ভোরের শেষ চিঠি: পর্ব ১

ঢাকার ব্যস্ত এক দুপুর। রাস্তাজুড়ে গরম বাতাসের ঝাঁপটা, হর্নের বিকট শব্দ আর মানুষের অবিরাম ছুটোছুটি। শহরের এক কোণে, পুরনো এক ক্যাফে ‘ভিনটেজ কাপে’—যেখানে সময় যেন একটু ধীর হয়ে চলে—সেখানেই প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের।
অয়ন কেবলমাত্র অফিস থেকে ছুটে এসেছে। সাদা শার্টটা এখন ধূলিধূসর, চোখে ক্লান্তির ছায়া। সে প্রতিদিনের মতো নিজের কোণার টেবিলটায় বসে চুপচাপ কফির অর্ডার দেয়। আরেকদিকে, ক্যাফের দরজা ধাক্কা দিয়ে হঠাৎ ঢুকে পড়ে একজন মেয়ে—বৃষ্টিতে ভেজা চুল, হাতে একটা ছিঁড়ে যাওয়া বই, কাঁধে একটা পুরনো ব্যাগ। তার নাম — অনুরাধা।
অনুরাধা ক্যাফের ভেতর ঢুকে চারপাশে তাকায়। কোনো টেবিল খালি নেই। অয়নের চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে,
“আমি কি এখানে বসতে পারি? যদি কিছু মনে না করো?”
অয়ন বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে তাকে। দুমিনিট চুপ করে থেকে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। মেয়েটির চোখে ছিল অদ্ভুত এক উষ্ণতা, যেন ক্লান্ত শহরের ভেতর এক চিলতে ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া।
কথা শুরু হয় খুব সাধারণভাবে।
“আজ বৃষ্টি হবে মনে হয়নি,” অনুরাধা হাসে।
অয়ন শুধু হালকা মাথা নাড়ে। সে কথা বলার মানুষ নয়। তার ভেতরের জগত অনেক বড়, কিন্তু প্রকাশের ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছে বহুদিন আগে।
কিন্তু অনুরাধা সহজেই সব বাঁধ ভেঙে দেয়।
সে বলে, “আমি আজ একটা ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম, একটা পত্রিকায়। ভিজে গেছি পুরোটাই! কফি না খেলে ঠাণ্ডা লাগবে।”
অয়ন অবাক হয়—কত সহজে এই মেয়েটা তার অচেনা জগতে ঢুকে পড়েছে।
কিছুক্ষণ বাদে দুজনেই তাদের নিজেদের বই পড়ায় ডুবে যায়। ক্যাফেতে একধরনের নরম গান বাজছে। মাঝে মাঝে অনুরাধা চা চুমুক দেয়, আর অয়ন তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে ছিটকে পড়া বৃষ্টির ফোটাগুলোর দিকে।
বৃষ্টি ধীরে ধীরে থামে। টেবিলের ওপর চা-কফির কাপ খালি হয়। অনুরাধা ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বের করে অয়নের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
“তুমি কি তোমার নাম লিখবে এখানে? মনে থাকবে। আজকের দিনটা মনে রাখার মতো,” বলে হালকা হাসে সে।
অয়ন একটু ভেবে, প্রথমবারের মতো হেসে, তার নাম লেখে: অয়ন সেন।
তার নিচে অনুরাধা লিখে দেয়: অনুরাধা দাশ।
সেদিন বিদায়ের আগে দুজনই কেবল একবার তাকিয়ে ছিল একে অপরের দিকে। কোনো কথা ছিল না, কোনো প্রতিশ্রুতিও না। কেবল ছিল একটা নিরব, কোমল অনুভব—আবার দেখা হবে। হয়তো এই শহরের আরেকটি বৃষ্টির দিনে, হয়তো কোনো ভোরের শেষ চিঠিতে।
অয়ন সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি। বারবার মনে পড়েছে অনুরাধার চোখ। কী যেন ছিল সেখানে—অজানা, অথচ চেনা।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প