শেষ স্মৃতি” পর্ব-০৩ এবং শেষ।

গ্রামের বাড়িতে আসার পরও বাবার একপাল ছাত্র জুটে গেলো। তবে বাবা এবার আর তাদের অন্দরমহলে ঢোকার অনুমতি দিলেন না। বাড়ির চারপাশে প্রাচীর তুলে প্রাচীরের বাইরে রুম করলেন ছাত্রদের জন্য।
আমার বয়স যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেলো। আমার সেই চঞ্চলতা কোথায় উবে গেলো তার আর কোনো হদিশ পেলাম না। স্কুল আর বাসা এটাই আমার গন্ডি। স্কুলে কারও সাথে আমার তেমন কথা হতো না। ক্লাস করে চুপচাপ বাসায় ফিরে আসতাম। বাড়ির সামনের উঠোনটায় বাগান করে সময় কাটাতাম। আপা বাড়ির আঙ্গিনায় একটা বকুল গাছ লাগিয়েছিলেন। গাছটা বেশ বড় হয়েছে। অনেক ফুলও হতো। গাছটা আপার কথা মনে করিয়ে দিতো আমাকে। গাছের দিকে তাকালেই আমার হু হু করে কান্না পেতো। আপা কি করে পারলো এমন করতে! আমার কথা কি একবারও মনে পরেনা? অনেক বার ভেবেছি বাবাকে বলবো গাছটা কেটে ফেলতে। শেষ অবধি আর বলা হলো না। কি জানি হয়তো আপার স্মৃতি মনে রাখার জন্যই আর বলতে পারতাম না।
আপাকে ছাড়া আমার রাত গুলো বিষন্ন কেটেছে খুব। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কেটে যেতো অধিকাংশ রাতগুলো। সারাদিন যেমন করেই হোক কেটে যেতো।রাতগুলো কাটতে চাইতো না।
বাবার মধ্যে পরিবর্তন দেখলাম অনেক। বাবার সেই রাগী ভাবটা আর যেন নেই। বাবা ভীষণ শান্ত হয়ে গেলেন। আর হয়ে গেলেন আমার বন্ধু। বাবাকে তখন আর ভয় হতো না আমার।
অনেক রাখঢাক করে আপা আর ভাইয়ার ঘটনা গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে আড়াল করা হয়েছিলো। বাবা তার বেচে যাওয়া সম্মানটুকু অটুট রেখেছিলেন গ্রামে এসে। গ্রামের সবাই জানতো আপাকে বিয়ে দিয়ে আমরা গ্রামে ফিরেছি।
বাবার মতো আমিও বদলে গেলাম। পড়াশোনায় খুব ভালো না হলেও মোটামুটি ধরনের ছাত্রীদের তালিকায় নাম লেখালাম। সবকিছু বুঝতে শুরু করলাম।
ভাইয়ার সাথেও আমার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ভাইয়া যদিও আসতো
তার কেমন আছি প্রশ্নে শুধু ভালো আছি ছাড়া আর কোনো কথা হয়নি।
আপাকে বেশি ভালোবাসতাম বলে হয়তো আপার প্রতি অভিমানটাও বেশিই ছিলো।
সময়ের স্রোতে ভেসে কেটে গেলো আরও চারটি বছর। আপা দু মাসের স্মৃতিকে( আপার মেয়ে) কোলে নিয়ে ফিরলেন।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। গেট খোলার শব্দ শুনে আম্মা এগিয়ে এলেন।
” কে এসেছে আম্মা?
” তোর আপা এসেছে।
আম্মা একটু ফিসফিস করে বললেন।
” কে এসেছে???!
” ঝুমুর এসেছে, ওর বরটা এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে। ওর বরের বাড়ির কেউ তো ওদের বিয়েটা মেনে নেয়নি। ওদের ছেলে বেঁচে থাকতেই মেনে নেয়নি এখন ওদের ছেলে বেঁচে নেই এখন কি আর মেনে নেবে? দু মাসের মেয়েটাকে নিয়ে ও আর কোথায় যাবে বল তো?
” আম্মা ভাত বাড়েন। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।
বলেই আমি ভেতরে চলে যাই।
আমার এমন নিরুত্তাপ উত্তরে আম্মা আশাহত হয়েছেন সেটা আম্মার মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে।
বাবা রাতে ফিরলেন। বাবার সাথে আমিও রাতের খাবার খেতে বসেছি। আম্মা অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভনিতা করে কথাটা উঠালেন।
আমাকে আর আম্মাকে অবাক করে দিয়ে বাবা কোনো রিয়েক্ট করলেন না।
শুধু খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন ” খাওয়া শেষ হলে তোর ইংলিশ বইটা নিয়ে আমার রুমে আয়।
আম্মা এবারও আশাহত হলেন।
আপা যেন নিজ বাড়িতেই পরবাসী। আপার রুমটা ছাড়া কোথাও বের হতো না। আম্মা ছাড়া আমি বা বাবা কারও সাথেই আপার কথা হতো না। আপাও কেমন যেন হয়ে গেছেন। খাওয়া দাওয়া করেনই না। গোসল খানায় ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে দেন। আপা যে গোসল খানায় বসে কাঁদেন সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারি। মেয়েকে খাওয়াতে ভুলে যান। ভীষণ বিধ্বস্ত তিনি।
আপার সাথে কথা না হলেও আমি ঠিকই লক্ষ্য করতাম সেটা।
প্রায়ই দেখতাম স্মৃতি কাঁদছে আপা পাশে বসে আনমনা হয়ে আছেন। কান্না যেন তার কর্ণগোচর হচ্ছে না।
তখন আম্মাকে গিয়ে বলতাম ” বাচ্চাটা কাঁদছে কেউ কি শুনতে পাচ্ছে না। কান্না থামাচ্ছে না কেনো? আমি পড়তে পারছি না।
তখন আম্মা গিয়ে আপার ধ্যান ভাঙ্গাতেন।
” তুই এমন কেনো করছিস? একটাবার গিয়ে জিগ্যেস ও তো করতে পারিস কেমন আছে মানুষটা?
পড়তে বসেছিলাম। আম্মা এসে কথাটা বললেন।
” আমি জিগ্যেস করছি না বলে কেউ খারাপ আছে বা আমি জিগ্যেস করলে কেউ ভালো থাকতো ব্যাপারটা তো এমন নয় আম্মা।
” এভাবে কথা বলছিস কেনো?
” তো আপনি আমাকে কি করতে বলেন? আপনার বড় মেয়ে ফিরে এসেছে আমি খুশিতে গদগদ হয়ে তার কাছে যাবো? সরি আম্মা পারবো না। আপনার মেয়ে এমন কোনো মহৎ কাজ করে আসেন নি। যে আমি সব ভুলে যাবো। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমার বাবা সেদিন মরতে বসেছিলেন। আমার কাছে এখন আমার বাবার চেয়ে ইম্পরট্যান্ট আর কেউ না। চার বছর তার কোনো খোজ ছিলো না। এখন তার প্রতি আমার দরদ দেখানোর কোনো কারণ আমি খোজে পাচ্ছি না। আম্মা আপনি যান এখন। আমার পরীক্ষা আছে। পড়তে হবে।
” তুই একদম তোর বাবার মতো হয়েছিস। মায়া দয়া নেই একেবারে।
বলেই আম্মা চলেগেলেন। আম্মা খেয়াল করেননি কথাগুলো বলার সময় আমার চোখের ছলছল করাটা। আম্মা কখনও দেখেননি আপার দরজার পাশ থেকে লুকিয়ে উঁকি আমার দেওয়াটা। আমার বড্ড ইচ্ছে করে আপাকে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু অভিমানের অদৃশ্য পাহারটা আমাকে প্রতিনিয়ত বাধা দিয়ে চলেছে।
দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আম্মার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
আম্মা ছুটে এলেন আমার কাছে।
” কি হয়েছে আম্মা আপনি কাঁদছেন কেনো?
” তোর আপা কেমন যেন করছে। শ্বাসটা আবার বেড়েছে। আর বলছে মাথাটা অনেক ব্যথা করছে।
আপার রুমে ছুটে গিয়ে দেখি আপা ছটফট করছে ব্যথায়। আম্মা কেঁদেই চলেছেন। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা।
দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে কল করলাম।
ভাইয়াকে সবটা বলার পর ভাইয়া বললেন তিনি আসছেন।
মোবাইলটা রেখে আবার গেলাম আপার কাছে। আম্মাকে একটু ধমক দিয়ে বললাম “কাঁদছেন কেনো? কি হয়েছে? আপনি যান তো এখান থেকে।
আর নয়তো চুপ করুন। ভাইয়া আসছেন। হসপিটালে নিয়ে যাবেন।
আম্মা কিছুটা শান্ত হলেন।
আপার পাশে গিয়ে বসতেই আপা আমার হাত ধরলেন।
” আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মেয়েটা তুই দেখিস। আমি জানি আমাকে তুই ঘৃণা করিস। করাটাই স্বাভাবিক। তবুও তোকে যদি আমি কখনও বিন্দু পরিমাণও ভালোবেসে থাকি তার প্রতিদান হলেও আমাকে মেয়েটাকে তুই আগলে রাখিস। তোর কাছেই রেখে গেলাম ওকে।
আপার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো।কথাগুলো জড়িয়েও আসছিলো।
” কথা বলবেন না আপনি। আপনার কিচ্ছু হবে না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। আপনি ঠিক সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। আপনার মেয়েকে আপনিই দেখতে পারবেন।
আপার দুচোখ ছাপিয়ে জল পড়ছে।
“কথা দে আমার মেয়েটাকে দেখবি তুই? আমি তোদের কষ্ট দিয়েছি তো তাই আল্লাহও আমাকে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমার মেয়েটা তো কোনো দোষ করেনি। ও কেনো কষ্ট পাবে?
” আপনি চিন্তা করবেন না। দেখবেন আল্লাহর রহমতে আপনি ঠিক ফিরে আসবেন। আর আপনাকে মেয়েকে আমি দেখবো কথা দিলাম। ওর কোনো অযত্ন হবে না। আপনি কাঁদবেন না।
আধাঘন্টা পরই অ্যাম্বুলেন্স এর শব্দ শোনা গেলো। আম্মাও আপার সাথে চলে গেলেন হসপিটালে। স্মৃতি রয়ে গেলো আমার কাছে।
বাবাকে খবর দেওয়া হলে বাবা গিয়ে হসপিটালে দেখে এলেন। আম্মা বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন আমি একা আছি বলে।
হাসপাতালে যাওয়ার পর জানা গেলো আপা স্ট্রোক করেছেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনেক। আর ঠান্ডা লাগায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।
রাতে আমার ঘুম হলো না। স্মৃতি একটু পর পর জেগে উঠে কান্না করছিলো। বাচ্চা সামলাতে আমি বেশ অপটু। তাও সাধ্যমত চেষ্টা করছিলাম। শেষ রাতে চোখ লেগে এলো আমার।
আপাকে স্বপ্ন দেখলাম। সেই ছোটো বেলায় আপা আমাকে কাজলাদিদি শোনাতেন। গল্প বলে খাওয়াতেন।ঘুম পাড়াতেন। সেসবই দেখলাম। আবার দেখলাম আপা আমার সাথে লুকোচুরি খেলছেন। আপাকে আমি আর খুঁজে পাচ্ছিনা বলেই কাঁদছি আমি। আর চিৎকার করে আপাকে ডাকছি।
স্মৃতির কান্নায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফজরের আযান ভেসে আসছে। দুধ গরম করে স্মৃতিকে খায়িয়ে নামাজে দাঁড়ালাম।
কোনো জানি না খুব অস্থির লাগছে।
স্মৃতিকে নিয়ে বাইরে এসে বাগানে হাটাহাটি করছিলাম। তাতেও শান্তি লাগছে না।
বাবাও নামাজ পড়ে বাইরে এলেন। আমাকে পায়চারি করতে দেখে এগিয়ে এলেন।
” কি রে কি হয়েছে? এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেনো তোকে? পায়চারি করছিস কখন থেকে।
” আমার খুব অস্থির লাগছে বাবা। ভালো লাগছে না কিছু। এমন কেনো হচ্ছে?
” ও কিছু না। তুই বেশি চিন্তা করছিস তো তাই এমন মনে হচ্ছে। ঘরে যা।
ঘরে এসে স্মৃতিকে বিছানায় শুয়িয়ে দিলাম। চুলায় রান্না চাপালাম। বাবাকে খাবার দিতে হবে তো।
বাইরে অ্যাম্বুলেন্স এর শব্দে চমকে উঠলাম। আপা কি তবে ফিরে এসেছেন?
হ্যা আপা ফিরেছিলেন। তবে ফিরেছিলো শুধু আপার শরীরটা। প্রাণটা পরপারে পাড়ি জমিয়েছে।
আম্মা বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন। বাবা বারান্দায় ঝিম মেরে বসে আছেন। কোনো কথা বলছেন না। ভাইয়া আপার লাশের পাশে বসে কাঁদছেন।
আমি আপার লাশটা দেখতে যাইনি। সাহস হচ্ছিলো না। আপার নিথর দেহটা দেখার মতো সাহস এখনো আমার হয়নি। ওতো সহ্য ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেয়নি। স্মৃতিটা আমার কোলে কেঁদেই চলেছে। ও বুঝে গেছে ওর মাকে ও হারিয়েছে। রাতেই হয়তো অঘটনের আভাস পেয়েছিলো।তাই বারবার চমকে উঠে কেঁদে ফেলেছিলো।
বাবাকে যখন আপাকে শেষবারের জন্য দেখতে বলা হলো বাবা তখন কেঁদে উঠলেন। আপাকে নিয়ে যাওয়ার পর কেঁদেছিলাম আমি। বিছানায় মুখ গুঁজে।
স্মৃতিকে বুকে চেপে ধরেছিলাম। আমাকে এখন কাঁদলে চলবে না। আমার অনেক দায়িত্ব এখন। আপা আমাকে অনেক বড় দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তার শেষ স্মৃতিকে আগলে রাখার দায়িত্ব!
আপা আমাকে যেভাবে বড় করেছিলেন তার মেয়েকে আমি তার চেয়েও বেশি যত্নে বড় করেছি। মেয়েটা আমাকে ডাক তো ছোট মা।
বাবা ওর প্রতি বাহ্যিক আগ্রহ দেখাতেন না বটে। তবে রোজ বাবার পকেটে চকোলেট পাওয়া যেতো। আম্মাকে বলতেন দোকানদার ভাঙ্গতি ছিলো না বলে দিয়েছে, কখনও বলতেন ছাত্ররা দিয়েছে। স্মৃতিকে দিয়ে দাও।
আমি আর আম্মা মুচকি হাসতাম।
আমাকে বলতেন ওকে বড় করছিস ভালো কথা নিজের পড়াশোনা ঠিক রেখে যা করার কর। স্মৃতি অবিকল দেখতে বড় আপার মত। বড় আপার ছোটবেলার সঙ্গে স্মৃতির কোথাও অমিল খুঁজে পাইনি। বড় আপা বেচে আছেন।স্মৃতির মধ্যেই বেচে আছে। আপার মতই শান্ত, হাসলে ওর মধ্যে আপাকে খুঁজে পাই প্রতিনিয়ত।
স্মৃতিকে আমিও রাতে গল্প বলতাম। বড় আপার গল্প। বড় আপার বলা গল্প গুলোই আওরাতাম আমি। মেয়েটাও আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না।
আমি যে মা ছিলাম ওর। ছোট মা।
স্মৃতি পাঁচ বছরে পা দিলো তখন।
বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন। আমার বিয়ে করতে আপত্তি নেই। তবে স্মৃতিকে আমি সাথে নিয়ে যাবো এ শর্তে যদি রাজি হয় তবে আমি বিয়ে করবো। বাবা কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন “এমন শর্তে কেউ রাজি হবে নাকি?
“না হলে নাই। কাছের মানুষটা হারিয়ে গেলে কতোটা কষ্ট হয় সেটা আমি বুঝেছি।স্মৃতিকে আমি সে কষ্ট টা পেতে দেবো না বাবা। ও এখনও অনেক ছোট। আমাকে ছাড়া ওর চলবে না।
সেসময় দেখলাম একটা গাড়ি প্রায়ই আমাকে ফলো করতো। ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখা যেতো গাড়িটা। বাড়ির সামনেই দেখেছি দু একবার।
ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে দেখা পেলাম গাড়ির মালিকেরও। তার আমার সাথে কথা ছিলো। আমি তাকে জানিয়েছি যা কথা আমার বাবার সাথে বলুন। আমার তার সাথে বলার কিছু নেই।
হলো ও তাই। সে বাবার সাথেই কথা বললেন। তিনি বিয়ে করবেন আমাকে।
বাবা আমাকে বারবার সুধালেন আমি রাজি কি না । বাবাকে বললাম তাকে শর্তের কথা জানাও। সে শর্তে রাজি হলে আমিও তাকে বিয়ে করতে রাজি।
আমিই তাকে শর্তের কথা বলেছিলাম।
সব কথা বলার পর তার বক্তব্য ছিলো এমন ” এই ছোট একটা শর্তের জন্য তোমাকে হারিয়ে ফেলার মতো বোকামি আমি করবো না। আমার বাবা গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। এখানে বাসায় তোমাকে একা ই থাকতে হবে। স্মৃতি তোমার সাথে থাকবে সেটাতে না রাজি হওয়ার তো কিছু নেই।
তুমি আমার খুব পছন্দের একজন। তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম জ্যামে বসে। তুমি রিক্সায় ছিলে। একটা ছোট্ট মেয়ে কিছু ফুল নিয়ে ঘুরছিলো সবার তাকে না বলে দিলেও তোমার সব ফুলগুলো কিনে নিয়েছিলে। তাকে আবার ফুলগুলো দিয়ে দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলে।
মেয়েটার সে কি আনন্দ। তোমার মুখটা দেখা হলো না বলে তোমার রিক্সাকে ফলো করলাম। রিক্সা থামলো তোমার ভার্সিটির সামনে।তোমাকেও দেখা হলো। এরপর থেকেই তোমার প্রতি মুগ্ধতা। তোমার সাথে সম্পর্কিত সব কিছুই আমার পছন্দ। আর স্মৃতির মতো একটা ছোট্ট পরিকে আমাদের সাথে রাখবো এটা তো আনন্দের কথা।
আমার পরিবারে আমি একমাত্র সন্তান। কোনো বাচ্চা নেই আমাদের পরিবারে। ওকে আমরা সাদরেই গ্রহণ করবো।
রিয়ানের কথায় সেদিন আমিও মুগ্ধ হয়েছিলাম। রিয়ান শুধু মুখেই বলেনি। কাজে ও করে দেখিয়েছে।
বাবার সাথে ভাইয়ার সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে ততোদিনে। এক সন্তানকে হারিয়ে বাবা ভড়কে গেছেন। ভাইয়াকে ক্ষমা করেছেন। ভাইয়া আর ভাবী দুজনই ডাক্তার।তাই এখানে থাকতে পারে না। তবে সুযোগ পেলেই ছুটে আসে। ভাইয়া আর ভাবীর কোনো সন্তান নেই। অনেক চিকিৎসা চলছে।কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তাদের ধারণা বাবাকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি এটা।
আমার বাবা আমার বিয়েতে এলাহী কান্ড বাধালেন। আমাদের গ্রামে বিয়েতে এতো আয়োজন এই প্রথম।
বিয়ের দিন স্মৃতিকে রেখেই আমার যেতে হলো। বাবা ওকে আমার সাথে দিলেন না। বললেন পরে নিতে ওকে।
আমি চলে আসি সময় স্মৃতির সে কি কান্না।
বিয়ের দুদিন পর শেষরাতে আমি আবার বড় আপাকে দেখলাম। আপা বকুল গাছটার নিচে বসে কাঁদছেন। আমি আপাকে জিগ্যেস করলাম কি হয়েছে আপা কেঁদেই চলেছেন অনবরত। হঠাৎ আবার হারিয়ে গেলেন আপা। আমি আপা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।
রিয়ানের ও ঘুম ভেঙ্গে গেছে তখন।
” কি হয়েছে ঝিনুক?
” আপা! আপা কাঁদছিলেন।
” তুমি স্বপ্ন দেখছিলে। শান্ত হও।
” আবার কোনো অঘটন ঘটবে না তো?
” কি বলছো? কিসের অঘটন? ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছো। এতো টেনশন করার কিছু নেই। আযান হয়েছে। ফ্রেস হয়ে নামাজ পড়ে নাও।
আমার অস্থিরতা কমছিলোই না। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিনা।
” তুমি এতো অস্থির হচ্ছো কেনো?
” আপা যেদিন মারা গেলেন সেদিন আমার এমন লাগছিলো। আচ্ছা ও বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো? স্মৃতি? স্মৃতি ঠিক আছে তো?
” ঝিনুক, শান্ত হও। সকাল হতে দাও। আমরা ওখানে যাবো। স্মৃতিকে নিয়ে আসবো। তুমি ওকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করছো বলেই এমন মনে হচ্ছে।
সেদিনই বাড়িতে চলে গেলাম। বাড়িতে ঢুকতেই দেখি স্মৃতি বকুল ফুল কুড়িয়ে দুহাত ভরে ফেলেছে। আমাকে দেখে ছুটে কাছে চলে এলো। ওকে দেখে আমিও যেনো প্রাণ ফিরে পেলাম।
কোলে নিতেই ও বললো ” ছোট মা দেখো কতো বকুল ফুল। আজকে গাছে অনেক ফুল ফুটেছে।
সবাই আমাকে দেখে অবাক।আজকে বিকেলে ওদের আমাকে আনতে যাওয়ার কথা ছিলো।
স্মৃতিকে নিয়েই সেবার ফিরলাম।
আমি ওর ছোট মা ই রয়ে গেলাম। অথচ রিয়ান হয়ে গেলো ওর বাবা। রিয়ান স্মৃতিকে বাবা ডাকতে শেখালো।
খুব অবাক হতাম যখন কেউ ওকে স্মৃতিকে নির্দেশ করলে জিগ্যেস করতো “কে এটা? তার প্রতিউত্তরে ” আমার মেয়ে বলতে শুনতাম।
আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর আমার ছেলে এলো পৃথিবীতে। কিছুটা ভয় ছিলো। স্মৃতির প্রতি কোনো অবহেলা আসবে না তো রিয়ানের?
নাহ আমার ভয়টা হেরে গেছে।স্মৃতির জায়গা টা ওরই রয়েছে। রিয়ান আর স্মৃতির সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসে নি।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমি কথা রাখতে পেরেছি আপা। তোর শেষ স্মৃতিকে আগলে রাখতে পেরেছি।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প