সুমনকে ঘরে ঢুকতে দেখে আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘সুমন, তুমি কই ছিলা এতোক্ষণ?’
সুমন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, ‘বাথরুমে ছিলাম ভাই।’
‘বাথরুমে যাওয়ার পর একবারও রুমে আসোনি?’
‘নাতো ভাই। মাত্রই তো আমি রুমে ঢুকলাম।’
ততক্ষণে বাবুল উঠে গেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
‘সুমনের মতো কে জানি দাঁড়ায় ছিলো এখানে।’
আমার কথা শুনে বাবুলের মুখ শুকিয়ে গেলো।
আমি এবার বাবুলকে বললাম, ‘তুই কিছু লুকাচ্ছিস। সত্যি করে বলতো, কি হইসে এখানে? যা এতোক্ষণ দেখছি, সব কি মনের ভুল?’
‘না।’
‘তাইলে?’
বাবুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পুরো কাহিনী বললো।
দুই বছর আগে ওদের এই তিনতলায় এক ভাড়াটিয়া আসে, শুধু হাজব্যান্ড আর ওয়াইফ। ওরা যেনো একটু কেমন ছিলো, বাসা থেকে বের হতো না, কারো সাথে মিশতোও না। খালি মাঝেমধ্যে কিছু পার্সেল আসতো কুরিয়ারে, আর কিছু লোক আসতো, ওরা বলতো লোকগুলো ওদের আত্মীয় হয়। ঠিকঠাক মতো ভাড়া দিতো বলে বাবুলরাও তেমন ঘাটায়নি ওদের।
একদিন হঠাৎ করেই ভাড়াটিয়া বউটা মারা গেলো। কি হয়েছে, কেউ বলতে পারে না। আগেরদিনও যারা দেখেছে, বলেছে একদম সুস্থ ছিলো মেয়েটা, চেহারায় অসুখ-বিসুখের কোনো চিহ্নই ছিলো না। আগেরদিন নাকি বিকেলবেলা ছাদ থেকে কাপড় আনতে গিয়ে দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া আন্টির সাথে দেখা হয়েছিলো। আন্টির মনে হয়েছিলো, মেয়েটি কেমন অন্যমনষ্ক, কি নিয়ে যেন চিন্তা করছে। ব্যস, অতোটুকুই। পরদিন সকালে উঠেই তারা শুনলেন মেয়েটি মারা গেছে।
মেয়েটার লাশটা বাড়ির সবাই দেখেছিলো, কেমন একটা আতঙ্কের ভাব লেগে ছিলো মেয়েটার মুখে। ওর বর মেয়েটার লাশ নিয়ে কোথাও চলে গেল, এরপর কি হলো, মেয়েটার জানাজা বা কবর বা শেষকৃত্য কোথায় হলো, কেউ বলতে পারে না। মেয়েটা মারা যাবার এক সপ্তাহ পরই ওর বর বাড়িটা ছেড়ে দেয়, এরপর তারও আর খোঁজ থাকে না কারো কাছে।
একমাসের মধ্যেই ঘরটা ভাড়া হয়ে গেল। নতুন ভাড়াটেদের জন্য বাড়িটা চুনকাম করতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির একটা রুমের দেয়ালে ছোপ ছোপ রঙ করা, যেন দেয়ালের কোনো লেখা লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে রঙগুলো ওঠাতেই দেখা গেল অদ্ভুত দৃশ্য। কি সব দুর্বোধ্য ভাষায় নকশা কাটা রয়েছে, তারার নকশা, গোল চাকতির মতো নকশা, আর একটা ছবি। মানুষের শরীরে মহিষের মাথা বসানো এক বিকট প্রাণীর ছবি। ছবিটা নাকি এতো ভয়ংকর ছিলো, রঙমিস্ত্রীরা ঐ ছবি দেখেই কাজ ছেড়ে পালিয়ে যায়, তারা এখানে কাজ করবে না। বাবুলের আব্বা আর রঙমিস্ত্রী খুঁজে পান না, কেউই কাজ করতে চায় না এ বাড়িতে। সবাই বলাবলি করতে লাগলো, ঐগুলো শয়তান সাধনার জিনিস, ঐ বর-বউ ঘরে বসে তবে শয়তান সাধনা করতো, আর মাঝেমধ্যে ঐ লোকগুলোও আসতো সাধনায় যোগ দিতে। এই বাড়িতে কেউ কাজ করলে তার নাকি সমস্যা হবে। শেষমেশ বাবুলের আব্বা নিজেই শিরীষ কাগজ দিয়ে ছবিগুলা উঠিয়ে, এরপর অনেক বেশি মজুরিতে রঙমিস্ত্রী রেখে বাড়িটা রঙ করালেন।
নতুন ভাড়াটিয়া উঠলো। কিন্তু তারা তিন সপ্তাহের বেশি টিকতে পারলো না। তারা নাকি রাতেরবেলা ঘরে কারো হাঁটার শব্দ পেতো, হঠাৎ হঠাৎ কান্না আর চিৎকারের শব্দ শোনা যেতো। শেষদিকে নাকি অন্ধকারে কাদেরকে দেখা যেত। ভাড়াটিয়ারা আর নিতে পারছিলেন না, ছেড়ে দেন বাড়ি।
এর দুমাস পর আবার বাড়ি ভাড়া হয়, এবং একই রকমভাবে আবার ভাড়াটেরা বাড়ি ছেড়েও দেন। এইভাবেই চলছে। বেশ কয়েকদিন পর নতুন ভাড়াটে আসে, বাবুলের আব্বা তাদের সব কিছুই বলেন এবং সবকিছু জেনেও তারা বাড়ি ভাড়া নেন, কিন্তু এক-দেড়মাসের বেশি কেউ টিকতে পারেন না।
রাকিব ততক্ষণে উঠে গেছে। আমি বাবুলকে বললাম, ‘তাইলে এইখানে আমাদের ঘুমাতে নিয়ে আসলি কেন?’
বাবুল আমতা আমতা করে বললো, ‘এক সপ্তাহ আগে একজন এসে বাড়িটা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিলো, বলেছিলো আর কোনো সমস্যা হবে না। এরপর আব্বু আর আমার ছোটভাই এখানে এসে একরাত ছিলো। ওদেরও কোনো সমস্যা হয়নি।’
‘তাইলে আজকে কেন এসব হচ্ছে?’
‘জানি না।’
চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে আছে। বাইরে যে কুকুরগুলো ডাকছিলো এতোক্ষণ, সেগুলোর শব্দও আর পাওয়া যাচ্ছে না। ঝড়ের আগে যেমন থম মেরে থাকে চারপাশ, তেমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে তখন। ঘরে তখন কেবল টেবিল ফ্যানটাই চলছিলো ঘরঘর করে, আর কোনো শব্দ নেই।
আমি বাবুলকে জিজ্ঞেস করলাম,’যেই ঘরে নকশা আর ছবিগুলো পাওয়া গিয়েছিলো, সেটা কোন ঘর?’
‘আমাদের ঘরের পাশের ঘরটাই।’
আর তখনই, সেই রাতের নীরবতা ভেঙে কে যেন ভয়ংকরভাবে চিৎকার করে উঠলো পাশের ঘরে। আমাদের আর সাহস রইলো না থাকার, পড়িমড়ি করে সব ফেলে দৌড়ালাম মেইন দরজার দিকে। কেবল বাবুলের হাতে মোবাইল ধরা ছিলো, সেটা থেকে আলো ফেললো দরজার ওপর, আর আমি খুলতে শুরু করলাম দরজা।
কিন্তু, খুললো না দরজা। কেউ যেন শক্ত করে চেপে ধরে আছে সেটাকে।
চিৎকারের শব্দ তখন বাড়ছে। সাথে বাড়ছে অনেক মানুষের হাসি আর হাততালির শব্দ। শুনে মনে হচ্ছিলো, একটা মেয়ে চিৎকার করছে, আর তার চারপাশে অনেক লোক দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে আনন্দে। চিৎকারের শব্দটা আস্তে আস্তে রুমের মাঝখানে থেকে রুমটার দরজার দিকে আসতে লাগলো, দরজা পেরোলেই সেটা পেয়ে যাবে আমাদের। আমাদের একেকজনের তখন যে অবস্থা, সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করছি দরজা খোলার। দরজাটা কাঠের, পানিতে ভিজলে কাঠের দরজা যেভাবে ফুলে এঁটে থাকে ফ্রেমের সাথে, সেভাবেই লেগে আছে দরজাটা। চিৎকারের শব্দটাও ততক্ষণে চলে এসেছে কাছে, সেটা এখন চাপা আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছে। যার আর্তনাদের শব্দ, সে যখন রুমের দরজার কাছে চলে এসেছে, আর এক পা দিলেই সে আমাদের আর আমরা তাকে দেখতে পারবো, তখনই বিকট শব্দে মেইন দরজা খুলে গেলো। দরজাটা খুলতে পেরেছি আমরা।
দরজা খোলার সাথে সাথেই থেমে গেল চিৎকারের শব্দ।
আমরা তখন শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়ালাম একটু, কে বের হয় রুমটা থেকে দেখার জন্য।
কেউ বেরুলো না।
ভয়টা ততক্ষণে একটু কমেছে। আমরা বের হতে যাবো মেইন গেট দিয়ে, তখনই দেখলাম, একজন এসে দাঁড়িয়েছে সেই ভয়ংকর রুমটার সামনে। সে এমন ভয়ানকভাবে তাকালো আমাদের দিকে, অমনভাবে তাকাতে আমি আর কাউকে দেখিনি।
আমরা আর কেউ দাঁড়ালাম না। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে গেলাম তিনতলা থেকে। আমাদের শব্দে বাড়ির মানুষজন সব উঠে গেছে, তারা সব শুনলো আমাদের কাছে। কিন্তু সেই রাতে তিনতলায় যাবার সাহস কারো হলো না।
পরদিন সকাল হলে আমরা তিনতলায় গেলাম আমাদের জিনিসগুলো আনতে। বাবুলের আব্বা আমাদের সাথে গিয়ে তিনতলায় তালা মেরে আসলেন। সেই যে আসলেন, আর এই তিনবছর সেই তালা কেউ খোলেনি। সেই ঘরটার ভেতর এখন কি হচ্ছে, কেউ জানে না।
এতোবড় একটা ঘটনার পরও আমরা বেশ ভালোভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করলাম।সেই রাতের ঘটনা নিয়ে সেই বাড়িতে তখন আর কোনো আলোচনাও হয়নি, কারণ আমাদের ভয় ছিলো, বরপক্ষ এই কথাগুলো জানতে পারলে সমস্যা হতে পারে। বউভাতের পরেরদিন আমি আর বাবুল ঢাকায় ফিরে আসি।
এই তিনবছরে আর যাওয়া হয়নি ওদের বাসায়।
ফিরবার পথে আমি বাবুলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘যাকে আমরা সেদিন রাতে ঐ ঘরটার সামনে দেখেছিলাম , তাকে চিনিস?’
‘হুম।’
‘কে ও?’
‘যেই ভাড়াটিয়া বউটা মারা গেছিল দুই বছর আগে, সেই বউটা।’