ভোরের শেষ চিঠি: পর্ব ২

এরপর অনেকগুলো দিন কেটে যায়, কিন্তু অয়নের মন থেকে সেই বিকেলের স্মৃতি কিছুতেই মুছে যায় না। ক্যাফের জানালার পাশের টেবিল, ভেজা চুলের সেই মেয়েটা, বুকের কাছে ধরে রাখা ছিঁড়ে যাওয়া বইটা – সব যেন চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে।
সে ক্যাফেতে আবার যায়। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার, একই সময়ে। একই টেবিল, একই কফি, কিন্তু অনুরাধা আসে না।
অয়ন অপেক্ষা করতে থাকে, চুপচাপ।
একদিন, ক্যাফের দেয়ালে ঝোলানো ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ বোর্ডে হঠাৎ তার চোখ পড়ে একটা জিনিসে। একটা ছোট্ট নোটবুক, যার কভারটা একটু ভেজা। লেখা আছে – “অ. দাশ”। তার বুক ধক করে ওঠে।
অয়ন সেটা চুপচাপ নিয়ে টেবিলে বসে। পাতাগুলো উল্টে দেখতে থাকে। কিছু কবিতা, কিছু হাতের আঁকা স্কেচ, আর একপৃষ্ঠায় লেখা—
> “যদি কোনো একদিন ফের দেখা হয়, আমি চাই তুমি পড়ো আমার চোখ।
আমার মুখে কথা থাকবে না, শুধু থাকবে অপেক্ষার ছায়া।”
তার মন যেন হঠাৎ কেঁপে ওঠে। এই মেয়েটা শুধুই কবিতা লেখে না, সে অনুভব করে। সে বৃষ্টি দেখে না, সে ভালোবাসে বৃষ্টি।

এক সপ্তাহ পর
বৃহস্পতিবার। ক্যাফের দরজা খুলে আবার অনুরাধা ঢোকে। এইবার তার চুল খোলা নয়, খোঁপা করা। চোখে কাজল, কিন্তু মুখে সেই একই শান্তি। অয়ন অবাক হয়। মনে হয় যেন কেউ স্বপ্ন থেকে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠে এসেছে।
“তুমি এখনো এখানে আসো?” – অনুরাধা হেসে বলে।
অয়ন মাথা নাড়ে, “তোমার নোটবুকটা খুঁজে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আর দেখা হবে না।”
অনুরাধা চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,
“আমি আসতাম। কিন্তু সাহস হয়নি। তোমার চোখে ছিল কেমন যেন একরকম নিঃশব্দতা। আমি বুঝতে পারিনি তুমি সেই নিরবতায় কাউকে গ্রহণ করতে পারো কিনা।”
অয়ন কিছু বলে না। শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

সেদিন তারা অনেক কথা বলে।
ক্যাফের আলো নিভে আসে, কিন্তু তাদের কথা শেষ হয় না। অনুরাধা বলে তার ছোটবেলার কথা, তার বাবা-মাকে হারানোর কথা, কবিতার প্রতি ভালোবাসা আর শহরের একাকীত্বে লুকিয়ে থাকা তার ছোট ছোট স্বপ্নের কথা।
অয়ন প্রথমবারের মতো নিজের মনের কথা বলে। তার মা অনেক ছোটবেলায় চলে গিয়েছিল। বাবা একঘরে মানুষ, অয়ন বড় হয়েছে নিজে নিজে। সে মানুষকে ভালোবাসে, কিন্তু বলা হয় না কখনো। যেন তার অনুভব গলার কাছেই আটকে যায়।
অনুরাধা হেসে বলে,
“তোমার ভেতরকার মানুষটা অনেক মধুর। শুধু দরজা খুলে দিতে হয়। দরজার ওপাশে আমি আছি।”
সেই রাতে অয়ন ঘুমাতে পারে না। জানালার পাশে বসে, নিজের নোটবুকে কিছু লেখে—
> “সে এল যেন নিঃশব্দে, অথচ শব্দ হয়ে গেঁথে রইল আমার শিরায়।
আমি লিখিনি তাকে নিয়ে কোনো কবিতা, কারণ সে নিজেই এক ছন্দ।”

পরদিন
অনুরাধা প্রথমবার অয়নের সঙ্গে হাঁটতে বের হয়। তারা দুজনে শহরের পুরনো রাস্তাগুলো ধরে হাঁটে, ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়ায়, পুরনো বইয়ের দোকানে ঢোকে।
একটা পুরনো বইয়ের মধ্যে অনুরাধা খুঁজে পায় একটা খাম।
তার ভিতরে লেখা – “ভোরের চিঠি – কাউকে না লেখা।”
অনুরাধা সেটা নিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
“এই চিঠি কি তোমার?”
অয়ন জিজ্ঞেস করে।
অনুরাধা বলে,
“না। তবে জানো, আমিও মাঝে মাঝে কাউকে না লেখা চিঠি লিখি। তুমি কী কখনো চিঠি লেখো?”
অয়ন বলে, “না… আমি চিঠি লিখি না। কারণ আমার যাদের কাছে লেখার ছিল, তারা কেউ পড়েনি।”
অনুরাধা চুপ করে থাকে। তার মুখে এবার আর সেই স্বাভাবিক হাসি নেই। বরং একরকম বিষণ্ণতা যেন তার চোখের কিনারা ভিজিয়ে দেয়।

সেদিনের মতো তারা বিদায় নেয়।
কিন্তু এবার বিদায়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভব ছিল।
এমন কিছু যেন বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
অনুরাধার মুখে ছিল অনেক না বলা কথা,
অয়নের মনে ছিল অনেক জমে থাকা প্রশ্ন।
তারা কি একে অপরকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে?
নাকি পুরনো ব্যথাগুলো আবার মাথা তুলছে?
ভবিষ্যত কি একই ছন্দে এগোবে, নাকি নতুন ছায়া পড়বে এই সম্পর্কের উপর?

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প