বৃষ্টি ঝরছিল হালকা হালকা। কলকাতার আকাশ আজ একটু বেশিই বিষণ্ণ। নিশার চোখের কোণেও যেন সেই একই রঙ, কিছুটা ধোঁয়াশা, কিছুটা ক্লান্তি।
এটাই প্রথম দিন নতুন শহরে। নতুন কাজ, নতুন ঠিকানা। কলেজ শেষ করে চাকরির খোঁজে ছুটতে ছুটতে আজ সে এসেছেও ঠিকই, তবে মনটা যেন পড়ে আছে পুরনো ছোট্ট শহরের রেলস্টেশনটার ওপারে, যেখানে শেষবার ‘বিদায়’ বলেছিল এক অদ্ভুত অনুভবকে।
ফ্ল্যাটটা বেশ ছোট, কিন্তু সাজানো-গোছানো। একরুমের এই ঘরটায় নিশুর জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু হবে—এটাই ভেবেই সে ব্যাগটা খালি করছিল। হঠাৎ করেই ফোনটা কাঁপতে শুরু করলো।
“মা কল করছে,” নিশু একটু হাসলো। ফোনটা ধরতেই মা বলে উঠলেন—
“সব ঠিক আছে তো? বাসায় পৌঁছেছিস? খেয়েছিস কিছু?”
“হ্যাঁ মা, ঠিক আছি। খাবো একটু পর। তোমার মতো কেউ তো আর মুঠো ভরে খাবার গুঁজে দেয় না এখানে,” নিশু হেসে বলল।
কথা শেষ হতেই দরজায় টুং টাং শব্দ। কেউ বেল বাজিয়েছে।
নিশু দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে এক ছেলেকে দেখে থমকে গেল।
ছেলেটা হালকা উঁচু গড়ন, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, গায়ে সাদা টি-শার্ট আর জিন্স। হাতে ছোট একটা টিফিন ক্যারিয়ার।
“তুমি নতুন এসেছো না?” ছেলেটা বলল।
“হ্যাঁ, আজকেই এলাম। কিন্তু তুমি…?” নিশু একটু দ্বিধায় পড়ে।
“আমি অভিরূপ। পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। পিসি থাকেন না, ওনার ফ্ল্যাটে সাবলেটেই থাকি। আজ পিসিমা বললেন নতুন মেয়ে এসেছে, একা থাকবে, তো ভাবলাম একটু হ্যালো বলে যাই।”
“ওহ, ধন্যবাদ… মানে ভদ্রতা রক্ষার্থে বলছো বুঝি?”
ছেলেটা হেসে ফেললো। “তেমন কিছু না। নতুন শহরে কাউকে না চিনলে কেমন লাগে আমি জানি। এটা তোমার জন্য, খিচুড়ি আর পটল ভাজা। বাড়ির খাবার বলতে পারো।”
নিশু একটু থতমত খেয়ে গেল। এমন আন্তরিকতা এত দ্রুত? তবে অভির চোখের মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত স্বচ্ছতা, যেটা মন চাইলে বিশ্বাস করে ফেলে।
“ধন্যবাদ… আমি নিশু।”
“নিশু… সুন্দর নাম। রাখবো তাহলে। খাবার ঠান্ডা হওয়ার আগে খেয়ে ফেলো। আর হ্যাঁ, কোনো কিছু দরকার হলে ডেকে নিও।”
অভি চলে গেল। নিশু জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকটা দেখলো। একটা প্রশ্ন উঁকি দিল মাথায়—কেন জানি না, অভির চোখে আজ একটা খুব চেনা অভিব্যক্তি ছিল।
হালকা বৃষ্টির মাঝে নিশু প্রথমবারের মতো কলকাতার আকাশের দিকে তাকালো। হ্যাঁ, শহরটা নতুন, কিন্তু আজ যেন একটু একটু করে আপন হতে শুরু করলো।
রাতের খাবার হিসেবে অভির দেয়া খিচুড়ি খেতে খেতেই নিশু নিজের মনের মধ্যে একটা নরম কাগজে নামটা লিখলো—”অভি”।
ঠিক কীভাবে সেই নামটা মনে গেঁথে যাচ্ছে, সেটা তখনও সে জানতো না।
তবে এটাই ছিল শুরু, সেই গল্পের যেটা থেমে যাবে অনেক বাঁকে, অনেক ভুলে, আবার ফিরে আসবে এক ভোরবেলায়।