গাজিপুরে মামার বাড়ি বেড়াতে গেলেই দেখতাম মহিলাটিকে। জানলায় মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে বলতেন, ‘এই, এই।’
খুব ভয় পেতাম। তখন ছোট ছিলাম, ভয় পাবারই বয়স। মহিলাটির বাসা ছিলো মামার বাসার পাশেই। মেইন রোড থেকে একটু ভেতরে, শালগাছ ছাওয়া গলির পথ দিয়ে মামার বাড়ি যেতে হতো। মামার বাড়ি ছিলো সেই গলিটির শেষ মাথায়, মামার বাড়ির দরজার উত্তরেই মহিলাটির ঘরের জানালা। দরজা দিয়ে ঢুকতে বা বেরোতেই চোখে পড়তো মহিলাটিকে। কাঁচা-পাকা উশকো খুশকো চুল, ফর্সা ফ্যাকাসে মুখ, মুখে শত বলিরেখার চিহ্ন। আমাদের দেখলেই তিনি চিৎকার করতেন, ‘এই-এই।’ এরপর দুর্বোধ্য ভাষায় কি যে বলতেন, বোঝা যেতো না।
মহিলাটি অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। স্বামী মারা যাবার পরই নাকি স্ট্রোক করেছিলেন, তারপর থেকেই এই অবস্থা। ঐ ছোটবয়সে এতো কিছু তো আর বুঝতাম না। শুধু তাকে দেখলেই রুপকথার ডাইনি বুড়ির কথা মনে পড়তো। সেই রকম লাল চোখ, খোলা চুল, শীর্ণ হাতে বড় বড় নখ। আমি খুব করে চেষ্টা করতাম উনার সামনে না পড়তে। যখন মামার বাসার দরজা দিয়ে বেরোবার সময় দেখতাম জানালাটা বন্ধ, কি যে শান্তি লাগতো! কিন্তু যখন খোলা জানালায় গরাদের ফাঁক দিয়ে তার মুখটি দেখা যেত, শীর্ণ হাত বের করে আমায় হাতছানি দিতেন, সেসময়কার ভয়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কতোরাত যে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে এক বৃদ্ধ মহিলার চেয়ে থাকার দুঃস্বপ্ন দেখে, তার হিসেব নেই।
তারপর, অনেকদিন মামাবাড়ি যাওয়া হলো না। শুনেছিলাম, মহিলাটি মারা গেছেন।
তিনবছর আগের কথা। অনার্স কমপ্লিট হয়েছে, চাকরির ধান্দায় ঢুকবার আগে কয়েকদিন জিরিয়ে নিচ্ছি। জিরোনোর ফুসরতে গেলাম মামাবাড়ি। সেই মামাবাড়ির কতো যে পরিবর্তন হয়েছে- মামা নেই, মামির বয়স হয়েছে, বাড়ি মাতিয়ে রাখা মামাতো ভাইবোনগুলো জীবনের তাগিদে ছিটকে পড়েছে এদিক-ওদিক। কেবল ছোটবোন সুমী রয়েছে। ওর সাথে গল্প করেই সারাদিন কাটিয়ে দিলাম।
রাতে গেস্টরুমে ঘুমাতে গেছি। গেস্টরুমটা বাড়ির সামনের দিকে, ওটার জানালা খুললেই সামনের বাসার সেই বৃদ্ধ মহিলার জানালা দেখা যায়। আজ সেই জানালাটা বন্ধ। বাড়ির অবস্থাও জীর্ণ-শীর্ণ। এ বাড়ির লোকজন মহিলাটি মারা যাবার পরই বাড়ি বেঁচে দিয়ে চলে যান। এখন এক রিয়েল-এস্টেট কোম্পানি এখানে বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করছে। পাশের আরেকটা বাড়িও কিনবে ওরা, ওটা কিনে বড় জমির ওপর করবে অ্যাপার্টমেন্ট, সেই পাশের বাড়ির লোকদের সাথে দর-কষাকষিতে একটু দেরি হচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক হলেই ভাঙ্গা পড়বে এ বাড়ি। ততদিনে নিজের এই জীর্ণ চেহারা নিয়েই বাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকবে, সেই বৃদ্ধ মহিলাটির মতো।
আমার বুক থেকে তখন কেমন এক হাহাকার বেরিয়ে এলো। আমাদের চারপাশে সবকিছুই কেমন ক্ষণস্থায়ী, চিরকাল থাকে না কিছুই। আজ ও বাড়ি ভাঙ্গা পড়ছে, কাল হয়তো এই মামাবাড়িও ভাঙ্গা পড়বে। আর দশ বছর পর এখানে এসে আমার সেই ছোট্টবেলার মামাবাড়ির আর কিছুই পাবো না।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো কেমন এক শব্দে। উঠৈ দেখি, জানালার কপাট জোরে জোরে বাড়ি খাচ্ছে, সাথে শো শো শব্দ বাতাসের। ঝড় শুরু হয়েছে।
বিদ্যুৎ চমক, আর বাতাসের ভীষণ শব্দে কান পাতা দায়। আমার দৌড়ে জানলা বন্ধ করা উচিত, কিন্তু কেন যেন বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। আমি শুয়ে রইলাম বিছানায়, ঠিক করলাম একটু পরে উঠবো।
তখনই, কেমন একটা শব্দ শুনলাম। ঝড়ের শব্দ এড়িয়ে এ শব্দটা ঠিক আমার কানের পর্দায় এসে ধাক্কা দিলো। কে যেন অনেক দূর থেকে ডাকছে, ‘এই-এই।’
কি ব্যাপার? শব্দটা তো চেনা মনে হচ্ছে। অথচ এই ঝড়ের রাতে, তাও আবার গভীর রাত, কারো তো এভাবে ডাকবার কথা না। নাকি ভুল শুনেছি? ঝড়ো বাতাসের শব্দ কানে বিভ্রম তৈরি করেছে। হতেই পারে।
চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার। হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে বুঝলাম, বিদ্যুৎ নেই। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালাম। ঝড়ের তীব্রতা ততক্ষণে বেড়েছে, জানালাটা বন্ধ করা উচিত। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় জানালার কাছে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে যাবো, তখনই বিদ্যুৎ চমকের আলোয় এক জিনিস দেখে আমার শ্বাস আটকে গেল।
দেখি, পাশের বাড়ির সেই বন্ধ জানালাটা হাট করে খোলা। জানালার ওপাশে এক বৃদ্ধ মহিলা। তার কাঁচা-পাকা চুলগুলো খোলা, বাতাসে উড়ছে। চোখদুটো লাল। শীর্ণ হাতে বড় বড় নখ। সেই হাত জানালার গরাদ দিয়ে বের করে তিনি হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছেন।
সেই বৃদ্ধ মহিলা। কয়েকবছর আগে যিনি মারা গেছেন।
আমার মেরুদন্ড বেয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তাড়াতাড়ি জানালা লাগিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। বাইরে ঝড়ো-বাতাসের শব্দ, মাঝে মাঝে বাজ পড়বার তীব্র আওয়াজ। তারই মাঝে, একটু পরপর কারো গলা শোনা যেতে লাগলো- ‘আয়-আয়।’
রাতটা খুব আতংকে কাটলো। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিলো, তীব্র হাওয়ার বন্ধ জানালার কপাটে বাড়ি মারার শব্দ বাদেও অন্য এক শব্দ শুনছি। কে যেন সত্যি সত্যি বাইরে থেকে জানালায় বাড়ি দিচ্ছে। অন্ধকার ঘরে সে শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছে বারবার।
সকালে সব শান্ত।
নাস্তা খেতে বসলে সীমা বললো, ‘ভাইয়া, তোমার চোখদুটা লাল কেন? রাতে ঘুমাও নাই?’
আমি সীমাকে রাতের পুরো ঘটনাটা বললাম। বলতে বলতে খেয়াল করলাম, গলাটা কাঁপছে। ভয় তখনও আমার ভেতর থেকে পুরোপুরি যায়নি।
সবকিছু শুনে সীমার মুখটা শুকিয়ে গেল। ফিসফিস করে বললো, ‘তোমাকে ও ঘরে থাকতে দেওয়া উচিত হয়নি ভাইয়া। ভুল হয়ে গেছে।’
‘কেন রে? কি হয়েছে?’
সীমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘ঐ বুড়ি মহিলা মরে যাবার পর এখনও মাঝেমাঝে নাকি তাকে গভীর রাতে জানালা খুলে বসে থাকতে দেখা যায়। অনেকেই দেখেছে। রাতে এজন্য এ গলির মানুষ তেমন বের হয় না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’এমন একটা কথা এখন বলছিস। আগে বলিসনি কেন?’
সীমা মুখ নামিয়ে বললো, ‘আমি কারো কথা একফোঁটাও বিশ্বাস করি নি। জীবনে বিশ্বাসও করতাম না, যদি তোমার সাথে এমন ঘটনা না ঘটতো।