শেষ। ”
-“আপনি চুপ করুন এখন। চুপচাপ শুয়ে থাকুন।”
-“তিয়াসা একটু কথা বল আমার সাথে। চুপ করতে বল না দয়া করে। বিয়ের পর তোমাকে শুধু কষ্টই দিয়ে গেলাম। নিজের ভুল বুঝতে পারলাম এমন একটা সময়ে যখন আর ফিরে আসার সুযোগ নেই। কিন্তু তিয়াসা বিশ্বাস কর যদি আমি কোনোভাবে বেঁচে ফিরতে পারতাম তাহলে তোমায় নিয়েই বাকি জীবন কাটাতাম। তোমায় স্ত্রীর মর্যাদা দিতাম। এতদিনের করা ভুলগুলোর প্রায়শ্চিত্ত করতাম। কিন্তু হায়! ভাগ্যের কি লিখন! আমি বুঝতে পারলাম ঠিকই। কিন্তু বড্ড অসময়ে।”
তিয়াসার কথা আটকে যায়। সাগর বলছে সে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিবে। তাহলে সে তার কাঙ্ক্ষিত সংসার পেতে যাচ্ছে? তিয়াসা মনে প্রাণে প্রার্থনা করতে থাকে সাগর যাতে সুস্থ হয়ে যায়। খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। সাগর আবার বলে, “তিয়াসা তুমি প্লিজ বল যে তুমি কিছু মনে করনি! আমি অন্তত শেষ বেলায় একটু শান্তি পাব।”
-“আমি আসলেই কিছু মনে করিনি। আপনি একটু চুপ করুন তো।”
-“তার মানে আমায় ক্ষমা করে দিলে?”
-“হ্যা। সবকিছু ভুলে গিয়েছি আমি। সব।”
সাগরের ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে। তিয়াসা মুগ্ধ হয়ে তাকায় সেদিকে। সাগরের সাথে একমাসের বেশি হল আছে। এত সুন্দর হাসি সাগরকে কখনো দিতে দেখেনি। সাগর তিয়াসাকে ডাকে, “একটু বুকে আসবে? জড়িয়ে ধরতাম তোমায়।”
তিয়াসা সাগরের বুকে মাথা রাখে। সাগর এক হাত দিয়ে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে তিয়াসার গলা। তিয়াসার চুলে মুখ গুজে দিয়ে বলে, “আমি দূর্ভাগা এই সুখ আমি হাতে পেয়েও নিতে পারিনি। কিন্তু সৌভাগ্য আমার, শেষ মুহূর্তে এসে কিছুটা হলেও স্বাদ নিতে পেরেছি।”
ওদিকে তিয়াসা সাগরের বুকে মাথা রেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেনি। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পরছে। সাগরের এক হাতের আঙুলগুলোর মাঝে নিজের আঙুলগুলো ঢুকিয়ে দেয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণপণে ভিক্ষা চাইছে সাগরের জীবন। যে স্বামীর ভালোবাসা জীবনে পায়নি সেই স্বামীর জীবনের বিনিময়ে যেন নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারবে তিয়াসা। সাগরের বুকের আওয়াজ ভালোভাবেই পাচ্ছে তিয়াসা। মাথা উঠাতে গেলে সাগরই চেপে ধরে। তিয়াসা সাগরের দিকে তাকায়। দেখে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সাগরের। দ্রুত মাথা উঠায়। এবার আর সাগর মাথা চেপে ধরে না। তিয়াসা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার দেয়। সাগরের মা আর ডাক্তার ছুটে আসে। ডাক্তার সাগরের নাড়ি পরীক্ষা করে হতাশ দৃষ্টিতে তিয়াসাদের দিকে তাকায়, “তিনি আর নেই।”
তিয়াসা চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। বিয়ের পর থেকে সে এই দিনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সাগর তাকে মেনে নিবে, সে তার কাঙ্ক্ষিত সংসার পাবে। আজ সাগর তাকে মেনে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সুখের সংসার আর পাওয়া হল না। তিয়াসা চিৎকার করে কাঁদতেই থাকে। পরিবেশ ভারী হয়ে যায় তিয়াসার কান্নায়। কয়েকজন এসে তিয়াসাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করে, ব্যর্থ চেষ্টা।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প