গল্পটা আমার খালামণি বলেছিলেন। ‘বুঝেছিস, তখন তো আমার নতুন বিয়ে হয়েছে, শ্বশুড়বাড়িও গ্রামে। আমি শহরের মেয়ে, গ্রামে কি কখনো থেকেছি? তোদের নানা ভালো ছেলে দেখেই বিয়েটা দিয়ে দিলেন। আমিও না করার সুযোগ পেলাম না। তোদের খালুর সাথে ঢাকাতেই থাকি, ঢাকাতেই তো চাকরি ছিলো তোদের খালুর, কিন্তু প্রথম কুরবানির ঈদ তোদের খালু গ্রামে করবে। তাই তোদের খালুর সাথে গ্রামের বাড়িতে রওনা দিলাম। ঐ ঈদটা ছিলো বাবা-মাকে ছাড়া আমার প্রথম ঈদ। খুবই খারাপ লাগছিলো, বুঝতেই পারছিস।’
আমরা বসেছি ছাদের ওপর পাটি পেতে। গরমকাল, কিন্তু ছাদের ওপর বাতাস থাকায় গরমটা তেমন লাগছে না। আমরা সব কাজিন আজ একসাথে হয়েছি, খুব একটা এমন একসাথে হবার সুযোগ হয় না। উপলক্ষ হলো বিয়ে, খালাতো বোনের বিয়ে। আপুকে শ্বশুড়বাড়ি পাড় করে দিয়ে এসে আমরা বসেছি গল্প করতে। মেয়েকে দূরে পাঠানোর দুঃখ লুকিয়ে খালা গল্প বলা শুরু করেছেন। আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। খালা কখনো আমাদের এভাবে তার বিয়ের গল্প বলেননি।
‘শ্বশুড়বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের খুব রাত হয়ে গেলো। আব্বা মানে আমার শ্বশুড় ঘাটে এসে দাঁড়িয়েই ছিলেন, সেই মাঝরাতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। রাত হলেও আশপাশের মানুষ ঘরে এসে ভীড় করে ফেলেছিলো আমাকে দেখার জন্য। আমার খুব লজ্জা লাগছিলো তখন। শুধু একটা বিয়ের জন্যই একটা গ্রামে এমন সেলিব্রেটি হয়ে যাবো, ব্যাপারটা আসলে ধরতে পারিনি তখনও।’
খালামণি মুচকি হাসলেন। তার হাসি দেখতে খুব সুন্দর লাগছিলো। আমরাও তার সাথে হাসিতে যোগ দিলাম। আমাদের স্মার্ট শহুরে খালামণি গ্রামে গিয়ে কি বিপদেই না পড়লেন, সেসব হাসির গল্প শোনার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো আমাদের।
‘খেতে বসে আরো অবাক হয়ে গেলাম। এলাহি কারবার করা হয়েছে আমার জন্য। রুই, কাতল, সিলভার কার্প মাছ, খাসি, মুরগি, হাঁসের গোস্ত, ডিম, সবজি, কি নাই ঐখানে। জার্নি করে কি অতো খাওয়া যায়? তাও আমার পাতে সমানে খাবার দেয়া হচ্ছে। শেষে তোদের খালুর কানে আস্তে আস্তে বললাম, ‘আর খেতে পারবো না।’ খালুই তখন ধমক ধামক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলো।
এরপর ঘুমানোর পালা। আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে বাড়ির সবচেয়ে কোণার ঘরটায়। তোদের খালু কেন জানি গাইগুই শুরু করে দিলো, ঐ ঘরে থাকতে চাচ্ছিলো না। কিন্তু বাড়িতে এতো মেহমান, অন্য কোনো ঘরে ঘুমানোর সুযোগ নেই। তাই ঐ রুমেই ঘুমাতে হলো। ঐদিনও আজকের মতোই গরম পড়েছিলো। গরম লাগছিলো দেখে জানালা খুলতে গেলাম। তোদের খালু হঠাৎ চিৎকার করে বললো, ‘খবরদার, জানালা খুলবা না।’ কেন যে বললো, বুঝতেও পারলাম না, ভয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারলাম না। শেষে গরমের মধ্যেই ঐ ঘরে রাত কাটাতে হলো।’
খালামণির হাসির গল্প কখন যে রহস্য গল্পের দিকে বাঁক নিলো, টেরই পেলাম না। তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমার শ্বশুড়বাড়ির এই জিনিসটাই আমার অদ্ভুত লাগলো। তারা ঐ ঘরের জানালা খুলতে দেন না। এটা অবশ্য কেবল রাতের বেলা, দিনের বেলায় না। দিনে আমি সুন্দর করে জানালা খুলি। জানালা দিয়ে পুকুরঘাট দেখি, পুকুরের ওপাশের ধানক্ষেত দেখি। ধানক্ষেতে সবুজ ধান। যখন বাতাস বয়, সবুজ সমুদ্রের মতো ঢেউ খেলে যায় ধানক্ষেতে। পুকুরে দুপুরের রোদ পড়ে চারদিক আলো হয়ে থাকে, অদ্ভুত সুন্দর লাগে তখন পুকুরঘাট দেখতে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে এসব দৃশ্য দেখতে। আমার ভালোই লাগে।
আমরা যেদিন ঢাকা চলে আসবো, তার আগের দিনের ঘটনা। তোদের খালু গেছে তার কোন এক আত্মীয়ের বাড়ি, জমিজমা নিয়ে কি এক সালিশের কাজে। ফিরতে রাত হবে। আমাকে বলেছে যেন ঘুমিয়ে পড়ি। আমি তো ঘুমাবো, কিন্তু সেদিনও খুব গরম লাগছে, আর ঘুমও আসছে না। তাই ঠিক করলাম একটু বাতাস আসার জন্য জানালাটা খুলে দেই। জানালাটা খুললাম। সাথে সাথে একমুঠো ঠান্ডা বাতাস এসে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে দিলো। কি যে ভালো লাগলো, তোদের বোঝাতে পারবো না। এর উপর বাইরের দৃশ্য যে কি সুন্দর! চাঁদের আলোয় পুরো ধানক্ষেত বিরান ভুমির মতো লাগছে। চারদিকে কেবল জোছনার রুপালি আলো। জোছনার আলো পুকুরের পানিতে পড়ে ঝলমল করছে। আমার চোখ জুড়িয়ে গেলো সেই আলো দেখে। ঢাকার এতো বিদ্যুতের আলোর মধ্যে তেমন মায়াবি আলো আর দেখাই যায় না।
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম। শান্ত পুকুর, পুকুরে রুপালি জোছনা, দূরে বিরান ভূমির মতো দেখতে ধানক্ষেত। আশেপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো উপন্যাসে পড়া কোনো দৃশ্য চোখের সামনে দেখছি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলাম।
জোছনার রুপালি আলো দেখতে দেখতেই হঠাৎ অদ্ভুত এক জিনিস খেয়াল করলাম আমি। ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে গেছে। চারদিক কেমন যেন চুপচাপ, নিস্তব্ধ। সেসময়টায় আসলে অনেক রাত হয়েছে, বাড়ির সব মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও নিস্তব্ধতাটুকু খুব অসহ্য লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো পুরো পৃথিবীতে কেবল আমিই আছি, আর কেউ নেই।
হঠাৎ পুকুরের পানিতে কেমন একটা শব্দ হলো, যেন কিছু একটা পড়েছে পানিতে। তাকিয়ে দেখি, কি যেন একটা ভাসছে পুকুরের ভেতর।
চাঁদের আলোয় জিনিসটা কি প্রথমে বুঝতে পারলাম না। কালো একটা জিনিস, নারিকেলের ছোবড়ার মতো লাগছিলো। পুকুরের পাশে অনেক নারিকেলের গাছ, তার কোনোটা থেকে নারিকেল হয়তো পুকুরের পানিতে পড়েছে।
আমি দূরে ধানক্ষেত দেখতে থাকি। সেদিকটা অনেক অন্ধকার। চারদিক নীরব হয়ে যাওয়ায় ধানক্ষেতের দিকে যেন অন্ধকার জমাট বেঁধেছে কুয়াশার মতো। কেবল পুকুরেই কিছুটা চাঁদের আলো আছে। সেই আলোও যেন ম্লান হয়ে পড়েছে। চাঁদকে কিছুটা মেঘ ঢেকে ফেলেছে আকাশে।
জিনিসটা ভাসতে ভাসতে ঘাটের কাছে এলো। ওটায় কি যেন জ্বলজ্বল করছে। ভালো করে তাকাতেই ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে গেলো। দেখি, জ্বলজ্বল করতে থাকা জিনিসটা একজোড়া চোখ। যেটাকে নারিকেল ভাবছিলাম, সেটা আসলে একজন মানুষ, পুকুরে ডুব দিয়ে মাথা বের করে রেখেছে কেবল। মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
সে আস্তে আস্তে ঘাট বেয়ে উঠে এলো। আমি বিস্ময়, ভয় আর আতংক নিয়ে দেখলাম, জোছনার আলোয় ঘাট বেয়ে একটা ছোট্ট মেয়ে উঠে আসছে। মেয়েটার মুখটা ফ্যাকাশে, চোখদুটো নির্জীব। সারা গায়ে শ্যাওলা।
আমি তাড়াতাড়ি ভয়ে জানালা আঁটকে দিলাম। এরপর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার হাত পা কাঁপছিলো। আমি ভয় কি করবো, কাকে ডাকবো বুঝতে পারছিলাম না।
অনেকক্ষণ কেটে গেলো। ভয়টা কমে এসেছে। বাইরে ঝিঁঝিঁর শব্দও শুরু হয়েছে। নিজেকে বোঝালাম, হয়তো কল্পনা ছিলো। অথবা পাশের বাড়ির কোনো বাচ্চা সাঁতার কাটছিলো, চাঁদের আলোয় বিভ্রম তৈরি হয়েছে। যাই হোক, ভয়ের কিছু নেই। এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়তে হবে। তোদের খালু আসা পর্যন্ত আর অপেক্ষা করা যাবে না।
হঠাৎ, জানালায় টোকা পড়লো। কে যেন জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
ভয়ে আমার সারা শরীর হিম হয়ে এলো। জানালার কবজা কাঠের, তাতে ছোট ছোট ফুটো, তা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে। আমি একটা ফুটো দিয়ে বাইরে তাকালাম। আর তাকাতেই দেখলাম, সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে জানালার বাইরে। তার মুখে হাসি। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, তার দৃষ্টি একদম আমার দিকে।
আমি চিৎকার করে উঠলাম। সাথে সাথেই তোদের খালু এসে ঘরে ঢুকলো। সে এসেছে একটু আগে, হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’ আমি তাকে সবটা বললাম।
শুনে সে একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘আরে ধুর, চাঁদের আলোয় কি দেখেছো উল্টাপাল্টা! মাঝে মাঝে পাশের বাসার বিন্তি রাতে গোসল করে, ওকেই মনে হয় দেখেছো। আর কোনো রাতের পাখি মনে হয় জানালায় এসে ঠোকর দিয়েছিলো, ওটাকেই টোকা ভেবেছো। এখন ঘুমাও তাড়াতাড়ি। কালকে সকালে উঠেই কিন্তু লঞ্চ ধরতে হবে।’
বলেই সে আমার পাশে শুয়ে পড়লো। আমিও শুয়ে পড়লাম। আর কোনো শব্দ হলো না বাইরে। তোদের খালু আসাতেই মনে হয় একটু সাহস এসেছিলো মনে, তাই এতোক্ষণের না আসা ঘুমটা হঠাৎ করেই চলে এলো। ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন লঞ্চে করে ঢাকায় ফিরে এলাম। এরপর আরো অনেকবার গেছি তোদের খালুদের বাসায়। কিন্তু সেই জানালা আর কখনো খুলিনি রাতের বেলায়।’
খালামণি থামলেন। চিরকালের হাসিখুশি খালার মুখে এমন ভয়ের গল্প শুনে আমাদেরও ভয়ে ঘাম ছুটে গেছে। খালামণি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি সবাই নিচে চলে যা। ঘুমাতে হবে। কালকে তো আবার বৌভাতের অনুষ্ঠান, সকাল সকাল জাগতে হবে।’
আমরা বললাম, ‘খালা, এখানেই গল্প শেষ?’
‘হু। আর কি শুনতে চাও?’
‘আর কিছু নেই বলার।’
‘না। আর কিছু নেই।’
‘খালু কিছু বলেন নাই তোমাকে?’
‘উহু। না।’
‘অবশ্যই বলেছিলেন। একটা কথা তো আপনার মনে আসার কথা ছিলো খালামণি। খালু সেই রাতে এতো কথা বললেন আপনাকে, অথচ তিনি নিজে জানালা খুলে দেখলেন না বাইরে সত্যিই কিছু আছে কিনা। তারমানে বাইরে সত্যিই কিছু একটা ছিলো, আর সেটা তিনি জানতেন। তাই না?’
খালামণি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোরা অনেক চালাক। ব্যাপারটা আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম না। যতটুকু বলেছি, তাতেই ব্যাপারটা অনেক অদ্ভুত হয়ে গেছে।’
‘আরে বলেন। সমস্যা নাই।’
‘তোরা যে প্রশ্নটা করেছিস, সেটা আমার মাথাতেও এসেছিলো। এটা ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু সে কোনো উত্তর দেয় নাই। অনেকদিন কোনো উত্তর দেয় নাই। কেবল এক সপ্তাহ আগে, মানে মিলির বিয়ের কেনাকাটা যেদিন করি, সেদিন রাতে সে এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিয়েছিলো।’
‘কি উত্তর?’
‘সে বলেছিলো, ‘জানো, তোমাকে আমার বোনের গল্প বলেছিলাম না, পুকুরে ডুবে মারা যায় আমার ভুলের জন্য। ওকে বাড়িতে একা রেখে বাইরে চলে গিয়েছিলাম বলে। পরে জোছনা রাতে ওর লাশটা পুকুরে ভাসতে দেখা যায়।’
‘হু, বলেছিলা।’
‘সেই রাতে তুমি যাকে দেখেছিলা, সে হলো আমার সেই বোন…’