বাবুলের বোনের বিয়েতে গিয়ে যে ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো ঘটেছিলো আমাদের সাথে, সেগুলো আজকে বলবো। তার আগে বলে নেই, বাবুল নামটা ছদ্মনাম, ওর আসল নামে গল্পটা বলার পারমিশন পাই নি।
ঘটনা তিনবছর আগের। আমাদের বন্ধু বাবুলের বড় বোনের বিয়ে, সে উপলক্ষ্যে আমাকে আর হাবিবকে সে দাওয়াত করলো। এইদিকে আমাদের যাত্রার আগেরদিন পেট খারাপ হয়ে গেলো হাবিবের। শেষমেশ ওকে ছেড়েই ট্রেনে চেপে আমরা রওনা দিলাম।
বাবুলের বাড়ি কোথায় এটা বলতেও নিষেধ আছে, তবে একটা হিন্ট দিচ্ছি, বাংলাদেশের উত্তরের বেশ বড় শহরে ওর বাড়ি। যাই হোক, কয়েকঘণ্টা ট্রেন জার্নির পর ওর বাসাতে পৌঁছে গেলাম আমরা। সন্ধ্যায় ওর বোনের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান করলাম। রাতে আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা হলো ওদের বাড়ির তিনতলায়।
এখানে বাবুলদের বাড়ি নিয়ে একটু বলি। ওদের তিনতলা বাড়ি, নিচতলায় ওরা থাকে, আর ওপরের দুটোতলা ভাড়া দেয়। বিয়ে উপলক্ষ্যে এতো মেহমান ওদের বাসায়, তাই সেখানে শোয়া সম্ভব হলো না। ঠিক হলো, আমরা তিনতলায় শোবো, সেখানে কোনো ভাড়াটিয়া নেই, দুমাস ধরে খালি পড়ে আছে বাড়ি। কার কাছে যেন শুনলাম, ওখানে ভাড়াটিয়া বেশিদিন থাকেও না। যাই হোক, এগারোটা বাজতেই আমরা উপরে ঘুমাতে গেলাম। আমাদের সাথে বাবুলের দুই কাজিন সুমন আর রাকিবও গেলো (এ দুটোও ছদ্মনাম)। সুমন আর রাকিব বয়সে আমাদের চেয়ে কিছু ছোট, কিন্তু এরমধ্যেই ওদের সাথে ভালো ভাব হয়ে গেছে আমার।
তিনতলাতে উঠে একটা রুম কিছুটা ঝারপোঁছ করে বেডিং করে ফেললাম। আগেই বলেছি, ওখানে কোনো ভাড়াটিয়া নেই দুমাস, তাই বাড়িটা একদম খালি। আমরা নিচে থেকে আসার সময় তোশক,বালিশ, মশারি এসব নিয়ে আসছিলাম, আর সাথে এনেছিলাম দুটা ৬০ ওয়াটের বাল্ব আর একটা টেবিল ফ্যান। লাইট দুটার একটা লাগানো হলো রুমে, আরেকটা বাথরুমে। এরপর ফ্যান অন করে মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা।
মাঝরাতে কেমন একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। ফোনে দেখলাম, আড়াইটা বাজে। আমার মনে হলো, আশেপাশের রুম থেকে কারো হাঁটার আওয়াজ পাচ্ছি, কারা যেন কথাও বলছে ফিসফিস করে। বাইরে থেকে কারো ভেতরে আসা সম্ভব না, কারন মেইন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ঘুমিয়েছে আমরা। তাহলে কে হাঁটছে পাশের রুমে? আমি বাবুলকে ওঠালাম। ও উঠতেই শব্দগুলো থেমে গেল। তবুও বাবুল আর আমি দুইজনেই মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে আশেপাশের রুমগুলো খুঁজলাম। কেউ নেই। রুমগুলোতো পুরো খালি, কেউ যে লুকিয়ে থাকবে তেমন উপায়ও নেই। এরমধ্যে জানালাগুলোও বন্ধ করা। কেউ যে কোনোভাবে বাইরে থেকে এসে আবার চলে যাবে, এমন কোনো উপায়ই নেই। তাহলে কি শুনলাম তখন? যাক, ঘুমের ঘোরে ভুল শুনেছি ভেবে আবার শুতে চলে আসলাম বিছানায়।
শোয়ার পরও আর ঘুম আসছিলো না। বাবুল অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে, ঘুমিয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। ওর কাজিন দুজন নাক ডাকছে। আমি মোবাইলটা চালাবো বলে হাতে নিয়েছি, এই সময়েই রুমের দরজার দিকে আমার চোখ গেলো। পুরো বাড়ি তো অন্ধকার, দরজার ওপাশেও নিকশ কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে। সেই অন্ধকারেই মনে হলো, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ।
আমি ভয়ে জমে গেলাম। কোনোভাবে জোরে বাবুলকে ডাকতেই ও লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে মোবাইল টর্চের আলো ধরলো। সেই আলোতে দেখলাম, কেউ নেই। বাবুল আমার দিকে ফিরে একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘কিরে, নতুন জায়গায় এসে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখছিস? কিছু চিন্তা না করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়। দেখবি, এক ঘুমেই সকাল হয়ে যাবে।’ বলেই ও অন্যদিক ফিরে শুলো। আমিও চুপচাপ চোখ বন্ধ করলাম।
একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারলাম, বাবুল কিছু একটা লুকাচ্ছে আমার কাছে। আমি কেবল ডাক দিতেই ও উঠে দরজার দিকে আলো ধরলো, অথচ আমি একবারও বলিনি দরজায় কেউ আছে। তারমানে, ও জেগে ছিলো, এবং জিনিসটা সেও দেখেছে। আর জিনিসটা যদি সত্যি মানুষ হয়, ওমন বিশাল মানুষ আমি কখনো দেখিনি। পুরো দরজা জুড়েই দাঁড়িয়ে ছিলো ওটা।
আমার তখন খুব ভয় লাগলো। মনে হলো, এক ভয়ংকর কিছু ঘটবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমি চোখদুটো বন্ধ করে রাখলাম, যদি কোনোভাবে ঘুম এসে যায়, যদি এক ঘুমে রাতটা পার করতে পারি। সকাল হলে এই ভয়ংকর জিনিসগুলো থেকে হয়তো রেহাই পাবো।
কিন্তু, রাত শেষ হতে তখনো অনেক বাকি।
এরমধ্যেই দেখলাম সুমন উঠেছে। চুপচাপ হেঁটে বাথরুমে গেলো ও। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি, কিছুক্ষণ পর টের পেলাম সুমন এসেছে। কিন্তু মশারির ভেতর না ঢুকে বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে ও। আমি আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম, ও একদৃষ্টিতে মশারির ভেতর আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চাহনিটা কেমন যেন লাগলো আমার, ঘুরে পাশ ফিরে শুলাম। কিছুক্ষণ কেটেছে, এর পরপরই শুনি বাথরুমে লাইট বন্ধ করার শব্দ। তার পরেই সুমন বাথরুম থেকে ঘরের ভেতর হেঁটে আসলো।