আমাদের পাশের কোয়ার্টারটায় এতো মানুষ থাকে? এটা আগে তো কখনো বুঝিনি আমরা। দলে দলে মানুষ আসছে ও বাড়ি থেকে। আর সকলের পোষাকই একই ধরণের। অদ্ভুত ধরণের একটা আলখাল্লা পরে আছে সবাই। কালো রঙের একরকম পোষাকে পুরো শরীর ঢাকা তাদের। আর মেইন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আবু মিয়া। সে সবাইকে স্বাগতম জানিয়ে ভিতরে আনছে। এতোগুলা মানুষ জমা হয়েছে, অদ্ভুত ব্যাপার একটা শব্দও হচ্ছে না। সবাই যদি চুপ করে থাকেও তবুও হাঁটাচলার একটা ন্যূনতম শব্দ তো হবে। তাও কোনো শব্দ নেই। কি হচ্ছে এসব? পাশের কোয়ার্টারের লোকগুলো কারা? আবু মিয়ার সাথেই বা তাদের কি সম্পর্ক? আমার মন বলছে কোথাও একটা ঘাপলা আছে। এই লোকগুলো কোনো অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত। আর যেগুলোর মূলে আছে আবু মিয়া। এইজন্যই বেশিদিন এই কোয়ার্টারে কেউ থাকে না। আমার এখন কি করা উচিত এসব ভাবছিলাম। এখনই নিজের উপস্থিতি ওদের জানিয়ে দিলে ওরা আরো বেশি সতর্ক হয়ে যাবে। তাই আমি চিন্তা করলাম আমি যা করবো সব গোপনে। ওরা যেনো কিচ্ছু টের না পায়।
কালো রঙের একটা ওড়না ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম যাতে অন্ধকারে বোঝা না যায়। নিজের নিরাপত্তার জন্য হাতে একটা বড় টর্চ,একটা চাকু আর মরিচের গুঁড়োর একটা প্যাকেট নিলাম। কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আয়াতুল কুরসি পড়ে শরীরে একটা ফুঁ দিয়ে নিলাম। বাহাদুর আর রাণীকে এক নজর দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি অতি সন্তর্পণে যাতে বাড়ির কারো ঘুম ভেঙে না যায়। ঘড়িতে সময় তখন প্রায় পৌনে তিনটা।
আস্তে আস্তে পা ফেলে আবু মিয়ার ঘরের সামনে চলে আসলাম আমি। ভয় পাচ্ছিলাম ভীষণ। যদিও আমি বেশ সাহসী ধরণের মেয়ে। তবুও কোথাও যেনো মনের মধ্যে কু ডাকছিলো। একেকবার মনে হচ্ছিলো ফিরে যাই এখান থেকে। কি দরকার ঝামেলায় জড়ানো। আবু মিয়া তো আর কোনো ক্ষতি করছে না আমাদের। খুব তাড়াতাড়িই এখান থেকে চলে যাবো আমরা। কিন্তু আমার অতি উৎসাহী মনটাকে নিয়ে আর পারিনা। কি হয় শেষমেষ জানতেই হবে আমাকে, নাহলে কোনোভাবেই শান্তি পাবো না।
খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম, আবু মিয়ার ঘরের দরজা যদি ভিতর থেকে বন্ধ থাকে তাহলে তো কিছুই শুনতে বা দেখতে পাবো না। কিন্তু বেশ আনন্দের সাথে আমি দূর থেকে লক্ষ্য করলাম ঘরের দরজা প্রায় অনেকটা ফাঁকা রয়েছে। এটুকু ফাঁকা দিয়ে অনেক কিছুই দেখা বা শোনা যাবে। আমি খুব সাবধানে পা টিপে টিপে দরজার বাইরে একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে নিলাম যেখান থেকে আমার সব দেখতে সুবিধা হবে আবার যদি ধরা পড়ে যাই তো পালাতে সুবিধা হবে।
আমি উঁকি মেরে ঘরের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলেও মোটামুটি ভালোই অন্ধকার কিন্তু দেখা যাচ্ছে ভিতরের সব কিছু কারণ বেশ কিছু মোমবাতি জ্বলছে ভিতরে। ঘরের মেঝেতে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু মোমবাতি আর সেগুলোকে ঘিরেই গোল হয়ে বসে আছে প্রায় গোটা বিশেক মানুষ। যাদের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে আবু মিয়া। আবু মিয়ার গায়েও একই ধরণের পোষাক। কিছুতেই মাথায় আসছে না এরা কারা? কি উদ্দেশ্য এদের? আরো অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওই মানুষ গুলোর মধ্যে শুধু পুরুষ না,মহিলারাও আছে। সবাইকে দেখতে খুব খুশি খুশি লাগছে। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই, একদম চুপ সবাই। আবু মিয়াকে দেখলাম মুখে কি যেনো বিড়বিড় করে পড়ছে আর মেঝেতে একটা লাল ইট দিয়ে কিসব আঁকিবুঁকি করছে। কেমন ধরণের একটা নকশা যার কোনো আগামাথা নেই। বাকি সবাই উৎসুক হয়ে সেই নকশা আঁকা দেখছে।
কতোক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি জানিনা। হঠাৎ ওই
মানুষগুলোর মধ্যে বয়স্ক একজন বললো,”আবু, তিনটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। তাড়াতাড়ি হাত চালাও।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। কি হবে তিনটা বাজলে? ভিতর ভিতর দারুণ উত্তেজনা অনুভব করলাম।
হঠাৎ ভিতর থেকে একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনে ভয়ে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা স্রোত নেমে গেলো। এখানে মেয়ের কান্নার আওয়াজ আসলো কোথা থেকে?
ওদের মধ্যে একজন বললো,”কেউ কিছু সন্দেহ করেনি তো আবু?”
“মেয়েটা সন্দেহ করেছিলো। আমার কাছে বিড়ালগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করেছিলো। আজ সারাদিন ওকে মন্ত্র পড়ে নিজের মধ্য থেকে নিয়ন্ত্রণহীন করে রেখেছিলাম। ও কিচ্ছু করতে পারবে না।” এই বলে বিশ্রী একটা শব্দ করে খিকখিক করে হেসে উঠলো আবু মিয়া। আমি ভয়াবহভাবে চমকে উঠে তাকালাম। তার মানে সব পূর্বপরিকল্পিত? বিড়ালগুলোকে ওভাবে আবু মিয়াই মেরেছে? আর আমাকে আজ সারাদিন আবু মিয়াই নিয়ন্ত্রণহীন করে রেখেছিলো? কে এই আবু মিয়া? কিসের এতো ক্ষমতা তার? এসব আকাশ পাতাল ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি ভিতরের ঘর থেকে টানতে টানতে একটা মেয়েকে নিয়ে আসছে দুইটা মহিলা। মেয়েটার মুখ দেখে আমি চমকে গেলাম। মোমবাতির আলোয় কি রূপবতীই না লাগছে তাকে। লম্বা চুল,দুধে আলতা গায়ের রঙ,বড় বড় চোখ। তার শরীরে নামমাত্র পোশাক। মেয়েটা আকুল হয়ে নিজের শরীর ঢাকার চেষ্টা করছে। তাই দেখে লোকগুলো বিশ্রীভাবে হাসছে। আমার মাথায় কিচ্ছু আসছে না। কি করা উচিত আমার এখন? আব্বা আম্মাকে ডাকবো? কিন্তু তাদের দুইজনেরই বা কি এমন ক্ষমতা? আশেপাশেও এতো রাতে কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না চিৎকার করলেও। এই মেয়েটার সাথে এরা কি করতে চলেছে? আমি কীভাবে বাঁচাবো এখন মেয়েটাকে?
“তিনটা বাজতে আর দুই মিনিট বাকি। যে যার অবস্থানে চলে যাও দ্রুত।” আবু মিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই লোকগুলো উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ করতে লাগলো মুখ দিয়ে। মেয়েটা অসহায় ভাবে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ওদের হাত থেকে। কোনোভাবেই পারছে না। এভাবে একে একে সবাই ছোট্ট ঘরটার মধ্যে নকশাটার কোণায় কোণায় একেকজন দাঁড়িয়ে পড়লো। মহিলাদের মধ্যে একজন মেয়েটাকে জোর করে চেপে বসিয়ে দিলো নকশাটার ঠিক মাঝে। তার চার পাশে জ্বলজ্বল করছে মোমবাতি গুলো। আমার হাত পা কাঁপছে থরথর করে। জানিনা মেয়েটার সাথে কি হতে চলেছে। আমি কি মেয়েটাকে বাঁচাবো? আমি কি পারবো এতোগুলো মানুষের সাথে? আমি নিজেও তো বিপদে পড়বো। আমার আব্বা আম্মা কোনোদিনও জানতে পারবে না তাদের মেয়েটা কোথায় গেছে। কিন্তু এমন অসহায় একটা মেয়েকে এভাবে ফেলে চলে গেলে আমি নিজেও তো নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। আমার মন বলছে তিনটা বাজলেই এই মেয়েটার সাথে ভয়ানক কিছু হতে চলেছে। যা করার আমাকে এখনই করতে হবে। কিন্তু কি করবো আমি?
মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো হঠাৎ। সবার সামনে হাতজোড় করে বললো,”আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমি কাউকে কিছু বলবো না তোমাদের কথা। আমাকে মেরো না। আমাকে এখান থেকে যেতে দাও।”
আবু মিয়া সহ চারপাশের লোকগুলো খিকখিক করে হেসে উঠলো মেয়েটার কথা শুনে। বয়স্ক লোকটা একটা মোটা ছুড়ি এনে আবু মিয়ার হাতে দিলো। মোমের আলোয় চকচক করে উঠলো ছুড়িটা। আমি চমকে উঠলাম আবার। তবে কি এই ছুড়ি দিয়ে মেয়েটাকে খু*ন করবে এরা? আমাকে দেখতে পেলে তো আমাকেও মেরে ফেলবে।
আবু মিয়া বিড়বিড় করে আবার কি যেনো মন্ত্র পড়তে লাগলো, সেই সাথে তালে তালে একই মন্ত্র বাকিরাই পড়তে শুরু করে দিলো। তিনটা বাজতে আর মনে হয় কয়েক সেকেন্ড বাকি। আমি ঠিক করলাম আমার আব্বাকে ডেকে আনবো দৌড়ে যেয়ে। আব্বা পুলিশকে ফোন দিবে। ইশ! এই চিন্তাটা আগে কেনো মাথায় এলো না? কি ভুলটাই না করেছি। পুলিশ এলেই এরা ঠিক ঠান্ডা হয়ে যাবে। আর বেশি সময় নেই, এক্ষুনি আব্বাকে ডেকে আনতে হবে এই ঘরের সামনে। কিছু সময় এদের ভুলিয়ে রাখতে হবে ভয়ভীতি দিয়ে, এরমধ্যে পুলিশ চলে আসবে। আমি পিছে ফিরতে যাবো ঠিক এমন সময় আমার ঘাড়ে কারো একটা অত্যন্ত ঠান্ডা বরফশীতল হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠি আমি। আমার হৃৎপিণ্ড গলার কাছে এসে ধকধক করতে থাকে।
“তুই কে? এখানে কি করিস?”
ভারী একটা মোটা গলার আওয়াজ পেলাম পিছন থেকে। সেই আওয়াজ শুনে ভিতরের লোকগুলো চমকে ওঠে। সবাই অদ্ভুতভাবে চোখ সরু করে দরজার বাইরে আমাকে দেখতে পায়। আমি বুঝতে পারলাম আজই হয়তো আমার জীবনের শেষদিন।