লালাবাই

মা, রাতের বেলায় নানু গান শোনায় কেন?’
আমার ছোট ছেলেটার বয়স তিন। তিন বছর হলেও বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। একবছর বয়স থেকেই ও পটপট করে কথা বলতো, এই তিনবছর বয়সে তো কথা বলায় এক্সপার্ট হয়ে গেছে। কিন্তু কথা বলায় এক্সপার্ট হলে কি হবে, ও খুব দুষ্টু। রাতে ঘুমাতে চায় না। ওকে ঘুম পাড়াতে রীতিমতো আমাদের যুদ্ধ করতে হয়।
এই ঘুমাতে না যাওয়ার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো হঠাৎ করেই। ছোটটা হঠাৎ করেই দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে লাগলো‌। কেন যে এভাবে ও ঘুমাতে লাগলো, আমরা ভেবে পেলাম না। মনে হলো, নতুন বাসায় যে শিফট করেছি তিনদিন আগে, তারই প্রভাব এটা। নতুন পরিবেশে এসে ওর অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই রাত হলেই ঘুমিয়ে পড়ছে ছেলেটা।
বড়টা এবার কেজি ওয়ানে উঠলো। ওটা অবশ্য শান্ত, ছোটটার মতো দুষ্টু না। ওকে ঘুম পাড়ালেই ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে আর ছোটটাকে দুপাশে রেখে আমি আর চৈতি মাঝখানে শুই। ওদের ঘুম পাড়িয়ে নিজেরাও ঘুমিয়ে পড়ি। আমাদের এই চারজনের ছোট্ট ছিমছাম সংসারটা ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে খুব একটা দেরি হয় না।
তিনদিন আগে অফিস থেকে ফেরার পর দেখলাম চৈতির মুখে কেমন চিন্তার ছাপ। জিজ্ঞেস করতেই বললো, সাদাফ, মানে ছোটটাকে কি কথা বলতে বলতে নাকি জিজ্ঞেস করেছিলো ও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ছে কেন ইদানিং। ছোটটা নাকি তখন উপরের কথাটা বলেছে। রাতে ওর নানু গান শোনায়। তাই ও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে।
শুনে চৈতি খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। ওর এমন গম্ভীর চিন্তায় ভরা মুখ দেখে আমি ফিক করে হেসে ফেলি। চৈতি রেগে গিয়ে বলে, ‘এই, তুমি হাসো কেন?’
আমি হাসি চাপতে গিয়ে আরো জোরে হেসে ফেলি। চৈতি আরো রেগে গিয়ে বলে, ‘যা, তোর খাবার বন্ধ আজকে।’ রেগে গেলে আমরা মাঝে মাঝে তুই তুকারি করি। আবার প্রচন্ড ভালোবাসাবাসির মধ্যেও এমনটা হয়।
আমি হাসি থামিয়ে বলি, ‘ছোট বাচ্চার কথা শুনে এতো চিন্তার কি আছে বল তো। হয়তো রাতে কোথাও থেকে কিছু শুনে।’
‘কি শুনে?’
‘আরে আজিব, শব্দ শুনে। ঢাকা শহরে শব্দের অভাব আছে? সারাদিন সারারাতই দেখবা কোনো না কোনো বাসা থেকে লাউড স্পিকারে কেউ না কেউ গান শুনছে। তেমন কোনো শব্দই হয়তো পেয়েছে ও। পেয়ে ভাবছে নানুর গলার শব্দ।’
‘কিন্তু আমরা এই শব্দ শুনতে পাই না কেন?’
‘স্বাভাবিক। বাচ্চাদের শব্দ শোনার ফ্রিকুয়েন্সি রেঞ্জ বড়দের চাইতে বেশি। অনেক কম আর অনেক বেশি জোরের শব্দও তারা স্পষ্ট শুনতে পায়,যেটা আমরা পাই না। তেমন কিছুই হচ্ছে হয়তো। তুমি শুধু শুধু টেনশন করো না।’
চৈতি থামে। কিন্তু ওর মুখ দেখে আমি কিছু বুঝতে পারি না। হয়তো ও আমার কথা বিশ্বাস করেছে। হয়তো করেনি। কে জানে তা।
এক রাতে, চৈতি আর সাদাফ ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার চোখেও মোটামুটি ঘুম চলে এসেছে, ঘুমিয়ে পড়বো। এসময়ই সাদাত, মানে আমার বড় ছেলেটা প্রচন্ড জোরে আমাকে চেপে ধরে বলে, ‘বাবা, আমার ভয় করছে।’
আমি বলি, ‘কেন বাবা?’
‘কে যেন গান গাচ্ছে।’
‘কি বলো? গান কে গাবে?’
‘হ্যাঁ, আমি শুনতে পাচ্ছি। একটা বুড়ো মানুষের গলা। নানুর মতো। গান করছে। নানু ঘুমপাড়ানোর জন্য যেমন গান করতো না, ঠিক সেরকম।’
‘আচ্ছা। কোথায় গান গাচ্ছেন উনি?’
‘আমাদের পাশের ঘরটায়।’
ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেলো। আমাদের পাশের ঘরটায় কেউ থাকে না। ঐ ঘরটা ভীষণ শীতল। আর অন্ধকার।
আমি সাদাতকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘না বাবা, না। কেউ গান গাচ্ছে না। তুমি ঘুমাও।’
সাদাত তবুও ঘুমায় না। আমার বুকের মধ্যে ভয়ে কাঁপতে থাকে।
সকালে আমি চৈতিকে বলি, ‘সাদাফ কি সাদাতকে ওর গান শোনার গল্পটা বলেছে?’
চৈতি বলে, ‘বলেছে মনে হয়। দুই ভাই তো সারাদিন একসাথেই খেলে। এমন গল্প তো বলাবলি করতেই পারে দুজন।’
‘তাও ঠিক। আচ্ছা, আমি অফিসে যাই।’
সেদিন অফিস থেকে ফিরে দুভাইকে নিয়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলো তো, তোমরা দুজনেই কি রাতে গান শুনতে পাও?’
দুজন একসাথেই বললো, ‘হু।’
‘কি গান শুনতে পাও, বলো তো।’
‘নানু ঘুমপাড়ানি কতোগুলো গান শোনাতো না গুণগুণ করে, ঠিক তেমন গান।’
‘তোমরা তো জানো নানু আর গান শোনাতে পারবে না, তাই না?’
বড়টা মাথা নাড়ে। সে বোঝে। ছোটটা বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মৃত্যু বোঝার মতো বয়স তার হয়নি। তার নানু কেন একবছর ধরে তাদের বাসায় আসে না, এটা সে এখনো বোঝে না।
বড়টা আস্তে করে বলে, ‘ওটা নানুর গলা না। কিন্তু নানুর মতো গলা। ঐ গলায় গান শোনায়।’
‘গান কি পাশের রুম থেকেই শুনতে পাও?’
দু’জনেই মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, দুজনেই পাশের রুম থেকে গান শুনতে পায়।
চৈতি চমকে ওঠে। পাশের রুম থেকে গানের গলা আসার ব্যাপারটা সে জানতো না।
আমি দুভাইকেই বলি, ‘শুনো, এইটা কিন্তু পাশের রুম থেকে আসা কোনো শব্দ না। রাতের বেলা সব চুপচাপ থাকে তো, এইজন্য অনেক দূরের শব্দও অনেক কাছে‌ শোনা যায়। দূরের কোনো বাড়িতে রাতের বেলায় হয়তো কেউ গান করছে। আর সেই গানটাই তোমাদের নানুর গানের মতো লাগছে। আর মনে হচ্ছে গানটা গাচ্ছে তোমাদের পাশের রুম থেকে। ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নাই। আর আমি আর তোমার মা আছি না? আমরা থাকতে তোমাদের ভয় কি, বলো।’
শেষ কথাটা শুনেই বাচ্চারা আস্বস্ত হলো। ওদের কাছে আমরা মানে ওদের বাবা মা এখনো সুপারহিরো। ওদের যেকোন বিপদ আপদ থেকে তারা রক্ষা করবে, ওদের যেকোন সমস্যা তারাই সমাধান করে দিবেন। পৃথিবীর সব বাচ্চাদের কাছেই তাদের বাবা মা এমনই।
রাতে দুই ছেলেই নিশ্চিন্তে ঘুম দিলো। রাত যখন একটু গভীর হয়েছে, চৈতি তখন আমার কাছে ফিসফিস করে বললো, ‘পাশের রুম থেকে ওরা গান শুনতে পায়, বলোনি তো।’
‘আমিও জানতাম না। সাদাত বললো কালকে।’
‘ওহ আচ্ছা।’
চৈতি থামে। কিন্তু ওর কি যেন একটা বলার ইচ্ছা। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কিছু বলবা?’
‘একটা কথা বলতাম। তোমাকে কখনো বলা হয় নাই।’
‘কি কথা?’
‘খুব ছোটবেলায়, আমার যখন সাদাতদের মতো বয়স, তখন, মানে তখন আমিও সাদাতদের মতো একটা গানের শব্দ শুনতাম।’
আমি উঠে সোজা হয়ে বসে বললাম, ‘কি বলো?’
চৈতির মুখে কেমন একটা ভয় লাগা ভাব। ও ভয়ে ভয়ে বলে, ‘হ্যাঁ। আমাদের বাসার পাশের রুমটা অন্ধকার ছিলো। ঐ রুম থেকেই শব্দটা পেতাম।’
‘তুমি কি সাদাতদের এই গল্পটা বলেছো?’
‘হু, বলেছি।’
‘তাই ওরা এসব কথাবার্তা কল্পনা করছে। ছোটবেলায় আমরাও কল্পনায় আর স্বপ্নে অনেক কিছু দেখি। এসব কি সত্যি হয় চৈতি? তুমি বাচ্চাদের মনে এইসব ভয় ঢোকাও কেন?’
চৈতি বলে, ‘আমি ওদের সব কথা বলিনি।’
‘কি বলোনি?’
‘শব্দটা শুধু আমিই পেতাম না।’
‘তাহলে? কে পেতো?’
‘অনেকেই। অনেকেই পেয়েছে ঐ শব্দ। আমার মা, তার মা, তার মা, মানে আমাদের অনেক জেনারেশন ধরে এই শব্দ শুনতে পাওয়ার ব্যাপারটা চলে আসছে। কেন এই শব্দটা পাওয়া যায় আমরা জানি না। সবাই বলাবলি করতো, আমাদের পরিবারের ওপর কোনো একটা অভিশাপ আছে। অনেক অনেক বছর আগে কেউ একটা অভিশাপ দিয়েছিলো আমাদের। তাই আমাদের পরিবারের অনেকেই এই শব্দ শুনতে পায়।’
‘সবাই পায়?’
‘না। সবাই পায় না। আমার ছোটভাই যেমন কোনোদিন পায়নি। আমার খালা পাননি। কিন্তু মা পেয়েছিলেন।’
‘কি বলো।‌এইটা তো ভয়ংকর ব্যাপার। জানলে তো তোমাদের পরিবারে বিয়েই করতাম না।’
চৈতি রেগে গিয়ে বললো, ‘ফাজলামি করো না তো। এখন ফাজলামি করার মুড নাই।’
‘আচ্ছা, আর করবো না। কিন্তু টেনশন করো না। শুধু শব্দই তো শুনতে পাওয়া যায়। আর কিছু তো না। তাহলে সমস্যা কি। কেউ ফ্রিতে গান শুনিয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা ভালো না?’
চৈতি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লো। আর একটা কথাও বললো না।
পরদিন অফিস থেকে ফেরার পর দেখলাম আমাদের শোবার রুমের সামনে একটা তাবিজের মতো কি ঝোলানো যেন। আমি বললাম, ‘এসব কি?’
চৈতি বললো, ‘এইটা একটু রাখি কয়েকদিন। আজকে ছোটভাই এসে এটা দিয়ে গেছে। আমাদের বাসায় এটা ইউজ করা হয়, খারাপ কোনো জিনিস তাড়ানোর জন্য।’
‘এইসব আজেবাজে জিনিস আমার বাসায় টাঙাতে দিবো না। সরাও এটা, সরাও।’
‘প্লিজ, এমনটা করো না। কয়েকদিন থাকুক না। এরপর সরিয়ে ফেলবো।’
চৈতির মুখ দেখে আমি আর না করলাম না। ওর মুখটা ভীষণ কাতর। ওর এমন কাতর মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি। মনে হলো, ও কিছু একটা বলে নাই আমার কাছে। কিন্তু, কি সেটা?
সেদিন রাতে দুভাই-ই বললো, তারা আর শব্দটা শুনতে পাচ্ছে না। তাবিজটা তাহলে কি কাজে দিয়েছে? কে জানে? আমি তো এসব বিশ্বাস করি না। ঝড়ে বক মেরেছে মনে হয়। যেই মহিলাটা এতোদিন রাত জেগে গান-টান গাইতো, সে মনে হয় আজকে অসুস্থ, তাই গাইতে পারছে না। আর এটা তাবিজ ঝোলানোর ব্যাপারটার সাথে কাকতলীয়ভাবে মিলে গেছে। চৈতিকে অবশ্য বেশ খুশি খুশি লাগছে। রোসো বাবা, রোসো। কালকেই দেখবা ঐ মহিলা সুস্থ হয়ে আবার গান গাওয়া শুরু করেছে। আর তখন তোমার এই তাবিজের বুজরুকিও বের হয়ে যাবে।
রাতে আজকে আবার ছোটটা ঘুমাচ্ছে না। আগের মতোই বাঁদরামি করছে। বড়টা অবশ্য ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোটটার বাঁদরামিতে ঘুম আসছে না। আমি চৈতিকে বললাম, ‘তাবিজটা খুলে ফেল তো। তাবিজটার জন্য গান শোনা অফ হয়ে গেছে। সাদাফ একটু গান শুনে ঘুমাক।’
চৈতি বললো, ‘তুমি এখনো মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করো নাই। নাইলে তাবিজ নিয়ে এমন কথা বলতা না।’
‘বিশ্বাস করেছি দেখেই তো বলেছি। তাবিজ খুলে ফেললেই তো গান শুরু হয়ে যাবে। ছোটটা ঘুমিয়ে পড়বে। আমরাও একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবো।’
‘তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না।’
‘বুঝতে পারছি তো।‌ শুধু গান শুনলে তো আর ক্ষতি নাই। এমন তো না যে ঐ বুড়ি গান গেয়ে আমার বাচ্চাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো কোথাও নিয়ে যাবে।’
চৈতি আস্তে করে বললো, ‘হ্যাঁ, এমনটাই অনেকটা।’
‘মানে?’
‘মানে খারাপ কিছু। ছোটবেলায় আমার নানি একটা কথা বলেছিলো। বলেছিলো যে, ঐ অভিশাপটা আমাদের পরিবারের ওপর সারাজীবন থাকবে না। একসময় শেষ হবে। এরপর আর কেউ ঐ গান শুনবে না। তবে শেষ হওয়ার আগে খুব বড় একটা পরিণতি নিয়ে শেষ হবে শাপটা। ঐ খারাপ জিনিসটা, যেটা গান শোনায়, সেটা আমাদের পরিবারের খুব বড় একটা ক্ষতি করে যাবে। হয়তো পুরো পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলবে, বা তেমন কিছু। যে গান গায়, তাকে আমরা কখনো দেখি নাই। নানি বলেছিলো, যেদিন আমাদের ও দেখা দিবে, সেদিনটাই অভিশাপের শেষদিন। সেদিন পরিবারের সবাইকে সে মেরে ফেলবে।’
‘হুদাই। চিপ একটা গল্প।’
‘তুই এমন কেন?’
‘এমন কেন মানে। এটাই তো কমন সেন্স। তোমার নানি আর মায়েরা তোমাদের ঘুমপাড়ানোর জন্য এইসব আজব আজব গল্প ফেঁদেছেন। দেখো গিয়ে, ঐসব গান তোমার নানি আর মায়েরাই গাইতেন।’
চৈতি আজকেও রাগ করে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। সাদাফও ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। কালকে অফিসের একটা কাজ আছে, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। রাত জাগা যাবে না।
রাত দুটা। আমি জেগে আছি। ঘুম আসছে না। আজকের রাতটা যেন কেমন। কেমন গুমোট হয়ে আছে আবহাওয়া। ঝড় ওঠার আগে যেমন থাকে না, ঠিক তেমন পরিবেশ। চারদিক চুপচাপ, শুনশান। এতো নীরবতা ঢাকা শহরে আমি কখনো দেখিনি। আমার কেন যেন ভালো লাগছে না ব্যাপারটা।
আমাদের ঘর অন্ধকার। সব ঘরের লাইট বন্ধ করে রেখেছি। সাদাফের ঘুমানোর জন্যই এই ব্যবস্থা।‌ অন্ধকারটা খুব চোখে লাগছে। মনে হচ্ছে দুহাত দূরের জিনিসও দেখতে পারবো না।
শুয়ে শুয়ে একটা কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ আমার ভাবনাটা কেটে গেলো। কান খাঁড়া করলাম আমি। একটা শব্দ আসছে, গুণগুণ করে একটা শব্দ। শব্দ আসছে যেন ঠিক পাশের রুম থেকে। আমাদের পাশের অন্ধকার রুম থেকে কে যেন গান গাইছে।
আমি উঠে বসলাম। ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, স্পষ্ট শুনতে পারছি। পাশের রুম থেকেই আসছে শব্দটা।
ভয়ের একটা শীতল অনুভূতি আমার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। চৈতির গল্পটা কি আমার ওপর এতোই প্রভাব ফেললো যে, আমি এখন হ্যালুশিনেট করে কল্পনায় গানটা‌ শোনা শুরু করেছি? নাকি আসলেই ব্যাপারটা সত্যি? সত্যিই কেউ আছে পাশের রুমটায়।
আমার ব্যাপারটা দেখা দরকার। কিন্তু ভয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। আমি আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে যাই। সকালেই উঠে দেখবো, ফকফকা রোদ। রাতের এই ভয়ের কিছুই আমার মনে থাকবে না। মা আর ছেলেরা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, ওরা ঘুমাক। ওদের আর কিছু জানাবো না।
হঠাৎ চৈতি উঠে বসলো। ওর চোখে ভয়, প্রচন্ড ভয়। ও চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘তুমি কি শুনছো? পাশের রুমের শব্দটা শুনছো?’
আমি ওর মুখ চেপে ধরে বললাম, ‘আস্তে আস্তে। ছেলেরা উঠে যাবে?’
ও চোখে কান্না নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘শুনতে পারছো?’
আমি মাথা নাড়লাম। শুনতে পারছি।
চৈতি কাঁদতে কাঁদতেই বললো, ‘এখন কি হবে? আমার খুব ভয় করছে।’
আমি বললাম, ‘কিছু হবে না। তুমি ঘুমাও।’
এইসময়, হঠাৎ করেই ছেলেগুলোও উঠে গেলো। ওদের মুখেও ভয়। ওরা আমাদের জড়িয়ে ধরলো।
আমি ওদের অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম, কিচ্ছু হবে না। ঘরের লাইট জ্বালালাম। জ্বালাতেই, ভয়টা অনেকখানি কমে গেলো। গানটা যদিও বন্ধ হয়নি। আমি ওদের মাকে বললাম, ‘দেখে আসি, পাশের ঘরে কি আছে।’
চৈতি শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘না, তুমি যাবে না।’
শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। যে গান গাচ্ছিলো, সে সামনে এগিয়ে আসছে। আমরা শ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছেই সামনের ঘরের দিকে। ঘরটা অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না।‌ কিন্তু কেউ একজন আছে সেখানে।‌ যার গান গাওয়ার শব্দ আমরা পাচ্ছি। সেই শব্দ দরজার দিকে আসছে ধীরে ধীরে।
শব্দটা দরজার কাছে চলে এসেছে। এখনই আমরা ওকে দেখতে পারবো। আমরা চারজন প্রচন্ড আতংক নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকি।
আর তখনই শব্দটা থেমে গেলো। দরজায় আর কাউকে দেখা গেলো না।
আমাদের ভয় কেটে গেছে। চৈতি তার দু’ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। কি যে সুন্দর লাগছে ওদের দেখতে। এটাই আমার পরিবার। এই পরিবারের জন্যই একটা ছেলে শত কষ্ট সহ্য করে খেটে যায়।
রাত অনেক হয়েছে। ঘুমানো দরকার। আমি চৈতিকে বললাম, ছেলেদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে। কাল সকাল হলেই এই গান শোনার একটা ব্যবস্থা করবো। ভালো হুজুর বা কারো সাথে কথা বলবো। এই আতংকের মাঝে আর ওদের থাকতে দিবো না।
আর ঠিক তখনই, সাদাফ চিৎকার করে উঠলো। ওর চিৎকার শুনে আমরা তাকালাম পাশের ঘরের দিকে। তাকিয়ে দেখলাম, পাশের ঘরের দরজায় এক বুড়ো মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। কেমন অদ্ভুত হাসি তার মুখে।‌এমন ভয়ংকর মুখ আমি কখনো দেখি নাই।
সেই বুড়ো মহিলা এগোচ্ছেন আমাদের দিকে। তার গলায় আবার সেই গান চলে এসেছে। ঘুমপাড়ানি গান। এমন ভয়াবহ গান কেউ গাইতে পারে আমার ধারণা ছিলো না। আমি চৈতি আর ছেলেদের শক্ত করে চেপে ধরি। আর সময় নেই আমাদের হাতে। যে ভয়াবহ ব্যাপারটা ঘটবে, তা থেকে তাদের বাঁচানোর কোনো উপায় নেই আমার। কি ভীষণ অসহায় আমরা মানুষেরা, আমরা নিজেরাও জানি না।
বুড়ো মহিলাটা দ্রুত ছুটে আসছেন আমাদের দিকে। আরো জোরে জোরে শব্দ করে তিনি গাইছেন এখন। ঘুমপাড়ানি গান।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প