যেমনটা আমি ভাবছি, তেমনটা ঠিক হলো না। হঠাৎ করেই আমার বিয়েটা হয়ে গেলো। পাত্র বাবার পছন্দ হয়েছিলো, ভালো চাকরি করা অনেক গুণসম্পন্ন পাত্র, একে বাবা আর হাতছাড়া করতে চাইলেন না। আমার মাস্টার্সের পরীক্ষার একদিন আগেই আমার বিয়েটা দিয়ে দিলেন।
বিয়ে নিয়ে আমার আফসোস ছিলো না। বিয়ের পরপরই বাবার বাড়িতে চলে এসেছিলাম, সেখানে থেকেই পরীক্ষা দিলাম। একটা মাস আমার পরীক্ষা চললো, আমার বর আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মাঝেমাঝে ফোন করে আমার খোঁজখবর নিচ্ছিলো ঠিক, কিন্তু যেহেতু বাবার বাড়িতেই আছি, বিয়ে যে হয়ে গেছে আমার ব্যাপারটা মনেই হচ্ছিলো না। একমাস পর আমার পরীক্ষা শেষ হলো। আমিও আবার যাত্রা করলাম আমার শ্বশুরবাড়িতে।
শ্বশুরবাড়িতে সেদিন আমার প্রথম রাত। সাহিল যখন প্রথম ঘরে ঢুকলো, সত্যিই বলছি, কেমন একটু ভয় ভয় করছিলো আমার। ও একদম নতুন মানুষ না আমার কাছে, একটা মাস ফোনে একটু আধটু কথা হয়েছে, ভয়টা তো আর থাকার কথা না। কিন্তু তবুও কেন যেন ভয় লাগছিলো। সাহিল যখন এসে আমার পাশে বসলো, আমার ভয়টাও তখন একদম তুঙ্গে।
কিন্তু আমাকে প্রচন্ড রকম অবাক করে দিয়ে সাহিল বললো, ‘চলো, ঘুমিয়ে পড়ি।’ বলেই সে শুয়ে ভোসভোস করে নাক ডাকতে লাগলো। ঘড়িতে তখন মাত্র পৌনে এগারোটা বাজে।
আমার কিন্তু অবাক হবার কথা ছিলো না। সাহিল ব্যাপারটা আমাকে আগেই জানিয়েছিলো। ফোনে বারবার করে বলেছিলো, ‘শুনো মিনু, আমার কিন্তু একটা অভ্যাস আছে। বদভ্যাসও বলতে পারো। আমি কিন্তু রাত এগারোটার আগেই ঘুমিয়ে যাই, কেউ আমাকে জাগিয়ে রাখতে পারে না। তোমার কিন্তু ব্যাপারটার সাথে মানিয়ে চলতে হবে।’
আমি তখন বলেছিলাম, ‘আচ্ছা।’ এমন অভ্যাস তো মানুষের থাকেই, তার সাথে মানিয়ে চলা কোন ব্যাপার না। আমি অবশ্য একটু রাত জাগি। সমস্যা নাই। মানিয়ে চলতে পারবো সাহিলের সাথে।
কিন্তু আমাদের প্রথম রাতেই যে ও পড়ে পড়ে এভাবে ঘুমাবে, এটা কে জানতো? এমন রাত কি কখনো আমাদের জীবনে আসবে? আমার না খারাপ লাগছিলো, খুব খারাপ। সে রাতটা মোবাইল চালিয়ে চালিয়ে পার করে দিলাম। আমার প্রিয় একটা সিরিয়াল দেখছিলাম ইউটিউবে। সিরিয়ালটা আপনা আপনি চলছিলো। কি যে হচ্ছিলো, আমার মাথায় ঢুকছিলো না। মন খারাপ ব্যাপারটা আমার পুরো অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো।
পরের কয়েকদিনে আমি ওদের পরিবারের সাথে খুব সুন্দরভাবে মানিয়ে নিলাম। সাহিলের বাবা মা, মানে আমার শ্বশুর শাশুড়ি খুবই চমৎকার মানুষ। আমাকে একদম তাদের নিজেদের মেয়ের মতোই মনে করেন। তাদের অবশ্য এক মেয়ে আছে, মাইশা। ও একদম আমার ন্যাওটা হয়ে গেলো। সাহিলের সাথে থাকার সময়টুকু বাদে বাকি পুরোটা সময় সে শুধু আমার পিছে পিছেই ঘোরে।
সবই ঠিক চলছিলো। তবে সাহিলের এই রাত এগারোটার আগে ঘুমানোর ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। ওদের পরিবারের অন্যান্যরা কিন্তু স্বাভাবিক সময়েই ঘুমায়। মানে এগারোটা, বারোটা, প্রয়োজন পড়লে একটা দুইটা। আর মাইশা তো আমার মতো রাতের প্যাচা। তবুও সাহিলের এই অভ্যাসটা কেন হলো, ধরতে পারলাম না। ওকে বেশ কয়েকবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও কোনো উত্তর দেয়নি।
আমার বড়বোনের মেয়ের জন্মদিন। আমার পুরো শ্বশুড়বাড়িকে দাওয়াত করেছে। মাইশার ঐসময় পরীক্ষা চলছে, ও যেতে পারলো না। ওর জন্য আমার শ্বশুর-শাশুড়িও গেলেন না, আমি আর সাহিলই গেলাম শুধু। জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হতে একটু দেরি হচ্ছিলো। দুলাভাই কেকের অর্ডার আনতে গিয়ে দেখেন কেক তখনো বানানো হয়নি, তাই নিজে থেকে বসে বসে বানিয়ে আনছেন। সাড়ে নটার মতো বেজে গেছে, দশটার দিকেই খাওয়া দাওয়া শুরু হবে। এর মধ্যেই সাহিল বললো, ‘চলো।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আর একটু থাকি। কেকটা কেটে যাই।’
‘না, কেক আনতে অনেক দেরি হবে।রাত এগারোটার আগেই ঘুমাতে হবে। চলো।’
‘একটু দেরি হলে কি হবে একদিন।নাহয় আজকে এগারোটার পরেই ঘুমাবা। একটু থাকো।’
‘না। এগারোটার আগেই ঘুমাতে হবে আজকে।’
‘তাইলে এখানেই ঘুমাবা। সকাল সকাল উঠে বাসায় চলে যাবো।’
‘না, এখানে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম হবে না।’
আমি যতোই জোর করতে থাকি, সাহিল শুনে না। শেষে আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘তোমার এতোই যদি যাওয়ার ইচ্ছা থাকে তুমি চলে যাও। আমার ভাগ্নির জন্মদিন, ও একদম আমার নিজের মেয়ের মতো।ওর কেক না কেটে আমি কোথাও যাবো না।’
সাহিল আমাকে প্রচন্ড অবাক করে দিয়ে আমাকে রেখেই চলে গেলো। আমার যে কি খারাপ লাগলো তখন। এতো এতো আত্মীয়-স্বজন।সবাই জিজ্ঞেস করছে জামাই কেন চলে গেলো। সত্যি কথা তো বলা যায় না। তাই বলে দিলাম ওর একটা জরুরী কাজ আছে অফিসে ভোরবেলায়। রাতে আগে আগে ঘুমানো দরকার। তাই চলে গেছে।
পরদিন আমি আর আমার শ্বশুরবাড়িতে গেলাম না।সাহিল ফোনের পর ফোন দিতে লাগলো। আমি ওর ফোন ধরলামই না। দুপুরের দিকে উল্টো ফোন বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকলাম।
সাহিল এলো বিকেলে। অফিস শেষ করে দৌড়ে দৌড়ে এসেছে।এসেই বললো, ‘প্লিজ রাগ করে থেকো না। বাসায় চলো। তুমি না থাকলে ভালো লাগে না।’
আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘ঢঙ করবা না। এতোই যদি আমাকে ছাড়া ভালো না লাগে, তাহলে আমাকে ফেলে চলে গেছিলা কেন কালকে রাতে?’
‘তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না।’
‘কি বুঝতে পারছি না? তুমি বুঝালেই বুঝবো।’
‘তুমি হাসবা।’
‘আমি হাসি, কাঁদি, যা ইচ্ছা তাই করি। তুমি বলো।’
‘তাহলে বাসায় গিয়ে বলি।’
‘না। এখানেই বলো।’
সাহিল অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বললো, ‘আমি রাত এগারোটার পরে জাগলে কারা যেন আসে।’
আমি ওর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়?’
‘কারা যেন আসে।’
‘কে আসে? চোর?’
‘না, চোর না। মানুষ না। ওরা অন্যকিছু।’
আমি হাসবো না কাঁদবো সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না। কি বলে এসব ও? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এ ধরনের কথাবার্তা বলছে, ভাবা যায়?
‘তুমি কি সত্যিই বলছো? আমার সাথে ফাজলামি করছো না?’
‘না। ফাজলামি কেন করবো?’
‘কেন আসে ওরা?’
‘জানি না।’
‘কবে থেকে আসে?’
‘অনেক আগে থেকে।’
‘পুরো ব্যাপারটা বলো তো। আমি বুঝতে পারছি না।’
‘তোমাকে পুরো ব্যাপারই বলছি। আমি তখন খুব ছোট। আমার দাদি তখন বেঁচে ছিলেন। দাদির সাথেই ঘুমাতাম আমি। দাদি অনেক গল্প বলতেন, বেশিরভাগই ভূতের গল্প। গল্পগুলো শুনতে শুনতে রাত হয়ে যেত। আমি ঘুমাতে চাইতাম না। সকালে স্কুলের জন্য উঠতে দেরি হয়ে যেত। আব্বু আম্মু এজন্য খুব বকাবকি করতো।’
‘তারপর?’
‘তারপর একরাতে এমন গল্প শুনছিলাম। একটা গল্প শেষ হবার পর আমি বায়না করলাম আরো গল্প শুনবো। দাদি কিছুতেই শুনাবেন না। আমিও নাছোড়বান্দা, না শুনে ঘুমাবো না। শেষমেষ দাদি বললেন, ‘তুমি যদি তাড়াতাড়ি না ঘুমাও, তাহলে কিন্তু ওরা আসবে।’
‘কারা আসবে?’
‘আমি এতোদিন যাদের গল্প বলেছি, তারা।’
আমি হেসে ফেলে বললাম, ‘মজা করছো দাদি?’
দাদি বললো, ‘না, মজা করছি না।দেখবি, ওরা আসবে।’ বলেই দাদি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বিড়বিড় করে কি বললো। কি যে কতগুলা শব্দ, আমি বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করেই দেখলাম, আমার বিছানার চারপাশে অনেকগুলো লোক। তাদের কি বিভৎস সব চেহারা। আমি চিৎকার করে দাদিকে জড়িয়ে ধরলাম।
এরপর থেকে যখনই রাত জাগি, আমি লোকগুলোকে দেখি।’
আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘রাত এগারোটার পর ঘুমানো নিয়ে তোমার শুচিবাই আছে, সত্যি কথাই বলো। এসব গালগল্প করছো কেন?’
‘না, বিশ্বাস করো, আমি সত্যি কথা বলছি। আমার সাথে এমনই হয় রাত এগারোটার পর জাগলে।’
আমি তখনই শাশুড়িকে ফোন দিলাম, ‘মা, সাহিল রাত এগারোটার পর জাগলে নাকি জ্বীন-ভূত দেখে, আপনি কি এইটা জানেন?’
মা অবাক হয়ে বললো, ‘না তো মা। এমন কিছু তো শুনি নাই। আজব, কে বলে তোমাকে এগুলা?’
সাহিল আমার কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে বললো, ‘তুমি আম্মাকে ফোন দিলা কেন? আব্বা আম্মা জানে না এসব।’
‘তুমি এসব গালগল্প আমার সামনে বসে বানালে, তারা কি করে জানবে? তুমি এমন সব মিথ্যা কথা আমাকে বলতে পারলা সাহিল? আমি কি বোকা? আজকে তোমার সাথে আমি এমনিই যেতাম। কিন্তু যাবো না। তোমার এই মিথ্যা কথা বলার জন্যই যাবো না।’
সাহিল অনেক অনুনয় বিনয় করলো, কিন্তু আমি শুনলাম না। সাহিলের এই অদ্ভুত বদভ্যাস অনেক সহ্য করেছি, আর না। সেও জানুক, আমি কেমন মেয়ে।
সাহিল চলে গেলো। কিন্তু পরদিন আবার এলো। বললো, ‘প্লিজ চলো। আমি এমন কথা আর বলবো না।’
‘একটা শর্তে যেতে পারি। তুমি আজকে রাত একটা পর্যন্ত জেগে থাকবা আমার সাথে।’
‘ঠিক আছে, থাকবো। এখন চলো।’
সাহিলের সাথে ওদের বাসায় ফিরে গেলাম। আমি মোটামুটি প্রিপারেশন নিয়ে ফেললাম, রাত একটা বললেও তিনটা পর্যন্ত সাহিলকে জাগিয়ে রাখবো। আমাকে অবাক করে দিয়ে সাহিল সাড়ে দশটাতেই বিছানায় শুয়ে পড়লো।
আমি বললাম, ‘এসব কি?’
সাহিল বললো, ‘প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দাও। ওরা চলে আসবে। ওদের মুখোমুখি আর আমি হতে চাই না।’
‘না। তুমি আমাকে কথা দিয়েছো। রাত একটা পর্যন্ত জাগবে।’
‘প্লিজ, আমি পারবো না। তুমি একটু দয়া করো।’
‘না। তুমি প্রমিজ করে আমাকে নিয়ে এসেছো। কিছুতেই রাত একটার আগে ঘুমাতে পারবা না।’
আমি সাহিলকে জাগিয়ে রাখলাম। ও চোখ বন্ধ করলেই ধরে জোরে জোরে ঝাঁকি দেই। রাত এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই ওর মুখ চোখ কুঁকড়ে গেলো ভয়ে। বারবার আমার হাত ধরে বলতে লাগলো, ‘প্লিজ মিনু, প্লিজ। এসব দেখলে আমি থাকতে পারবো না। তুমি প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দাও।’
আমি আর ওকে বাধা দিলাম না। ও ঘুমিয়ে পড়লো। আমি রুম থেকে বেরুলাম। দেখলাম, মা রান্নাঘরে। আমাকে দেখেই অবাক হয়ে বললেন, ‘কি মা? তোমরা ঘুমাওনি।’
আমি কাঁদতে কাঁদতে মাকে সব কথা বলে দিলাম। মা ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, ‘ওর যে এমন সমস্যা, আমাকে তো কখনো বলেনি। আমি তো ভাবতাম রুটিন মেইনটেইন করে চলে বলে ও এমন তাড়াতাড়ি ঘুমায়।’
আমি বললাম, ‘না মা। রুটিনের ব্যাপার না।’
মা বললেন, ‘ও যে দাদির কথা বললো, আমার শাশুড়িমা নিজেই তো রাত বারোটার পরে ঘুমাতেন। এমন কিছু তো তার কাছেও শুনি নাই?’
আমি বললাম, ‘আপনার শাশুড়ি কি এমন জ্বীন ভূত আনতে পারতেন?’
মা হেসে ফেলে বললেন, ‘ধুর বোকা। এমন হয় নাকি। তবে শুনেছিলাম, আমার শাশুড়ির বাবা নাকি ওঝা টাইপ ছিলো, কি কি ঝাড়ফুঁক করে বেড়াতো। ঐ বাড়িতে আমার শ্বশুরের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো না। শুধু আমার শাশুড়িমা দেখতে ভীষণ সুন্দর ছিলেন, তাই বিয়েটা হয়েছিলো।’
‘মা। সাহিলকে ডাক্তার দেখানো লাগবে।’
মা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘এই সামান্য বিষয়ে ডাক্তার কেন দেখাবা? ও কি পাগল?’
‘পাগল তো বলি নাই। হয়তো কিছু সমস্যা আছে। এজন্যই ডাক্তার দেখানো।’
‘না। ওকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার দরকার নাই। ও এমনি ভালো হয়ে যাবে।’
আমার শাশুড়ি পরের কয়েকটা দিন ছেলেকে নিয়ে পড়লেন। যেকোন ভাবেই হোক তিনি ছেলেকে রাত এগারোটার পর জাগিয়ে রাখবেন। লাভ হলো না। সাহিল দশটা বাজার আগেই ঘুমিয়ে যেতে লাগলো।
আমি বুঝলাম এভাবে হবে না। আপুর সাথে কথা বলে ওকে একজন ডাক্তার দেখিয়েই ফেললাম, যদিও শ্বশুরবাড়ির কেউ জানলো না। ডাক্তার সব শুনে বললেন, ‘ব্যাপার না। ছোটবেলায় দাদির কাছে শোনা ভয়ের গল্পগুলো তার মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলেছে। তাই তিনি সে সব কিছু বাস্তবে দেখছেন। কয়েকটা সেশন করা লাগবে। প্রতি মাসে প্রথম ও তৃতীয় শুক্রবার আসবেন আমার চেম্বারে। আর কয়েকটা অ্যান্টি-ডিপ্রেসিং মেডিসিন দিচ্ছি, নিয়মিত খাবেন।’
সাহিল বললো, ‘আমার তো ডিপ্রেশন নেই।’
‘অবশ্যই আছে। সবকিছুর শুরুই ডিপ্রেশন থেকে। আরেকটা ব্যাপার, ছোটবেলায় কোনো ঘটনার জন্য কি আপনি ভয় পেয়েছিলেন? যেটার রেশ এখনো আপনার মনে রয়ে গেছে।’
সাহিল বললো, ‘না তো।’
‘চিন্তা করেন। ভালো করে চিন্তা করেন। আপনি তো আপনার দাদির সাথেই শুতেন, তাই না? তার সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিলো? তিনি কি আপনার সাথে কোনো ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট ব্যবহার করেছিলেন?’
সাহিল ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতে হতে বললো, ‘খবরদার যদি আর কোনোদিন তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসছো।’
সাহিলকে যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসছি, ব্যাপারটা কেন যেন চাপা থাকলো না। সবাই যেনে গেলো। আমার চাচি ফোন দিয়ে আমাকে বললো, ‘এই মিনু, তোর জামাইয়ের নাকি মাথায় সমস্যা? রাত এগারোটার পর নাকি সমস্যা বাড়ে? সে নাকি পাগলের মতো সব জিনিসপাতি ভাঙে, আর তোকে মারধর করে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘না তো, এইসব কে বলেছে তোমাকে?’
‘ওহ। বাঁচলাম। অবশ্য কিছু মনে করিস না, তোর জামাইকে আমার এমনি একটু কেমন কেমন লাগে। ঐদিন যেভাবে বের হয়ে গেলো জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে।’
আরেকদিন আমার এক দুঃসম্পর্কের খালা, যার সাথে আমার অনেকদিন কথা হয় না, তিনি রাজশাহী থেকে ফোন করে বললেন, ‘কিরে মিনু, এসব কি শুনি। রাত বারোটার পর নাকি তোর জামাইয়ের কাছে জ্বীন মেয়ের রুপ ধরে আসে। তোর সামনেই নাকি ওরা মেলামেশা করে।’
আমি বললাম, ‘ছি ছি খালা, এইসব কথা আপনি বিশ্বাসও করেছেন?’
খালা লজ্জায় যে ফোন রেখে দিলেন, আর ফোনই করলেন না।
আমার শ্বশরবাড়িও ব্যাপারটা জেনে ফেললো।শাশুড়ি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোমাকে এতো করে মানা করলাম, তাও তুমি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে কোন সাহসে? আমাকে একটুও জানানোর প্রয়োজনও মনে করলে না?’
আমি বললাম, ‘জানালে তো আপনারা নিতে দিতেন না।’
‘তাই বলে তুমি কথা অমান্য করলে? কেমন মেয়ে তুমি? তোমার বাবা মার সাথে আজকেই কথা বলছি।’
আব্বু আম্মুও সেদিন বাসায় চলে এসেছেন। তারাও একদম তেলে বেগুনে জ্বলে ভাজাভাজা অবস্থা। তারা প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের মেয়ের কি দোষ? সে তো ঠিকই করেছে, ছেলের সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখিয়েছে। দোষ তো পুরোপুরি আপনাদের। ছেলের মানসিক সমস্যা আছে, না জানিয়েই আমাদের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছেন।’
শ্বশুর রেগে গিয়ে বললেন, ‘দেখেন, বুঝে শুনে কথা বলেন। আপনার মেয়ে আসার পর থেকেই ছেলের মাথায় সমস্যার কথা শুনেছি। এর আগে তো ও ভালোই ছিলো।’
‘তার মানে ওর মাথায় সমস্যা হয়েছে আমাদের মেয়ের জন্য?’
‘হ্যাঁ।’
‘এতো বড় কথা। আমরা নিয়ে যাই আমাদের মেয়েকে। পাগল ছেলের সাথে সংসার করার দরকার নাই।’
‘যান যান নিয়ে যান। ছেলের মাথাটা খারাপ হয়েছে আপনার মেয়ের জন্য। ও গেলে ছেলেটা বাঁচবে।’
এই ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে সাহিল চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। একটা কথাও বলছিলো না। আমি সবাইকে বললাম, ‘প্লিজ, একটু আমার কথা শোনেন।’
সবাই আমার দিকে তাকালো।
আমি বললাম, ‘আজকে রাতটা শুধু আমাকে সময় দেন। আজকে রাতে আমি সাহিলের সাথে থাকবো। ওকে রাত এগারোটার পরও জাগিয়ে রাখবো। আমি ওর কাছে প্রমাণ করে দিবো ও যেসব জিনিস দেখছে তা কেবল ওর মনের কল্পনা। প্লিজ, একটা রাত সময় দেন আমাকে।’
আব্বু বললো, ‘লাভ হবে না। চিকিৎসা ছাড়া ও ভালো হবে না। তুই একটা রাত থাকতে চাচ্ছিস থাক। ও তো এগারোটার পরই ঘুমিয়ে পড়বে, এরপর তুই ব্যাগ গুছায়ে ফেলিস। আমি কালকে সকালে এসেই তোকে নিয়ে যাবো।’
রাত পৌনে এগারোটা। আমি আর সাহিল বসে আছি আমাদের ঘরে, চুপচাপ। আর কেউ নাই। আমি সাহিলকে বললাম, ‘সাহিল, তুমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, আমি জানি জানি। আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।’
সাহিল আমার দিকে তাকালো। ওর চোখে পানি।
আমি বললাম, ‘প্লিজ, আজকের দিনটা আমায় সাহায্য করো। আমি প্রমাণ করে দিবো যে ভূত প্রেত কিছু নাই। সব তোমার মনের কল্পনা। তোমার দাদি এক অলীক ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো তোমার মনে।’
সাহিল নীরবে মাথা নাড়লো। আমরা দুজনে বসে আছি চুপচাপ।ঘড়ির কাটা রাত এগারোটার দিকে এগোচ্ছে। আমি নীরবে তাকিয়ে আছি সাহিলের দিকে। ওর মুখটা আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে। ভয়ের একটা ছাপ ফুটে উঠছে তার মুখে।
ঘড়ির কাটা রাত এগারোটা পেরোলো। সাহিল চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
এগারোটা পাঁচ, এগারোটা দশ। আমাদের ঘরে আর কিচ্ছু আসেনি, কেবল আমরা দুজন। আর কেউ নেই। চারদিক সুনসান, নিস্তব্ধ। যেন বিশ্ব চরাচরে আমরা দুজন বাদে আর কেউ নেই। আমাদের নিঃশ্বাসের শব্দই রয়েছে শুধু আমাদের ঘরটায়। আর ঘড়ির টিকটিক।
এগারোটা পনের। এগারোটা বিশ।
সাহিল চোখ মেললো। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। ওর চোখে ভয়ের রেশ কেটে যাচ্ছে।
আমি বললাম, ‘সাহিল, দেখলে তো, সত্যিই কিছু নেই। সব তোমার মনের কল্পনা।’
সাহিল মাথা নিচু করে বললো, ‘আমি যে দেখতাম?’
‘শুধু তুমিই দেখতে, না তোমার দাদিও দেখতেন?’
‘দাদিও দেখতো।’
‘ভুল। তোমার দাদি দেখতেন না। তিনি কিন্তু রাত জাগতেন। তোমার মা দেখেছে।’
‘দাদি দোয়া জানতেন।যেই দোয়া পড়লে ওরা চলে যায়।’
‘সেই দোয়া দাদি তোমাকে শিখান নাই কেন?’
‘শিখাতে চেয়েছিলেন।’
‘তুমি শেখো নাই কেন?’
‘যেদিন দোয়া শেখাবেন বলেছিলেন, সেদিন তিনি মারা যান।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো সাহিল। তোমার দাদি অমন কোনো দোয়া জানতেন না। কারণ অমন কোনো দোয়া নেই। কিছু আসতোই না তোমার কাছে, যা আসতো সব তোমার মনে মনে। তুমি বড়বেলায় কখনো ওদের দেখেছো?’
‘না। শেষ দেখেছিলাম ক্লাস টেনে থাকতে। এসএসসি পরীক্ষার দুদিন আগে, রাত জেগে পড়ার সময়।’
‘ঠিক এটাই। সেসময় পরীক্ষার টেনশনে তোমার মন দুর্বল ছিলো, তাই এসব উল্টোপাল্টা দেখেছো। এসব কিচ্ছু নেই। দেখলেই তো। এতোক্ষণ আমরা জেগে বসে আছি, কিচ্ছু এলো না।’
সাহিল চুপ করে আছে। বুঝলাম, আমার কথা ওর মনে প্রভাব ফেলছে।
আমি সাহিলের হাত ধরলাম। ধরে বসে থাকলাম চুপচাপ।ঘড়ির কাটা এগুতে লাগলো। রাত সাড়ে এগারোটা। এগারোটা চল্লিশ।
সাহিল বললো, ‘ঘুমাবে না?’
‘না। আমাদের বিয়ের প্রথম রাতটা আমরা জাগতে পারিনি। আজ জাগবো। সারারাত গল্প করবো।’
সাহিল তাকালো আমার দিকে। ওর মুখে হাসি। হাসিটা কি ভীষণ সুন্দর। আমার খুব করে প্রেমে পড়লাম ছেলেটার।
সাহিল বললো, ‘একটু তোমার হাত ধরে বসে থাকি। ভালো লাগছে।’
‘থাকো। সমস্যা কোথায়। সারারাত বসে থাকো। আজ সারারাত শুধু আমাদের।’
সাহিল আর আমি একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছি। সময় যেন থমকে গেছে।
‘সাহিল।’
‘হু।’
‘ভয় কেটেছে?’
‘হু।’
‘কালকে তাহলে আমি চলে যাই।’
‘না। তুমি যেতে পারবে না।’
‘বাবা নিয়ে যাবে তো।’
‘আমি যেতে দিবো না।’
‘বাবার সামনে দাঁড়াতে পারবে?’
‘পারবো।’
‘বাহ। বীরপুরুষ। তো বীরপুরুষ আমার, এবার আমার সাথে গল্প করুন।’
‘কি গল্প।’
‘যা ইচ্ছে তাই। তোমার গল্প, তোমার ছোটবেলার গল্প। দাদির গল্প।’
‘দাদির গল্প? দাদি অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর গল্প বলতেন। মরা মানুষ উঠে আসার গল্প। লাশ উধাও হয়ে যাওয়ার গল্প। সব গল্প নাকি সত্যি।’
‘ভূতের গল্প।’
‘হু।’
‘আমি ভূতের গল্পই শুনবো। আমরা হবো ইতিহাসের প্রথম দম্পতি যারা ভূতের গল্প বলে রাত কাটিয়েছে।’
‘তুমি গল্পগুলো দাদির কাছ থেকেই শুনতে পারবে।’
‘কি? কিভাবে?’
‘কারণ দাদি ফিরে এসেছেন।’
আমি ভাবলাম সাহিল মজা করছে। কিন্তু না, ওর মুখে মজা করার কোনো অনুভূতি নেই। সেখানে ভয়ের ছাপ। ওর পুরনো ভয়টা ফিরে এসেছে। ও তাকিয়ে আছে আমার পিছনের দিকে। ওর দেখাদেখি আমিও পিছে তাকালাম। যা দেখলাম, তাতে ভয়ে বিস্ময়ে আতংকে আমার সারা শরীর জমে গেলো।
আমি দেখলাম, এক বৃদ্ধ মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টি আমার দিকে। মুখটা কি ভয়ংকর!
আমি চিৎকার করে উঠলাম। এবং সাথে সাথেই আবিষ্কার করলাম, তিনি একা নন। তার সাথে আরো অনেকে আছে। অন্ধকার ঘরে কারা কার যেন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ঘিরে।
আমি সাহিলের দিকে তাকালাম। সেই কেবল আছে এখন আমাকে সাহায্য করার জন্য। ও বাদে আর ঘরে কোনো মানুষ নেই, আমি জানি। বাকি সব অন্যজগতের লোক।
কিন্তু সাহিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে আর নিজের মাঝে নেই। আমার দিকে তাকিয়ে আছে, একদৃষ্টিতে। ওর মুখটা হাসিহাসি। সেই মিষ্টি হাসিটা না। ভয়ংকর এক হাসি ঝুলে আছে তার মুখে।
সাহিলের সাথে সাথে ঘরের অন্যরাও হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি ভয়ংকর সবার চাহনি। আমি যে দরজা খুলে বাইরে বেরোবো, সেই সুযোগও নেই। ওরা পুরো ঘর জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমার বিছানা ঘিরে।
আমি চিৎকার দিলাম। মরণ চিৎকার। কিন্তু আমি জানি, এই চিৎকারে কোনো লাভ হবে না। আজকে পুরোটা রাত এই লোকগুলোর মাঝখানেই আমাকে বসে থাকতে হবে। সাহিল, ওর দাদি যিনি মারা গিয়েছিলেন, আর এই লোকগুলোর মাঝখানে। কারণ কেউ আমাকে বাঁচাতে আসবে না। এই ঘরের বাইরে পৃথিবীর কেউই আমার চিৎকারের শব্দ শুনতে পাবে না। আমি এখন একা, ভীষণ একা।
আমি বসে থাকি অন্ধকারে। অনেকগুলো লোক ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। যারা কেউ মানুষ নন।