সুখ পর্ব০২

অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে রিসাদ। অফিসের সামনে দাড়িয়ে আছে এই অপেক্ষায় যে কখন দীপ্তি অফিসে আসবে। দীপ্তি আদৌও আসবে কিনা তা নিয়েও বেশ সংশয়ে আছে ও। কারন দীপ্তি স্বাধীনচেতা মেয়ে। নিজের স্বীদ্ধান্তে ও বরাবরই অটল। এনিয়ে বিয়ের আগে ও পরে অনেক কথা-কাটাকাটি হয়।
‘দীপ্তি, এই দীপ্তি ওঠ এবার।’
‘হ্যাঁ, বল।’
‘খাবি চল। অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমি জানি তুই অনেকটা সময় না খেয়ে আছিস। এ অবস্থায় খালি পেটে থাকা একদম উচিৎ না।’
‘অনেক বেলা হল তাই না। অফিসের জন্য দেরি হয়ে গেল।’
‘আজ কোনো অফিস নয়। আমি অফিস থেকে দুজনেরই ছুটি নিয়ে নিয়েছি।
দীপ্তি. ‘
‘হু’
‘একটা সত্যি কথা বলবি।’
‘হ্যাঁ বলব।’
‘তুই ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার কেন করলি?’
‘শান্তি চেয়েছি, সুখ চেয়েছি তাই’
‘কিহ!!’
‘হ্যাঁ। নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কি বেঁচে থাকা যায় আপু। রিসাদের সাথে সম্পর্কটা ঠিক করার অার রাখার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো কিছু কি আর এক তরফা হয় বল। ওপাশ থেকে কোনো পজিটিভ রেসপন্স পাই নি, পেয়েছি বিরক্তি মনোভাব, অপমান আর কষ্ট।’
‘আমার মনে হয় না কোর্ট তোদের ডির্ভোর্সের অ্যাপ্লাই গ্রহণ করব। কোনো মেয়ে প্রেগন্যান্ট থাকলে এবং ডিভোর্স এপ্লাই করলে কোর্ট তা গ্রহণ করে না।’
‘তা আমি বুঝে নেব। তোমার চেনা কোনো ভালো এডভোকেট আছে?’
‘আছে। কিন্তু তা দিয়ে তুমি কি করবে?’
‘বলব। আগে তার ঠিকানা দেও। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
‘আচ্ছা দেব। এখন চল।’
‘হুম’
অনেকটা সময় গেটের বাইরে দাড়িয়ে থাকে রিসাদ, কিন্তু দীপ্তি আসে না। অনেক অনুরোধের পর গেটের দারোয়ান রিসাদকে ভিতরে যেতে দেয়। পুরো অফিস খুঁজেও দীপ্তিকে পাওয়া যায় না। সবার কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রীতা দীপ্তির ছুটি করিয়েছে। অফিস থেকে রীতার ঠিকানা নিয়ে ওর বাড়িতে যায়।
দুবার বেল বাজানোর পর দরজা খুলে বের হয় দীপ্তি। দীপ্তি অবাক রিসাদকে এখানে দেখে আর রিসাদ খুশি দীপ্তিকে দেখে, ওর চোখে মুখে খুশির ঝলক।
‘ওহ দীপ্তি, তুমি এখানে।’
রিসাদ দীপ্তিকে জরিয়ে ধরে.. দীপ্তি রিসাদকে সরিয়ে দেয়।
‘তুমি এখানে কেন?’
‘তোমাকে নিতে এসেছি।’
‘মানে?’
‘প্লিজ দীপ্তি ফিরে চল তুমি,নতুন মানুষের সাথে নতুন করে সবটা শুরু করি।’
রিসাদের কথায় মুচকি হাসে দীপ্তি, বলে.
‘নতুন মানুষের সাথে নতুন করে সবটা নতুন করে শুরু করবে বলেই তো তোমাদের মাঝ থেকে আমি চলে এসেছি। আমি খোঁজ নিয়েছি খুব তাড়াতাড়ি আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। তারপর তুমি তোমার মতো আমি আমার মতো।’
‘প্লিজ দীপ্তি আমাকে আমার সন্তানের থেকে আলাদা কর না।’
‘প্লিজ রিসাদ, তোমার সাথে এ সব ব্যাপারে কথা বলকে আমার ভালো লাগছে না।’
‘দীপ্তি তুমি যা বলবে আমি তাই করব, তবুও তুমি চল আমার সাথে।’
‘আমাদের ডিভোর্সের পর রিয়াকে বিয়ে সুখে থাক।’
‘রিয়া!’
‘ও, আমার প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে রিয়াকে ভুলে গেলে? তুমি না ওকে ভালবাস?
আমার অনেক কাজ পরে আছে রিসাদ, তোমার সাথে বাকি কথা না হয় কোর্টেই হবে।’
‘তুমি আমাকে আমার সন্তানের থেকে আলাদা করতে পারো না।’
‘তুমি অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছ,নতুন করে আলাদা করার বা আলাদা হবার কোনো প্রশ্নই উঠে না।’
‘বেশ তবে তাই হোক, সব কথা কোর্টেই হবে।’
রিসাদ চলে যায়। দরজায় দাড়িয়ে বাঁধ না মানা চোখের পানি মুছে নেয় দীপ্তি, যতই হোক ভালোতো বেসেছিল হয়তো এখন ভালোবাসে।
পিছন ঘুরতেই দেখে রীতা দাড়ানো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়।
‘তোর থেকে এতটা আশা করি নি রে।’
‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কিছু করার থাকে না। কতটা মানুষিক যন্ত্রণা দিয়েছে ও আমাকে। মানুষিক তৃপ্তি বলে কিছু হয় যা আমি রিসাদের কাছ থেকে পাইনি।’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে,চিন্তা করিস না। এতটা প্রেশার নিস না, পুচকুর কষ্ট হবে।’
‘পুটকু কে আমি আমার থেকে দূরে যেতে দেব না। ওই এখন আমার একমাত্র সম্ভব, বাঁচার একমাত্র আশা, আমার সবটা।’
নির্দিষ্ট ডেট এ কোর্টে উপস্থিত হয় রিসাদ আর দীপ্তি। রিসাদ বাচ্চার জন্য সব করতে পারে বলে দীপ্তিকে বাইরে হুমকি দিয়ে এসেছে। দীপ্তি কিছু না বলে চলে আসে।
দীপ্তির পক্ষের উকিল কোর্টে পুরো তাক লাগিয়ে দিয়েছে। রিসাদ আর রিয়ার ব্যাপারে সব কথা জজের সামনে বলেছে। ডিভোর্স পাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার দীপ্তি আর উকিল তাই তাই করেছে। অবশেষে তাই হয়েছে, রিসাদ আর দীপ্তির ডিভোর্স হয়েছে। জজ এটাও বলেছে, দীপ্তি না চাইলে রিসাদ বাচ্চার উপর কোনো দাবি করতে পারবে না।
জজের রায় শুনে অসহায় দৃষ্টিতে দীপ্তির দিকে তাকায় রিসাদ। এবারও দীপ্তি কিছু না বলে চলে যেতে চায় কিন্তু রিসাদ দীপ্তির পথ আটকে দাড়ায়।
‘আমার থেকে আমার সন্তানকে কেড়ে তুমি বড় ভুল করলে দীপ্তি। এর মাশুল তোমাকে দিতে হবে।
‘ভুলের কথা যদি বলেই থাক তাহলে আমি বলব, তুমি আমার থেকে আমার সুখ কেড়ে নিয়েছ,আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছ, বিশ্বাস কেড়ে নিয়যেছ। আমাদের ৬ বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক তুমি এক চুটকিতে ভুলে গেছ। তো একবার ভেবে দেখ, তোমার করা কাজ গুলো সামনে আমার কাজ একেবারে তুচ্ছ। তাছাড়া আমি চাইনা আমার সন্তান কোনো বিশ্বাসঘাতক, দুশ্চরিত্র মানুষের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠুক। আমার সন্তানের ভালোর জন্য যা করতে হবে আমি তাই করব, কেউ আটকাতে পারবে না।’
‘ব্যাস দীপ্তি, অনেক বলেছ আর না। আমার সন্তান নিজে থেকে আমার কাছে আসবে আর তুমি শুধু তা চেয়ে দেখবে, কথাটা মনে রেখ।’
‘এবারও তুমি আমার কাছে এবারও হারবে রিসাদ। তোমার প্রথম হারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমার যখন ১ম চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আসে তুমি তখনও বেকার। আমাকে তুমি চাকরিতে যেতে দিতে চাও নি, আমাকে উপরে উঠতে দিতে চাও নি। বলেছিলে, এসব করার দরকার নেই। কিন্তু আমি হাল ছাড়ি নি, আজ আমার স্যালারি তোমার চেয়ে বেশি। এটাই তোমার প্রথম হার। পরবর্তী হারের জন্য মানুষিক ভাবে তৈরী হও।’
রিসাদ দীপ্তির কথা শুনে রেগে চলে যায়।
রিসাদ যেতেই রীতা এসে দীপ্তির কাঁধে হাত রাখে। চোখে থাকা দু ফোঁটা পানি মুছে ঘুরে দায় দীপ্তি।
‘তুই এ শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যা। রিসাদের চোখে আমি হিংস্রতা দেখেছি, ও যা খুশি করতে পারে, প্লিজ তুই চলে যা এখান থেকে। ‘
রীতার কথায় দীপ্তি জোরে হেঁসে ওঠে, আশেপাশের সবাই দীপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। যে মেয়েটার কিছুক্ষণ বিবাহবিচ্ছেদ হলো, সে মেয়েটা এখন কোর্টের বাইরে দাড়িয়ে জোরে জোরে হাসছে। দৃশ্যটা সবারই দৃষ্টিকটু লাগছে, সাথে রীতারও। দূরে গাছের আড়ালে দাড়িয়ে সবটা দেখছে রিয়া, ও বুঝতে পারছে না দীপ্তির মাথায় কি চলছে।
‘এমন পাগলের মতো হাসছিস কেন তুই?’
‘এখানে উপস্থিত কেউ একজন বোঝার চেষ্টা করছে আমার মাথায় কি চলছে, কিন্তু সে জানে না আমি মাথা নয় মন দিয়ে খেলছি।’
‘তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারনা।’
‘চল, বাসায় যাই।’
‘রিসাদ তুমি বাচ্চার পিছনে পরে আছ কেন? যত নষ্টের গোড়া ওই দীপ্তি, ডিভোর্স হয়ে যাবার পরও জ্বালিয়ে মারছে।
রিসাদ একটা কথা বলতো, তুমি বাচ্চাটার কাষ্টাডি চাও কেন?’
‘দীপ্তি.. ‘
‘কিহ!’
‘হ্যাঁ দীপ্তি, দীপ্তি আমার জেদ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কিছুতেই ওর কাছে হারতে পারব না, কিছুতেই পারব না। আমার সন্তানকে আমার থেকে দূরে করার জন্য ও যা করল দা আমি মানতে পারছি না রিয়া। ও আমার ইগোতে আঘাত করেছে।
এত সাহস হয় কি করে ওর?’
‘আমার মনে হয় তুমি একটু বেশিই ভাবছ। দীপ্তি আমাদের দুজনের মাঝে থেকে চলে গেছে, এবার আমাদের এক হতে কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। প্লিজ তুমি এসব ভাবনা বাদ দেও।
তাছাড়া আমি দীপ্তির কোনো কিছু নিয়া আমার নতুন জীবন শুরু করতে পারব না, বাচ্চা তো অবশ্যই না।’
‘রিয়া!’
‘হ্যাঁ, এবার তুমি ডিসিশন নেও কাকে চাই তোমার? আমি নাকি ওই বাচ্চা? ‘
‘রিয়া তুমি এমন বলতে পারো না। বাচ্চাটা আমার অংশ, আমার।’
‘বেশ তবে তুমি তাই নিয়ে থাক। যদি কোনো দিন বাচ্চার ভুত মাথা থেকে নামে তবে তখন আমার সাথে যোগাযোগ কর।’
‘রিয়া ওয়েট, ওকে আমি বাচ্চার কথা ভাবব না। প্লিজ তুমি যেও না।
সরি রিয়া, তোমাকে মিথ্যা বলতে হল। আমি আমার সন্তানকে নিজের থেকে দূরে রাখতে পারব না আর তা চাইও না। তার থেকে বড় কথা আমি দীপ্তির কাছে হারতে পারব না। আমাকে ও বিশ্বাসঘাতক বলেছে দুশ্চরিত্র বলেছে। এসব আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারব না। আরতো মাত্র কয়েকটা মাস তারপর আমার জিনিস আমার কাছে।’
দিন দিন নিজের অস্তিত্ব প্রমান করছে দীপ্তির সন্তান। পেট অনেকটা ফুলে গেছে, খাবার খেতে কষ্ট হয়,ঘুমাতে পারে না, চলাফেরায় কষ্ট হয়।
দীপ্তি অনেক আগেই রীতাকে বলেছিল, সে রীতার বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও থাকবে। রীতা কিছু না বলে ২ বেলা না খেয়ে ছিল। এর পরে দীপ্তি এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলে নি।
বড় বোনের মতো আগলে রেখেছে। দীপ্তির মা বাবা মেয়ের এমন অবস্থাতে আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে নি। তারা অবশ্য চেয়েছিল মেয়েকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে কিন্তু রীতা দেয় নি। এতে বাবামায়ের কোনো সমস্যা হয়নি, তারা প্রায়ই আসে দীপ্তিকে দেখতে। এখন রীতা তাদের বড় মেয়ে।
এমন অবস্থায় মুড সুইং হয় তা সবার জানা। পুরোনো স্মৃতি, পুরোনো ঘা মাঝে মাঝে কাঁচা হয় আসে,যা মৃত্যু যন্ত্রনার সমান। তাও সবটা সহ্য করে নেয় দীপ্তি।
বাঁচত হবে ভালো থাকতে হবে নিজের জন্য নিজের সন্তানের জন্য।
এগিয়ে আসছে নতুন অথিতির পৃথিবীতে আসার দিন। আর অপর দিকে রিসাদের মাথায় বাসা বাঁধছে নিজের ইচ্ছে চরিতার্থ করার নতুন প্লান।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প