-যদি আপনার নিজের ডায়রীটা একদিনের জন্য আমাকে দেন তাহলেই আপনার স্ত্রীর ডায়রীটা ফেরত দেবো।
~আপনিও দেখছি আমার স্ত্রীর মত অদ্ভুত মানুষ। ঠিকাছে, কখন ও কোথায় আসতে হবে আমাকে?
-আমি ঠিকানা মেসেজ করে দিচ্ছি, কাল সকাল দশটায় দেখা হবে।
ফোনে কথা শেষ করে বাকি ডায়রীটা যেই পড়া শুরু করবো অমনি দেখি আম্মু দরজায় দাড়িয়ে আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
~ফোনে কাকে কি ঠিকানা দিবি বললি? আর তোর হাতে সবুজ রঙের এটা কি?
-এটা হচ্ছে একটা মেয়ের ডায়েরী।
আম্মু কিছু বলতে চাচ্ছিল, আমি বাঁধা দিয়ে বললাম,
-দাড়াও দাড়াও, পুরো কথা শেষ করতে দেও। এই ডায়রীটা পথের পাশে পেয়েছি। তাই কল করে ঠিকানা দিচ্ছিলাম ফেরত নেয়ার জন্য।
মাথায় একটা সুন্দর বুদ্ধি আসলো। এক বিশেষ লোভে আম্মুকে বললাম,
-আম্মু তুমি বসো, আমি ডায়রীটা পড়ি, তুমি শুনো।
~আরে নাহ, আমার কাছে ডায়েরি শোনার মত সময় নেই।
আম্মুকে টান দিয়ে বিছানায় বসিয়ে বললাম,
-শুনেই দেখো না, বেশি সময় লাগবে না।
এরপর সবুজ ডায়রীটার বাকি অংশ পড়তে শুরু করলাম,
—আজকে ফজরের আযানের সময় আমি আগে উঠে যাই, দেখি উনি ঘুমাচ্ছেন। ভাবলাম আজকে মজা দেখাবো। এক জগ পানি উনার গায়ে ঢেলে দিলাম। উনি ঘুম থেকে জেগে থতমত খেয়ে বললেন,
~আরে আরে, করলেনটা কি!
আমি হাসতে হাসতে দৌড় দিলাম অন্য ঘরে আর তখনি সোফার পায়ার সাথে উষ্টা খেয়ে ধপাস করে পড়লাম ফ্লোরে। উনি তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে বিছানায় শুয়ে দিলেন আর বললেন,
~দেখলেন তো জামাইয়ের গায়ে পানি ঢালার শাস্তি।
—আজকে মার্কেটে গিয়ে উনার জন্য একটা অফিসের ব্যাগ পছন্দ করেছিলাম। বিয়ের পর থেকে দেখে আসছি উনি অফিসে পুরোনো একটা ব্যাগ নিয়ে যান। তাই আজকে উনাকে ব্যাগটা দেখালাম, জিজ্ঞেস করলাম, পছন্দ হয়েছে কিনা। উনি কিছুক্ষণ ব্যাগটা দেখে বললেন,
~আরে নাহ, এতো ভালো না, পরে ভালো দেখে একটা নেয়া যাবে।
কিন্তু আমি ঠিকই বুঝেছিলাম, আজকে যদি উনি এই ব্যাগটা কিনতেন তাহলে মাস শেষে খরচের টাকায় টান পড়তো। বাসায় ফেরার পথে খুব খারাপ লাগছিলো। নিয়ত করলাম, আগামী দুই মাসের মধ্যে সংসারের টাকা কিছু কিছু বাঁচিয়ে উনাকে এই ব্যাগটা আমি উপহার দেবো।
—হঠাৎ করে উনার ইচ্ছে হলো আমাকে রান্না করে খাওয়াবে। তাই বললেন আজ আমার ছুটি। দুপুরে উনার রান্না করা গরুর গোশত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-এত ভালো রান্না কোথা থেকে শিখেছেন?
~আরে নাহ, তেমন কই পারি। তবে মায়ের রান্না দেখে দেখে টুকটাক শিখেছিলাম।
একটু পর উনি খেতে বসলেন। এক লোকমা মুখে দিয়েই অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
~মিথ্যা বললেন কেনো, এই খাবার তো মুখেই দেয়া যাচ্ছে না।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
-আরে বুঝলেননা, মাঝে মাঝে মিথ্যা প্রশংসা করেও আনন্দ আছে। ~আমার থেকে শিখে আমাকেই জ্ঞান দেয়া হচ্ছে।
-আসলে আপনি নিজে খাওয়ার পর কি করেন সেটা দেখার জন্যই কিছু বলি নি।
—আজ উনি অফিসে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই একটা উপহার আসে বাসায়। কিছু ফুল, আর একটা চিরকুট। চিরকুট খুলে বুঝলাম উপহারটা আমার স্বামীর উদ্দেশ্যেই এসেছে। চিরকুটের শেষে লেখা ছিল, “জানেমান তোমার জন্য”। উনি অফিস থেকে ফেরার পর উপহারগুলো দেখালাম। উনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন। বললেন,
~আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
-আরে টেনশন নিয়েননা। আমাদের মাঝে ঝগড়া লাগানোর জন্যই কেউ এমনটা করেছে।
~মানে?
-যে পাঠিয়েছে, সে ভালো করেই জানে আপনি তখন অফিসে ছিলেন। তাই আপনার জন্য এইগুলো পাঠিয়ে আমার মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো।
—কাপড় ধুচ্ছিলাম, আর উনি পেছন থেকে এসে বালতি ভর্তি পানি মাথার উপড় ঢেলে দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম,
-এইরকম বিটলেমি করলেন কেনো?
~মনে নেই, সেদিন আমার উপর পানি ফেলেছিলে। আজকে সেটার প্রতিশোধ নিলাম।
-অপেক্ষা করেন, আমি এর থেকেও ভালো প্রতিশোধ দেখাবো।
—আজকে উনি আমার সাথে জান্নাতের কথা আলোচনা করছিলেন। আমি বলে উঠলাম
-আমরা তো জান্নাতে স্বামী-স্ত্রী অনন্তকালের জন্য একসাথে থাকতে পারবো।
~অবশ্যই, কিন্তু আমাদেরকে এর জন্য নেক আমলের পাশাপাশি গুনাহ থেকে বাঁচতে হবে। সকল ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে হবে, জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মানতে হবে।
—আজকে উনি আমার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। আমি বললাম
-আশে পাশের মানুষ যদি জানতে পারে আপনি স্ত্রীর চুলে তেল দিচ্ছেন, তাহলে তো আপনাকে সবাই বউ পাগলা ডাকবে।
~অফিসের সবাই আমাকে বউ পাগলা নামেই ডাকে, এটা জানলে আর তেমন কিছু হবে না।
—আজকে গোসলের জন্য উনি বাথরুমে ঢুকেছিলেন। সাবান মেখে যেই ঝর্না ছাড়লেন, অমনি বাসার পানির পাইপের লাইনটা বন্ধ করে দিলাম। উনি ভেতর থেকে বলে উঠলেন,
~কি ব্যাপার পানি আসছে না কেনো।
-আমি পানির লাইন বন্ধ করে দিয়েছি। ঐদিন বলেছিলামনা, প্রতিশোধ কত প্রকার ও কি কি বুঝিয়ে ছাড়বো। এখন সাবান মাখা শরীর নিয়ে বাথরুমে বসে বসে মশা মারেন।
—আজকে আমরা উনার গ্রামের বাড়িতে এসেছি। শাশুড়ি আম্মা আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। আমরা এসেছি শুনে আশে পাশের বয়স্কো মহিলারা আমাকে দেখতে চলে এসেছে। কেউ আমার গাল ধরে দেখছে, কেউ আমার নাক পর্যবেক্ষণ করছে। আমার কাছে ব্যাপারটা ভালই লাগছে। শহরের মানুষের তুলনায় গ্রামের মানুষগুলো একটু বেশিই আন্তরিক।
—আজকে উনার প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠেছে। অফিসে যেতে পারেননি, সারাদিন বাসায় ছিলেন। মানুষটা ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছে। খুব ভয় লাগছে, নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দুআ করছি বারবার।
—অনেকদিন রোদ্রের পর আজ বৃষ্টি হচ্ছে। উনাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলাম ছাদে। ইচ্ছেমত বৃষ্টিতে ভিজলাম। বাসায় এসে ফ্রিজ থেকে দুটো আইসক্রিম বের করে উনাকে একটা সাধলাম। উনি আমার আইসক্রিম খাওয়া দেখে বললেন,
~এইরকম আজব স্বভাবের মানুষ তোমাকেই প্রথম দেখলাম যে কিনা বৃষ্টিতে ভিজে, এইরকম ভেজা শরীরে আইসক্রিম খাচ্ছে।
ডায়রীটা পড়া শেষ করে আম্মুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
-কিছু বুঝেছো।
~হুম বুঝেছি।
-তোমার ছেলের জন্য এরকম একটা মেয়ে এনে দিতে পারবে?
~আগে এই ছেলের মত পরহেযগার ও সৎ হওয়ার চেষ্টা কর, দেখবি এইরকম মেয়ে আল্লাহ্ তা’আলাই তোকে মিলিয়ে দেবে।
সকাল দশটায় লোকটার সাথে দেখা করলাম। লোকটাকে দেখতেও হাবাগোবা লাগে। তবে চেহারায় একটা সৎ সৎ ভাব আছে।উনি আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন, অনেকক্ষণ সময় লাগিয়ে শুকরিয়া জানালেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর উনার ডায়রীটা নিয়ে এই ডায়রীটা দিয়ে দিলাম।
বাসায় ফিরে এসে শপিং ব্যাগ থেকে হাবাগোবা লোকটার ডায়রীটা বের করলাম। আরে বাহ্, বউয়ের ডায়েরীর সাথে তাল মিলিয়ে উনিও সবুজ রঙের ডায়েরী নিয়েছেন। ডায়রীটা খুলছি আর ভাবছি, “আসলেই কি লোকটা হাবাগোবা, নাকি ভেতরে বুদ্ধির বাসা”।