লেপটপ টা আরো ঘাটতে যাবো ঠিক তখনই ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেলাম।
সুগন্ধীর কল্যানে বুঝতে পারলাম শায়লা ঘরে প্রবেশ করেছে। এবং ঠিক তখনই আমার খেয়াল হলো, শায়লার ড্রয়ারে যে পিস্তলটি থাকে সবসময় সেটি আজ ড্রয়ারে ছিলোনা….
শায়লা রুমে ঢুকে দেখলো তার ল্যাপটপ অন করা। শান্ত ভঙ্গিতে ল্যাপটপটা অফ করে ডানদিকের পর্দার দিকে একটা স্মিত হাসি দিয়ে ও চলে গেলো স্নানঘরে।
শায়লার কার্যকলাপ দেখে আমি খানিকটা বিষ্মিত হলাম। নিঃসন্দেহে শায়লা আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে। তারপরও শায়লা কিছু বললোনা। উল্টো এমন ভঙ্গি করলো যেনো ও আমাকে দেখতেই পায়নি।
তাহলে কি শায়লা আমাকে সাহায্য করছে? হয়তো তাই। তাহলে মুখে বলছেনা কেনো?
আমি খানিকটা চিন্তিত হয়ে ভাবলাম শায়লার সাথে কথা বলবো। ঠিক তখনই আমার মনে হলো, শায়লা আমাকে জানাতে পারলে আগেই জানাতো। নিশ্চিত এমন কিছু হয়েছে যার কারণে শায়লা আমার সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারছেনা।
সুতরাং, আমার এখান থেকে চলে যাওয়াটাই উচিত।
আমি আর অপেক্ষা না করে চলে আসলাম ঘর থেকে।
•
অফিসে বসে ঘাটতে লাগলাম শায়লার ল্যাপটপ থেকে পাওয়া চিত্রগুলো। শায়লার পাশের ভদ্রলোকটির পরিচয়ও আমি কোনভাবে উদ্ধার করতে পারছিলাম না। কেননা, আমাদের ডাটাবেসে এই চেহারার মানুষের কোন তথ্য নেই। অর্থ্যাৎ, মানুষটি আমাদের দেশের কেউ না।
হতাশ হয়ে আমি সিগারেট ধরালাম। ঠিক তখনই আমার মনে পড়লো আরেকটি ছবির কথা। অপরিচিত ভাষায় কিসব যেনো লেখা ছিলো সেখানে।
আমি সেই ছবিটি থেকে শব্দ টুকু নিয়ে খুঁজতে লাগলাম। এবং আবিষ্কার করলাম, ওখানে কিছু শব্দ জার্মান ভাষায় লেখা। শব্দগুলিকে আক্ষরিক অনুবাদের পর যা উদ্ধার করতে পারলাম তা হলো, ক্যানিবালিজম, আরমিন মাইভাস ও নেসার মাইকন।
বুঝলাম বাকী শব্দগুলা ছদ্মশব্দ। যার অর্থ উদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
তাই বাধ্য হয়ে আমি ইন্টারনেটে ক্যানিবালিজম, আরমিন মাইভাস ও নেসার মাইকন শব্দগুলি খুঁজতে লাগলাম। এবং এই খোঁজার ফলাফলে যা পেলাম:
ক্যানিবালিজম: এর অর্থ নরমাংস ভক্ষণ। অর্থ্যাৎ, একজন মানুষ আরেকজনের মাংস ভক্ষণ করে।
আরমিন মাইভাস: একজন জার্মান মানুষ, যিনি ইন্টারনেটে দ্যা ক্যানিবাল ক্যাফে নামের ওয়েবসাইটে একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২১ থেকে ৪০ বছরের সুঠামদেহী জবাইযোগ্য ও আহার হতে চাওয়া মানুষের সন্ধান চেয়েছিলেন।
তার এই বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়েছিলো বার্ন্ড জুর্গেন ব্রান্ডিস নামের একজন মানুষ।
পরবর্তীতে তিনি ব্রান্ডিসকে খুন করে, ফ্রিজের মধ্যে তার মাংস দশ মাস ধরে সংরক্ষণ করে ভক্ষণ করে!
কিন্তু, নেসার মাইকন সম্পর্কে আমি কোন তথ্য আবিষ্কার করতে পারলাম না।
সুতরাং, আমার বুঝতে বাকী রইলোনা নেসারই সেই স্থিরচিত্রের ভদ্রলোক। যেহেতু ওয়েবে কোন তথ্য নেই, তাই আমি সাহায্য নিলাম আমেরিকার এফবিআইতে থাকা আমার বন্ধুর, যার সাথে ট্রেনিংয়ে আমার পরিচয় হয়েছিলো।
সে আমাকে জানালো, নেসার ছিলো আরমিন মাইভাসের শিষ্য। শুধু নেসার না, নেসারের একজন বান্ধবীও ছিলো। পরবর্তীতে নেসারের বান্ধবী সব ছেড়ে ছুড়ে আমাদের দেশে চলে আসে।
আমি বুঝলাম শায়লাই ছিলো সেই বান্ধবী। ঠিক সেই সময় আমার মনে পড়লো, ফরেনসিক ল্যাবে প্রথম যখন আমি শায়লাকে মূর্দার সাথে দেখতাম, তখন ওর মধ্যে কেমন যেনো এক হিংস্রতা কাজ করতো। এবং ঐ হিংস্রতাকে ভালোবেসেই আমার সাথে শায়লার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো! এবং সেই সম্পর্ক পরবর্তীতে বিবাহতে রূপান্তর নিয়েছে!
যাই হোক, আমি ওর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে খোঁজ করলাম। সেখান থেকে জানলাম নেসার কিছুদিন আগে দেশে এসেছে। তারপর, ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে আমেরিকা থেকে আগত যাত্রীদের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে চিহ্নিত করলাম নেসারের আসল রূপ।
এবং বিষ্মিত হয়ে আবিষ্কার করলাম, প্রথমদিন যেই ভদ্রলোককে আমি ঘুষি মেরেছিলাম সেটাই ছিলো নেসার। সুতরাং, নেসারের খেলা আজ রাতেই শেষ।
আমার হাতে বিস্তর সময় দেখে আমি সিগারেট টানতে টানতে শায়লার অবস্থান বিবেচনা করলাম।
শায়লা তার পুরনো জীবনে ফেরত যেতে চাচ্ছিলোনা। কিন্তু, নেসার তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। সম্ভবত, নেসার শায়লাকে ২৪ ঘন্টা মনিটরিং করতো, তাই ও আমাকে না বলেই আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে। ও জানতো আমি এইসময় ঘরে এইরাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরবো তাই ইচ্ছে করেই আমার সামনে দেখা দিয়েছে। সবই তো বুঝলাম।
কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না, নরমাংস তো মানুষেরাই খেতো, তাহলে মৃত্যুকূপ কেনো বানিয়েছিলো?
আর, পতিতাপল্লীকেই কেনো বেছে নিলো ওরা?
•
সময় রাত ১০ টা।
মৃত্যুফাঁদের কাছে টানতে টানতে শায়লাকে নিয়ে আসলো নেসার। খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলায় মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো ওর। কোনভাবেই ও শায়লার এই অসম্ভবকে সম্ভব করা মানতে পারেনি।
রাগে ক্ষোভে যেই শায়লাকে ও ফেলে দিতে গেলো পুকুরটাতে, সাথে সাথে পেছন থেকে কথা কানে আসলো,
ওকে ছেড়ে দাও না হয়, তোমাকে গুলি করে দিবো।
নেসার কথাটি শুনে হাসতে হাসতে বললো, আমি এমনিতেও মরবো, ওমনিতেও মরবো।
নেসারের এই হঠাৎ চমকে গিয়ে মনোযোগ হারিয়ে ফেলার সুযোগ নিয়ে শায়লা নেসারকে একধাক্কায় ফেলে দিলো পুকুরটিতে।
সাথে সাথে জোকেরা ওর সারা শরীরকে ঘিরে ধরলো। আর নেসার চিৎকার করতে লাগলো।
অদ্ভুত তাইনা, যে কারণে ও বেছে নিয়েছিলো পতিতাপল্লীকে, সেই একই কারণে ও আজ নিজেই ফেসে গেলো।
রাতের অন্ধকারে জেগে উঠা পতিতাপল্লীতে আর্তনাদের শব্দে কেউ কখনো কান দেয়না। এতো আর্তনাদের মাঝে কোনটা আনন্দের আর কোনটা মৃত্যুর সেটা কখনো আলাদা করা যায়না।
আর, এইজন্যেই বেছে নেওয়া হয়েছিলো পতিতাপল্লীকে।
নেসারের মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর পার অনিকেত শায়লাকে জরিয়ে ধরলো। ভালোবাসার দাবী বোঝাতে উষ্ঠের সাথে অধোর মিলিয়ে দীর্ঘ চুম্বনে মেতে উঠেছিলো। ঠিক সেই সময় অনিকেতের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে শায়লা ওকেও ঠেলে দেয় মৃত্যুকূপে।
অনিকেত বুঝতে পেরে তীব্র আর্তনাদের বদলে নিঃশ্চুপ হয়ে রইলো। ভালোবাসার এই পরিণতি দেখে কিছুটা বিষ্মিত বোধ করছিলো সে।
অনিকেতের এই নিঃস্তব্ধতায় শায়লার বুকের ভেতর কেমন যেনো কষ্ট হতে লাগলো। কারণ, এই লোকটা ওকে ভালোবাসতো, আর সেও এই লোকটাকে ভালোবাসতো।
ভালোবাসার মানুষটি যে জিনিসটি অপছন্দ করতো সেটি হলো রহস্য উদঘাটন করতে না পারা। তাই, মৃত্যুর শেষ মুহুর্তে শায়লা সেই মৃত্যুকূপের রহস্য উন্মোচন করলো অনিকেতের কাছে।
“আরমিন মাইভাস নরমাংস ভক্ষণ করতো। আর আমরা করতাম বিশেষ কয়েকটি অঙ্গ। কেননা, এই হিশেষ কয়েকটি অঙ্গে প্রচুর প্রোটিন থাকতো, যা আমাদের মানসিক শক্তিকে আরো বাড়িয়ে তুলতো।
শরীরের বাকী অংশ ফেলে দিলে আমরা ধরা পড়ে যেতাম। তাই মৃত্যুকূপে ফেলে দিয়ে রক্তমাংস সব নিশ্চিহ্ন করে দিতাম। আর বাকী যা থাকতো অর্থ্যাৎ, হাড় বা কঙ্কাল তা বিক্রি করে দিতাম।
বিক্রির পর যে টাকা আসতো, তা দিয়ে আমরা এই পতিতালয়ের বেশ কয়েকটি অংশ আমাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য ভাড়া নিতাম।
এই হলো তোমার অজানা পতিতালয় ও মৃত্যুকূপের রহস্য।”
শায়লার কথা শুনে অনিকেত বললো, তাহলে আমাকে কেনো মারতে হলো?
আনিকেতের শেষ প্রশ্ন শুনে শায়লা আর কোন উত্তর না দিয়ে চলে আসলো।
•
ঘরে এসে চুপ করে বসে রইলো শায়লা। অনিকেতের শেষ প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারেনি। আর, এই কেসের শেষ অংশটুকু অনিকেত সমাপ্ত করতে পারিনি।
তাই শায়লা অনিকেতের অসম্পূর্ণ লেখাটিকে সমাপ্ত করলো।
আর, অনিকেতের সেই শেষ প্রশ্নের উত্তরটি লিখে গেলো ওর ব্যক্তিগত ডায়েরীতে,
ব্যক্তিগত জিনিস কিংবা কাজকে কখনো জানতে হয়না। কেননা, সেখানে থাকে এমন অনেক কথা যা শুধু সেই একজন মানুষ নিজে জানতে পারে, অন্য কেউ না।
অনিকেত আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা জেনে গিয়েছিলো। তাই, নেসারের সাথে ওকে মেরে ফেলে আমি আমার ব্যক্তিগতকে চিরদিনের জন্য একান্ত ব্যক্তিগত করে ফেললাম।
কারণ, ব্যক্তিগতরা ব্যক্তিগত থাকে; তাকে জানার অধিকার কারো নেই।