মুখ

স্নেহা হঠাৎ করেই বললো, ‘প্লিজ, ঘরের জানালাটা খুলবে না।’
আমি একটু অবাক হলাম। স্নেহার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আজ এক সপ্তাহ। ওর সাথে আমার পরিচয়ও এই এক সপ্তাহই। যতোটুকু ওকে চিনি, জানালা বন্ধ রেখে ও ঘুমাতে পারে না। প্রচন্ড গরম থাক, কি বৃষ্টি হোক, কি ঝড় হোক, তার জানালা খোলা থাকা চাই-ই। কিন্তু, নিজের বাড়িতে এসে ও একথা কেন বলছে?
আমার শ্বশুরবাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। যদিও বিয়েটা হয়েছে ঢাকাতেই। বিয়েতে ছুটি পাইনি, অফিসের জরুরি কাজ ছিলো। অথচ সবাইকে দাওয়াত দেয়া, কার্ড ছাপানো, সব কাজ শেষ। শেষমেষ, সেদিন ফুলটাইম অফিস করে রাতে এসে বিয়ে করলাম। পরদিনও অফিস। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে অফিস করেছি। এভাবে পুরো সপ্তাহ কাটালাম, এরপর ছুটি মঞ্জুর হলো। ছুটি নিয়েই চলে এসেছি শ্বশুরবাড়ি। এখানে প্রথম রাত আমাদের।
স্নেহার আবদার শুনে আমি বললাম, ‘জানলা না খুললে তো গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবো।’
‘হলে হবো। তবুও জানলা খুলবে না।’
কি আর করার। জানালা না খুলেই রাত কাটাতে হলো।
সকালে শালাকে ডেকে বললাম, ‘তোমার বোনের জানলা খুলতে এতো ভয় কেন?’
সে ভয়ার্ত গলায় বললো, ‘জানি না।’ এরপর সেই যে চুপ হলো, তার মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারলাম না।
বিকেলে গেলাম মহানন্দার তীরে হাঁটতে‌। এখনকার স্নেহা আর রাতের স্নেহার মধ্যে কতো তফাৎ! মহানন্দা নিয়ে এত্তো এত্তো হাসির গল্প বললো সে, হাসতে হাসতে পেট ফাটার জোগার। সেতুর নিচে বসে ছানার জিলাপি খেলাম আমরা।‌‌‌‌‌‌ গোধুলি বেলায় সূর্য ডোবা দেখলাম একসাথে।
রাতের স্নেহা আবার আগের মতো। ভয় পাওয়া গলায় বললো, ‘খুলো না জানলা।’
খুললাম না। তবে আজ ওকে চেপে ধরলাম, ‘জানলার কাহিনী কি, বল।’
‘বলবো না। বললে তুমি হাসবে।’
‘নাহ। হাসবো না একদম।’
স্নেহা তবুও চুপ করে রইলো, কিছুতেই বলবে না। আমিও নাছোড়বান্দা, শুনবো। শেষমেষ, বলতে রাজি হলো সে।
‘তিনবছর আগের কথা। বড় আপার বিয়ে। ঘরভর্তি মানুষজন। সবাই হৈচৈ করে বেড়াচ্ছে। এ রুমটা ছিলো বড় আপার। আমরা মেয়ে কাজিনরা মিলে এ রুমে আপাকে সাজাচ্ছিলাম। আপার সব সাজ শেষ, কেবল চোখে কাজল পড়ানো বাকি। কাজল রাখা জানলার ধারে এই টেবিলে‌। আমি ঘুরে কাজল নিতে আসলাম। বাকিরা তখন আপাকে ঘিরে খাটের ওপর বসা।
কাজল নিতে জানলার ধারে এসেছি, দেখি একটা মুখ। একনজরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা। যখন বুঝলাম, জোরে চিৎকার দিলাম। সবাই দৌড়ে আসলো। মুখটা ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে জানলার কাছ থেকে‌। বুঝতে পারছো তো, কেন ভয় পেয়েছিলাম?’
পেরেছি। আমাদের এ ঘরটা দোতলার ওপর। ওপাশে জানলা পর্যন্ত আসার জন্য কোনো পাইপ নেই, একতলায় দাঁড়ানোর জন্য কার্নিসও নেই। দোতলার এ বারান্দায় কারো মুখ দেখা একদমই অসম্ভব।
‘সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম। সবাই বোঝালো, বিয়ের কাজের চাপে উল্টোপাল্টা দেখেছি। ভাবলাম তাই, হতে পারে।
তিনচারদিন পর। আপুর এ রুমটায় আমি থাকা শুরু করেছি। এক রাতে, ঘুমাতে গেছি আগে আগে। দুদিন পর পরীক্ষা, ঠিক করেছি ফজরের সময় উঠে পড়া শুরু করবো। সকাল সকাল আমার পড়াটা ভালো হয়। ঘুমাচ্ছি, কিসের শব্দে ঘুম ভাঙলো। আমার মুখ জানলা বরাবর। জেগে উঠে দেখি, সেদিনের সেই মুখটা জানলার বাইরে থেকে তাকিয়ে আছে। কি যে ভয়ংকর লাগছে মুখটাকে দেখতে, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। একদৃষ্টিতে সেটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে, চোখের পলক পড়ছে না।
আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফিরলো পরদিন দুপুরে।
বাবা মাকে বললাম। তারা একজন হুজুর ডেকে মিলাদ পড়ালেন। ভাবলাম, সব শেষ, আর কিচ্ছু হবে না। এ রুমেই শুতাম, যদিও জানলা বন্ধ রাখতাম। একরাতে, প্রচন্ড গরম লাগছিলো, ঘেমে উঠেছি। বাধ্য হয়েই উঠে গিয়ে জানলা খুললাম। বাইরে সাদা জোছনা। জোছনার আলো আমার ঘর ভাসিয়ে নিলো। জানলার ওপাশেই তো আমবাগান, তাতে মুকুল আসতে শুরু করেছে। মুকুলের ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে চলে এলো ঘরে। আমি এসে বিছানায় শুয়েছি, এমন সময় কেউ ডাকলো, এই স্নেহা, এই।
আমি ভয়ানক চমকালাম। তাকিয়ে দেখি, সেই মুখটা। জানলার ওপাশ থেকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি চিৎকার করলাম। বাবা-মা ওঘর থেকে চলে এলেন। ভেবেছিলাম, মুখটা অদৃশ্য হবে, হলো না। বাবা মা দুজনেই দেখলেন মুখটা‌। বাবা পরদিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।’
গল্পটা শুনলাম। এর আগে স্নেহা এই গল্প করেনি। আমি বললাম, ‘এরপরই তুমি ঢাকায় চলে গেলে?’
‘হু।’
‘আর দেখোনি মুখটা?’
‘না।’
‘ছেলেটা কে?’
স্নেহা ভয়ানক চমকে উঠে বললো, ‘কোন ছেলে?’
‘যে ছেলেটার মুখ দেখতে পেতে জানালায়।’
স্নেহা চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর বললো, ‘আমার সাথেই পড়তো। পেছনে ঘুরঘুর করতো, পাত্তা দিতাম না।’
‘মারা গিয়েছিলো কি এই আমবাগানেই?’
‘হু। সুইসাইড করেছিলো। সকালে উঠে জানলা দিয়ে আমিই প্রথম আমবাগানে ওর লাশ ঝুলতে দেখি।’
আমি স্নেহাকে ধরে বললাম, ‘দেখো, তুমি এতোদিন যা দেখেছো, সবই হ্যালুসিনেশন। ছেলেটা মারা যাওয়ায় এক তীব্র অপরাধবোধ তোমায় পেয়ে বসে। তুমি নিজেকে ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে থাকো। সেই অপরাধবোধই এই জানালায় ছেলেটার এক অলীক ছবি তোমার মনে তৈরি করে। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো?’
‘পারছি।’
‘কোনো প্রশ্ন?’
‘তাহলে বাবা-মা কাকে দেখেছিলেন? ওকে না দেখলে বাবা হার্ট অ্যাটাকই বা করলেন কেন?’
‘বাবা-মা কাউকেই দেখেননি। দেখলে, মা নিজেই আমাকে এ গল্পটা বলতেন, জানলা খুলতে নিষেধ করতেন। তিনি তা করেননি। আর বাবার মৃত্যুটা ছিলো স্বাভাবিক। সে বয়সে যে কারোরই অমন হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।’
স্নেহা কিছু বললো না। মাথা নিচু করে কি যেন ভাবতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম স্নেহাকে, ‘তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করেছো?’
‘করেছি।’
‘জানালাটা তবে খুলি?’
স্নেহা একটু ইতস্তত করে বললো, ‘খুলো।’
জানালাটা আমি খুললাম। একরাশ ঠান্ডা বাতাস এসে আমার দেহ জুড়িয়ে দিলো। জানালাটা আবার বন্ধ করে এসে উঠে বসলাম বিছানায়।
স্নেহা বললো, ‘জানালা লাগালে কেন?’
‘এমনি। জানালা খোলা রাখলে তোমার মনের ওপর চাপ পড়তে পারে। ওটা বন্ধই থাক।’
স্নেহা শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো। কেমন নির্ভার, নিশ্চিন্ত লাগছে ওকে‌ দেখতে। যেন অনেকদিনের বয়ে বেড়ানো ভারি এক বোঝা মাথা থেকে ফেলতে পেরে প্রশান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।এদিকে, আমি জেগে রইলাম সারারাত। আতঙ্কে আমার ঘুম এলো না। ভাগ্য ভালো, আজই আমার ছুটির শেষদিন। কালই রওনা দিবো ঢাকা‌। এরপর, আর কখনো আসবো না এখানে। আসলেও, এ ঘরে উঠবো না আর।
জানালা খোলার সময়, জানালায় একটা মুখ দেখতে পেয়েছিলাম আমি‌। একটা ছেলের মুখ। আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ংকরভাবে হাসছিলো‌ সে। অমন ভয়ংকর একটা মুখ আমি আর কখনো দেখিনি।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প