“আচ্ছা ঝিনুক আপা যদি কোথায় চলে যায় তখন তুই কার সাথে থাকবি?
“আপা কোথায় যাবে? আমাকে ছেড়ে আপা কোথাও যাবে না আম্মা।
” তোর আপাকে যখন বিয়ে দিয়ে দিবো তখন তো যেতেই হবে। আপাকে তো শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হবে।এই যে সারাক্ষণ আপা আপা করিস তখন কি করবি শুনি?
” আমিও আপার সাথে চলে যাবো।
” তা আবার হয় নাকি। ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তো তোকে রাখবে না। তোকে তো তখন একাই থাকতে হবে।
আম্মার কথায় আমি কেঁদে দিতাম। আপার কাছে ছুটে চলে যেতাম। আপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতাম।
” কি হয়েছে ঝিনুক? তুই কাঁদছিস কেনো?
” আপা তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে? তোমাকে ছাড়া তো আমার ঘুম হয় না আপা। তুমি চলে গেলে আমাকে কাজলা দিদি শুনাবে কে? গল্প শুনাবে কে? আম্মার বকা দিলে আম্মাকে বকে দেবে কে?
বলেই জোরে জোরে কাঁদতাম।
” আরে পাগলি তোকে কে বললো আপা চলে যাবে?
” আম্মা বললো তুমি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। তোমার শ্বশুরবাড়িতে নাকি আমাকে থাকতে দেবে না?
” আপা তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। কাঁদিস না আপু।
আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে চুমু খেতেন।
“আম্মা তুমি ওকে এসব বলে কাঁদাও কোনো বলতো?
” আমি ভুল কি বললাম? আজ বাদে কাল তো তোর বিয়ে হবেই। ও যে এমন পাগলামি করে এটা এখন থেকে না কমালে পরে ওকে সামলাবো কিভাবে?
” তোমাকে কিছু করতে হবে না। ওকে এসব আর বলবে না তুমি। আম্মা ও কাঁদলে আমার ভালো লাগে না।
” দেখছেন আম্মা আপা আমাকে ছেড়ে যাবে না কোথাও।
আপার পাশ থেকে বলতাম আমি।
আপার সাথে আমার সম্পর্কটা সমান্তরাল ভাবেই চলছিলো। চক্রবৃদ্ধিহারে ভালোবাসা বেড়েই চলছে। কোথাও কোনো ছেদ নেই।
তবে ভাইয়ার সাথে বাবার সম্পর্কটা আর ঠিক হলো না। বাবা ভাইয়ার নাম শুনতেই নারাজ। ভাইয়া বাবা না থাকলে আসতো মাঝেমাঝে। ভাবীও আসতেন।
আপা তখন অনার্স চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল দিয়ে ফেলেছেন। আমি তখন ক্লাস ফাইভে।
আপার বিয়ে ঠিক করলেন বাবা।বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে হবে আপার।
বাবা সব ব্যাপারে আপার মতামত নিতেন। শুধু এই ব্যাপারটায় আপাকে জিগ্যেস না করেই কথা দিয়ে দিয়েছিলেন বাবার বন্ধুকে।
আম্মাকে যখন বললেন আম্মা বললো ” ঝুমুরের মত নিয়ে নিলে ভালো হতো না?
” শোনো রানু আমার মেয়ের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। আমার মেয়ে আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কখনওই যাবে না। ওর ব্যাপারে আমি যা ঠিক করবো তাতেই ও রাজি। আমার মেয়ে অন্যদের মতো না। বাবার সম্মান ও ঠিক রাখবে।
আপাকে যখন কথাটা জানানো হলো আপা কিছুই বললেন না। একেবারেই না। আমার ভেতর তখন চলছে তোলপাড়। আমি বড় হলেও এখনও আপার ওপরই নির্ভর করতে হয়। চুলগুলো এখনও নিজে নিজে আচড়াতে শিখি নি। আমার চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে পড়তো। চুলে শ্যাম্পু করা থেকে তেল দেওয়া রোজ চুল বেধে দেওয়া সবটাই তখনও আপা ই করেন। এখনও স্কুল থেকে ফিরলে আপা খাইয়ে দেন। এখনও দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে না শুতে পারলে ঘুম হয়না।
এদিকে বিয়ের ডেটও ঠিক হয়েগেছে। কয়েকদিনের মধ্যে দাওয়াতের কার্ড বিলিও শুরু হয়ে যাবে। বাবা ভীষণ ব্যস্ত। একা সব সামলতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সেসময়টা আপা ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেলেন। আপা খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন।বেশ পরিপাটি থাকতেন। আপা সময়মতো সব করতেন। একটা নির্দিষ্ট রুটিনে খাওয়া দাওয়া।খিদে আবার আপার একদম সহ্য হতো না। আপার আবার ঠান্ডা লাগার ধাচ ছিলো। অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যেতো। আর ঠান্ডা লাগলে শ্বাস বেড়ে যেতো। নিউমোনিয়া পর্যন্ত গড়াতো। তাই আপা নিয়ম মেনে সব করতেন। গরমেও আপা হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করতেন। আর আপার সাথে কেউ উচ্চস্বরে কথা বললে আপা কেঁদে কেটে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। প্রচন্ড অভিমানী ছিলেন তিনি। একবার নাকি স্যার আপাকে একটা ধমক দিয়েছিলেন।তারপর সে কি অবস্থা। জ্বর আর মাথা ব্যথায় আপার মর মর অবস্থা। হসপিটালে ছিলেন দু দিন। বাবা আম্মা কেউ আপাকে কখনও ধমক দেন নি তো তাই,,
কিন্তু সে আপাই কেমন অগোছালো হয়ে গেলেন। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করতেন না। গোসলের কথা ভুলে যেতেন। আম্মা ঠেলেঠুলে সব কাজ করাতেন। আম্মা আর বাবা ভাবলেন আমাদের ছেড়ে চলে যাবে বলে আপার মন খারাপ।
একরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দেখলাম আপা আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন আর কাঁদছেন।
” আপা তুমি কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে তোমার? মাথা ব্যথা করছে?
” কিছু হয়নি আপু। তুই ঘুমিয়ে পর।
” বলোনা আপা কি হয়েছে?
” তোকে ছাড়া কি করে ঘুমাবো রে? বাবাকে ই বা রোজ সকালে চা করে দেবে কে? পেপার পড়ে শোনাবে কে? আম্মা কার সাথে সব কথা শেয়ার করবেন?
” এভাবে কেনো বলছো আপা? আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। তুমি যেও না আপা।
” আমি যে নিরুপায় ঝিনুক। যেতে তো হবেই আমাকে।আচ্ছা ঝিনুক আমি যখন থাকবো না তোকেই বাবা আর আম্মাকে দেখে রাখতে হবে। পারবি না?
আপাকে জড়িয়ে ধরে আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম।
” তোমাকে ছাড়া আমি কি করে থাকবো আপা? তোমাকে ছাড়া তো আমার ঘুমই হবে না। আমার চুল বেধে দেবে কে? আমার সব কিছু কার কাছে চাইবো? আমার খুব কষ্ট হবে আপা।
” কষ্টও আমার ও হচ্ছে রে ঝিনুক। শোন তুই কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ে থাকবি।আম্মাকে একদম জ্বালাবি না। পড়াশোনা মন দিয়ে করবি। একদম ফাকি দিবি না। দুষ্টুমি করবি না একদম। তোকে আগলে রাখার জন্য আপা যে আর থাকবো না।
” আপা আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে যাবি তোমার শ্বশুরবাড়ি? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
আপা আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। কপালে চুমু একে দিলেন। আপাও কাঁদছেন খুব।
আমি আপার চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম ” কেঁদো না আপা। তোমার বিয়ে হতে তো আরও অনেকদিন দেরি। আমি তোমার বরকে বলে ঠিক তোমার সাথে চলে যাবো। তুমি আর কেঁদো না। তুমি কাঁদলে যে আমারও কষ্ট হয়।
আপা আমাকে পাশে নিয়ে শুয়ে পড়লেন। মাথায় বুলিয়ে দিলেন। কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি।
পরদিন আপা কেনাকাটা করার জন্য বেরুলেন। আমি সাথে যেতে চেয়েছিলাম আপা নেননি।বললেন ” তোর গিয়ে কাজ নেই। কষ্ট হবে শুধু শুধু। তুই আম্মার সাথে বাসায়ই থাক।
আপা যাওয়ার পর থেকেই আমার অস্থির লাগতে শুরু করলো। রুম আর বেলকনি পায়চারি করছিলাম। আর আম্মাকে একটু একটু পর পর গিয়ে জিগ্যেস করছিলাম “আপা কখন আসবে? আসছে না কেনো এখনো?
শেষমেশ আম্মা বিরক্ত হয়ে দিলেন এক ধমক। মন খারাপ করে বেলকনিতে গিয়ে বসে রইলাম।মনে মনে ভাবছিলাম আসুক আজকে আপা। আম্মাকে যদি বকা না শুনিয়েছি,,
“তুই আজ এতো ছটফট করছিস কেনো? ঝুমুর একটু আগেই তো গেলো।কেনাকাটা করতে তো একটু সময় লাগবেই। চলে আসবে একটু পর।
” আমার ভালো লাগছে না আম্মা।
” আচ্ছা তুই চল আমার সাথে। আম্মা তোর পছন্দের বাদাম তরকারি রান্না করছি।দেখবি চল।
আম্মার সাথে রান্নাঘরে গেলাম। আম্মা রান্না করছেন আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি।
“আম্মা আপাকে বিয়েটা না দিলে হয় না? আপাকে আমাদের কাছেও রেখে দিন।
আম্মা হেসে ফেললেন।
” শোনো মেয়ের কথা। মেয়ে বড় হলে তো বিয়ে দিতেই হবে। তুই যখন বড় হবি তখন তোকেও বিয়ে দিবো।
” আমি বিয়ে করবো না। আপা কালকে রাতে অনেক কান্না করছে আমাদের ছেড়ে যাবে বলে। আপার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমারও কষ্ট হচ্ছে। আপনারা অনেক খারাপ। আপাকে কষ্ট দিচ্ছেন।
বলেই রুমে চলে আসি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো। আপা তাও ফিরছেন না। আম্মা আপার মোবাইলে কল করেই যাচ্ছেন।আপার মোবাইল বন্ধ বলছে। আম্মার টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিলো।
বাবাকে কল করে জানানো হলো।বাবা আর ছোট মামা একটা কাজে গিয়েছিলেন। বাবা আর মামা ফিরে আপার বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করলেন, বিভিন্ন জায়গায় খোজ করলেন।আপাকে পাওয়া গেলো না কোথাও।
সন্ধ্যা ছাপিয়ে যখন রাতের অন্ধকার ঝেকে বসলো বাবা আমাদের রুম থেকে আপার রেখে যাওয়া একটা চিঠি
আবিষ্কার করলেন। চিঠিটা পড়ে বাবা বিছানায় বসে পড়লেন।আর কোনো কথাই বললেন না। একে একে চিঠিটা আম্মা মামা অবশেষে এক ফাকে আমিও পড়েছি।মা
আপাও ভাইয়ার পথ অনুসরণ করেছেন। এই বিয়েটা আপা করতে পারবেন না। সে আরও আগেই একজনকে বিয়ে করে ফেলেছে। বাবাকে বলার সাহস হয়ে উঠেনি। তাই তাকে চলে যেতে হলো।
আমার বুদ্ধিমতী আপা এতোবড় বোকামি কি করে করলেন আজও ভেবে পাই না।
সেদিন রাতে বাবা স্ট্রোক করলেন।
আম্মা আর মামা বাবাকে নিয়ে হসপিটালে গেলেন। আমি বাসায়ই রয়ে যাই। সেদিন কেনো যেন ভয় হচ্ছিলো না একটুও। ভাগ্যিস সেদিন মামা ছিলেন। নয়তো আমি আর আম্মা কি ই বা করতাম বাবাকে নিয়ে।
বাবা দুদিন পর বাসায় ফিরলেন। বাসার ফিরেই বাবা বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আমার সেই স্ট্রং পার্সোনালিটির বাবাকে বড্ড অসহায় লাগছিলো। দু ছেলেমেয়ের এমন কর্মকান্ডে বাবা হতবিহ্বল হয়ে গেছেন। আম্মা বারবার বলছিলেন তুমি শান্ত হও। ডাক্তার তোমাকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছেন। বাবাকে সামলানো ই যাচ্ছিলো না। ” আমার ছেলেমেয়েদের আমি মানুষ করতে পারলাম না। আমার ভালোবাসায় কোথায় কমতি ছিলো যে ও এমন করলো। আমার কথা একবারও ভাবলো না। একবারও ভাবলো না সম্মানের কথা। আমাকে একটা বার বলে তো দেখতে পারতো। আমার একটা ছেলেমেয়ে ও মানুষ হলো না। ওকে আমি কতো বড় আসনে বসিয়ে ছিলাম। মাথায় করে রাখতাম ওকে। ও কিনা আমার সম্মান আর ভালোবাসাকে মাটিতে ছুড়ে ফেললো। কি করে পারলো ও?
বাবা এসবই বলে চলেছেন।
সব দ্বিধা, সংকোচ আর ভয় একপাশে সরিয়ে রেখে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। বাবার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম ” আপনার ছোট মেয়ে এখনো বেচে আছে বাবা। কথা দিলাম আপনার মনের মতো হয়ে দেখাবো। আপনার আদর্শের আদলে গড়বো নিজেকে। আপনি কাঁদবেন না বাবা। আপনি যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই চলবো। আপনি আর কাঁদবেন না। আপনার ছোট মেয়েi মানুষ হবে।কথা দিলাম।
সেসময় আমার মধ্যে যেন বড় কেউ ভর করেছিলো। কথাগুলো কিভাবে বলেছিলাম তার ব্যাখ্যা আজও দাড় করাতে পারিনি।
বাবা সেদিন প্রথমবারের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে প্রচন্ড মায়া হচ্ছিলো।। আর আপার ওপর হচ্ছিলো প্রচন্ডে রাগ। সেদিন থেকেই বড় আপাকে আমি ঘৃণা করি। হ্যা যে মানুষটাকে ছাড়া আমার এক মিনিটও চলতো না তাকেই আমি প্রচন্ড ঘৃণা করতাম।
দুদিন পর মামা খোজ নিয়ে জানলেন আপা যার সাথে চলে গেছে সে বাবার
ই একজন ছাত্র ছিলেন। বাসায় আসতেন পড়তে। সেখান থেকেই আপার সাথে পরিচয়। আপার সাথে সেখানেই পরিচয়। সে এখন চট্টগ্রামে একটা জব করে।
যদিও বাবা এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করলেন না।
মামা যার কথা বললেন তাকে আমি চিনতে পেরেছিলাম। রনি ভাইয়া। আমাকে খুব আদর করতেন। আপা রনি ভাইয়ার সাথে চলে গেছেন!!
৭ দিনের মাথায় বাবা সে এলাকাটা ছেড়ে দিলেন। ছেড়ে দিলেন শহরটাও।
আমাকে আর আম্মাকে নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। আমাকে গ্রামের স্থানীয় স্কুলেই ভর্তি করিয়ে দিলেন। আর একটু কষ্ট হলেও বাবা এখান থেকে এসে যেয়ে কলেজ করতেন।