মা ও বৃদ্ধাশ্রম

সকালের সূর্য আজ একটু ধীরে উঠেছে।
খুলনার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা “মাতৃছায়া বৃদ্ধাশ্রম” যেন নিঃশব্দে অপেক্ষা করে। আশ্রমটির পরিবেশ নিঃস্তব্ধ, কেবল বাতাসের দোলায় কিছু শুকনো পাতা মাটিতে পড়ে টুপ করে শব্দ তোলে।
একটি সাদা গাড়ি এসে থামল বৃদ্ধাশ্রমের ফটকে।
গাড়ি থেকে নামলেন এক বৃদ্ধা—চুলে পাক ধরা, চোখে অনুচ্চ এক শান্ত অভিমান।
তার সাথেই নেমে এল এক যুবক এবং এক নারী। যুবকের নাম মাসুম ইফতেখার, তার স্ত্রী নেহা।
বৃদ্ধাটি মাসুমের মা, মাসুরা বেগম।
দায়িত্বপ্রাপ্ত রিফাত সাহেব তাদের অভ্যর্থনা জানালেন।
— “আপনারা কাকে রেখে যেতে এসেছেন?”
মাসুম গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
— “আমার মা। তিনি এখন একা থাকেন। সময় দিতে পারি না, কাজের চাপ… তাই ভেবেছি এখানে থাকলে ভালো হবে।”
— “আপনার নামটা বলবেন?”
— “আমি মাসুম ইফতেখার। আমার বাবার নাম রফিক ইফতেখার।মা মাসুরা বেগম। আমরা খুলনারই বাসিন্দা।”
এই নামগুলো শুনে থমকে গেলেন রিফাত সাহেব।
চোখ বড় বড় করে তাকালেন মাসুমের দিকে। কিছু সময় চুপ থেকে বললেন,
— “আপনার আর আপনার স্ত্রীর কোনো খরচ দেওয়া লাগবে না। উনার যত প্রয়োজন, সব আমি দেখব।”
নেহা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
মাসুম কিছুটা অস্বস্তিতে বলল,
— “তবুও আমি চাই প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতে…”
রিফাত সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
— “না মাসুম সাহেব, এক টাকাও নয়। শুধু আপনার নাম-ঠিকানা আর ফোন নাম্বরটা দিয়ে যান।”

২০ দিন পর
মাসুমের খুলনার বাসায় এসে পৌঁছায় একটি চিঠি।
প্রেরক—রিফাত সাহেব, পরিচালনাকারী, মাতৃছায়া বৃদ্ধাশ্রম।
খাম খুলে মাসুম চিঠিটি পড়তে শুরু করল—

চিঠি
প্রিয় মাসুম,
আশা করি ভালো আছো। সুখে শান্তিতে আছো।
তুমি যে ভদ্রমহিলাকে আমাদের আশ্রমে রেখে গেলে, তুমি কি কখনও তাকে সত্যিকার অর্থে চিনতে পেরেছো? তিনি কি শুধুই “মা” এই শব্দে সীমাবদ্ধ ছিলেন?
আজ তোমাকে একটা গল্প বলি।
প্রায় ৩০ বছর আগে, এক সকালে আমাদের এতিমখানায় হাজির হয় এক দম্পতি। তারা নিঃসন্তান। বিয়ের পর পাঁচ বছর ধরে সন্তান চায়। ডাক্তার, কবিরাজ, তাবিজ-কবচ—সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
তারা কোথা থেকে জানতে পারে আমাদের এতিমখানায় একটি শিশু দত্তক দেওয়া হবে।
তারা এল। একটি শিশুকে বুকের মাঝে তুলে নিল।
তাকে লালন করল, শিখাল, মানুষ করল।
ছেলেটি যখন এসএসসি পাস করল, তারা আবার এসেছিল। আনন্দে চোখ ভিজে উঠেছিল তাদের। বলেছিল—
“আমাদের সব কিছু আমরা আমাদের ছেলেকে লিখে দিয়েছি।”
তারপর আর তাদের দেখা পাইনি।
জানো মাসুম,
তুমি যখন এখানে এসে মাসুরা বেগম আর রফিক ইফতেখারের নাম বললে, তখন আমি চমকে উঠেছিলাম।
কারণ,
তারা আর কেউ নয়—তোমার সেই মা-বাবা, আর তুমি সেই দত্তক নেওয়া শিশু।
তারা তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিল ভালোবেসে, তোমাকে বিশ্বাস করেছিল হৃদয় দিয়ে।
তাদের সব কিছু তোমার নামে করেছিল।
তাদেরই একজনকে, তোমার মাকে, তুমি আজ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছো।
তুমি হয়তো সফল হয়েছো, কিন্তু তুমি কি মানুষ হতে পেরেছো?
তারা যদি তোমাকে সেদিন না নিতো, আজ কি তুমি মাসুম ইফতেখার হতে পারতে?
তোমাকে বলছি না ফিরে এসো—শুধু নিজেকে একবার প্রশ্ন করো।
ভেবে দেখো…
—রিফাত সাহেব
পরিচালক, মাতৃছায়া বৃদ্ধাশ্রম

চিঠি পড়া শেষ করতেই মাসুমের বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার করে উঠল।
চোখের কোনে ভেসে উঠল পুরনো কিছু মুহূর্ত—মায়ের কোলে মাথা রাখা, অসুস্থ হলে তার শীতল হাতের ছোঁয়া…
সে বলল,
— “নেহা… চলো, মাকে নিয়ে আসতে যাই… চলো আমরা ভুল করেছি…”

একদিন পর
মাতৃছায়া বৃদ্ধাশ্রমে মাসুম ও নেহা গিয়ে দাঁড়াল মায়ের কক্ষে।
কিন্তু মাসুরা বেগম চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
তার চোখে কোনো অভিশাপ ছিল না, শুধু এক বিশাল অভিমান।
মাসুম কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— “মা, আমি ভুল করেছি। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। চলো মা…”
মাসুরা ধীরে মাথা নাড়লেন, বললেন না কিছুই।
তার চোখে কোনো ঘৃণা ছিল না, কিন্তু স্পষ্ট এক দূরত্ব।
তার ঠোঁটে শুধু একটি বাক্য:
— “আমি আমার ঠিকানাতেই ভালো আছি… যেখান থেকে কেউ আমাকে আর ফেলে যেতে পারবে না।”
মাসুম নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল…
নেহা চোখ মুছল…
আর বাইরে তখন হালকা বাতাসে উড়ে যাচ্ছে কিছু শুকনো পাতা।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প