মাধবীলতা পর্ব ০৪ ও শেষ পর্ব

একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলাম।ইনি তো অনুরোধের খুব কাছের বন্ধু।তাহলে এভাবে ওকে ইগনোর করে আমার সাথে কথা বলছে কিভাবে।একবার তাকালো পর্যন্ত না অনুরোধের দিকে।নিজের অন্যায়ের কথা এভাবে স্বীকার করে দিচ্ছে বন্ধুর সামনে!সত্যিই অদ্ভুত।এই ভেবে পেছনে ফিরে তাকালাম আমি।এরপর যে দৃশ্য দেখতে পাই নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না।
অনুরোধের হাতে একটা পিস্তল।আর সেটা আমার দিকে তাক করে বসে আছে,ওর চেহারার এক্সপ্রেশন যেন পাল্টে যাচ্ছে এক মূহুর্তে।
—একি,অনুরোধ।তোমার হাতে পিস্তল এলো কি করে?কি করতে চাইছো তুমি?
—আরে ও আর কি বলবে।আমি বলছি।তার আগে বলো ও আজ তোমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে?
—কারণ আমি ওকে বলেছিলাম।আমিই চেয়েছিলাম তোমার সাথে দেখা করতে।
—ওহ,রিয়েলি।সত্যি কি তাই মনে হয় তোমার?
আমি অনুরোধের দিকে এগিয়ে গেলাম।
—অনুরোধ কি হচ্ছে এসব…?আর তুমি কোনো কথা বলছো না কেন,এইভাবে চুপ করে থাকবে।
—ও চুপ করেই থাকবে আজ।কারণ ওর মুখ আমি আগেই বন্ধ করে দিয়েছি।এখন আমি যেটা বলবো শুধু সেটাই শুনবে তুমি।
—-তার আগে বলো আমার বোনের সাথে কী এমন শত্রুতা ছিলো তোমার।ওর সন্তান তো তোমার নিজেরও সন্তান ছিলো।কেন মারলে ওদের তুমি?আর শুধু তাই নয়।তোমার জন্য আবার বোন বোনকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।শুধু তোমার জন্য।
—শুধু আমার জন্য?আর তুমি…তুমি কি খুব মহান কাজ করেছো,আমি তো ফোর্স করিনি তোমায়।তাহলে আমার কথা কেনই বা শুনতে গেলে।
—হ্যাঁ, সেটাই ছিলো আমার জীবনের চরম ভুল।আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও সেই ভুল শুধরে নিতে প্রস্তুত।কিন্তু তুমি, তুমি যা করেছো তার জন্য কখনোই ক্ষমা করবো না আমি তোমায়।বলো আমার বোন কি করেছিলো তোমায়,কি এমন শত্রুতা ছিলো তোমার তার সাথে?
—শত্রুতা তো তোমার বোনের সাথে আমার কখনো ছিলোই না।ছিলো তোমার সাথে।
বর্তমানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি।কি বলছে সে এসব।
—কি,আমার সাথে আপনার কিসের শত্রুতা থাকতে পারে।আমি না চিনি,না জানি আপনাকে।কি বলছেন আপনি এগুলো।
—তাই নাকি,আমাকে চিনতে পারছো না?আচ্ছা একটা ছবি দেখাই।ওয়েট….


একে চিনতে পারছো তো??
বর্তমান আমার চোখের সামনে বহু পুরাতন একটা ছবি ধরলো।যেখানে আমি আমার পরিচিত একজনকে দেখতে পাচ্ছি।প্রায় পনেরো ষোলো বছর আগে যার সাথে পরিচয় ছিলো আমার।তার নাম আয়ুশ।
—কি হলো মাধবী,চিনতে পারছো তো?ছেলেটাকে চিনতে পারছো?
—এটা তো আয়ুশ।কিন্তু তুমি ওর ছবি কিকরে পেলে।তোমার কাছে আয়ুশের ছবি আসলো কিকরে?
—আমার কাছে থাকবে না তো আর কার কাছে থাকবে।
—কী বলতে চাইছো তুমি?
—আমি এটাই বলতে চাইছি যে আমিই আয়ুশ।আজ থেকে পনেরো বছর আগে তোমার জন্য যার জীবন বরবাদ হয়েছিলো সেই আয়ুশ আমি।আর এই যে ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছো।তোমার স্বামী অনুরোধ।ও আর কেউ নয়,ও আমার নিজের ভাই।আমি ঠিক বললাম তো অনুরোধ?
—পাক্কা!!!(এটা বলে অনুরোধ একটা মুচকি হাসি দিলো)
এদের দুজনের কথা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার।তার মানে বর্তমান নামের এই ছেলেটা আয়ুশ।আর অনুরোধ ওর ভাই।আয়ুশের কোনো ভাই ছিলো বলে তো জানা ছিলো না আমার।আজ থেকে পনেরো কি ষোলো বছর আগের কথা।যে ঘটনার কারণে নিজের পরিবার ছাড়তে হয়েছিলো আমাকে আজ আবারো সেটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আমার।দিনটা ছিলো কোনো এক শনিবার।স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম আমি।তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা।হঠাৎ একটা ঘর থেকে একটা মেয়ের চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই।নিজের পা থামিয়ে দিলাম আমি।তারপর সেই শব্দকে অনুসরণ করতে করতে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ি।অপরাধী তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলো আর সেটাই ছিলো আমার জন্য মোক্ষম সুযোগ।ঘরের ভেতর ঢুকে বেডরুমের দিকে ছুটে যাই আমি।তারপর যে দৃশ্য দেখতে পাই আজো সেটা মনে পড়লে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।একটা ছেলে আমার বয়সী একটা মেয়ের সাথে জোর করে শারিরীক সম্পর্ক করছে।মেয়েটার আধমরা অবস্থা তখন।চোখের সামনে সেই ভয়ানক দৃশ্য থেকে নিজেকে সামলাতে পারি নি আমি।গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ে দেই।আমাকে দেখা মাত্রই আয়ুশ আমাকেও ধরে তার বিছানায় নিয়ে যায়।আমায় নষ্ট করার চেষ্টা করে।কিন্তু সে শেষপর্যন্ত সফল হতে পারে নি সেদিন।আমার চিৎকারের আওয়াজে ইতিমধ্যে লোকজন ভেতরে ঢুকে পড়ে।তখন জামা কাপড় ছিড়ে বিপর্যস্ত অবস্থা আমার।মেয়েটা মারা গেলে আদালতে আয়ুশের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলাম আমি।ওর সাজাও হয়।এদিকে আমার এলাকায়, এমনকি আমার বাড়িতে আরেক অশান্তির সূচনা হয়।সবাই এটা ভাবতে শুরু করে ঐ মেয়েটার সাথে সাথে আয়ুশ আমাকেও নষ্ট করেছে।অবশ্য তাদের সেটা ভাবাটা অস্বাভাবিক ছিলো না।আয়ুশ ধস্তাধস্তির জেরে আমায় পুরো বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলো।আমার জন্যে আমার পরিবারের লোকের সমাজে মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে।চারপাশের খোটা আর মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম আমি।এক বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে লুকিয়ে পড়াশুনা করি।তার কিছু বছর পরেই অনুরোধের সাথে দেখা হয় আমার।ও আমার পড়াশুনার ব্যপারেও প্রচুর হেল্প করেছে। আমাদের ভেতরে এক পর্যায়ে ভালোবাসাও হয়। কিন্তু আজ বুঝতে পেরেছি সেটা একটা ট্র্যাপ ছিলো।আমাকে আবারো ফাঁসানোর একটা ট্র্যাপ ছিলো।যার মাস্টারমাইন বর্তমান অর্থাৎ আয়ুশ!!!
—কী হলো সোনা,কি এতো ভাবছো??তোমার জন্য পাঁচ বছর লকাপে কাটাতে হয়েছে।আমি ভুলিনি,সেই দিনগুলো ভুলিনি।জেল থেকে বেড়িয়ে হন্যে হয়ে খুঁজি তোমায়।একপর্যায়ে পেয়েও যাই।এরপর আমার বুদ্ধিতে অনুরোধের এন্ট্রিতে ঘটে তোমার জীবনে।ও তোমাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখায়।কারণ এটাই চেয়েছিলাম আমি।আজ তোমাকে তোমার ভালোবাসার মানুষের হাতে মরতে হবে।ঠিক যেমন সেদিন তোমাকে দিয়ে তোমার বোনের চরম সর্বনাশ করিয়েছিলাম।
—যদি তোমার মনে হয় আমি অন্যায় করেছি তোমার সাথে তার শাস্তি আমাকে দিতে।কিন্তু আমার বোনকে কেন এইভাবে কষ্ট দিলে তুমি?বলো কেন কষ্ট দিলে?
—ওকে আমি তো কখনো ভালোই বাসিনি।নিজের মিথ্যে পরিচয় তৈরী করে অনেক কষ্টে বিয়েটা করেছিলাম।আর ভেবেছিলাম কি জানো ওকে তোমার সামনে মেরে চূড়ান্ত কষ্ট দেবো তোমায়।তারপরে তোমায় তোমার ভালোবাসার হাতে মারবো।কিন্তু তোমার বোনের দূর্ভাগ্য দেখো।বেচারি তার আগেই প্রেগনেন্ট হয়ে যায়।আমি কখনোই চাইনি ও আমার বাচ্চার জন্ম দিক।একবার বাচ্চাটার জন্ম হয়ে গেলে হয়তো ওকে কখনো মারতেই পারতাম না আমি।তাই তোমাকে দিয়ে বাচ্চাটাই শেষ করে দিলাম।অবশ্য অনুরোধকে রাখিনি এর ভেতরে। ও জানতো না এর কিছুই।
—ছিহ!তুমি মানুষ না পশু।তোমাকে পশু বললেও পশুদের অপমান করা হবে।কিকরে এতো বড়ো নিচ কাজ করতে পারলে।
—সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। এখন ওপরে যাবার জন্য প্রস্তুতি নাও।আজ তোমাকে আমাদের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
কি হলো ভাই, কি দেখছিস।মার ওকে।
আয়ুশ অনুরোধকে নির্দেশ করে আমাকে গুলি করার জন্য।অনুরোধ আবারো আমার দিকে পিস্তল তাক করে।আমি ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।লক্ষ্য করলাম অনুরোধের হাত কাঁপছে।
—কি হলো অনুরোধ,সময় নষ্ট কেন করছিস।গুলি কর ওকে।তোর হাতে ওকে মরতে দেখে দুচোখ স্বার্থক করি আমি।
অনুরোধ তখনো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।একটু পরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো!
—আমাকে ক্ষমা করো মাধবী, ভুল বুঝো না আমায়।আজ আমার যেটা উচিত মনে হচ্ছে সেটাই করবো আমি।ভাইয়া তুমিও ক্ষমা করো আমায়।
নিজের মৃত্যুকে যেন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি আমি।চোখ দুটো বন্ধ করে দিলাম।তারপর অপেক্ষা করতে থাকি নিজের হবু স্বামীর হাতে মৃত্যুর জন্য।জানি একটু পরে তার পিস্তলের গুলি আমার বুকটা এফোঁড় ওফোড় করে দেবে।তাই আর কিসের এতো অপেক্ষা…!
এরপর পিস্তল থেকে গুলি বের হবার একটা গ‌তীব্র আওয়াজ হলো।হিসেব অনুযায়ী আমার তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কথা।কিন্তু না।গুলির আওয়াজ বাতাসের সাথে মিলিয়ে যাবার পরেও নিজেকে মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু বেশিই অবাক হলাম।ধীরে ধীরে চোখ দুটো খুললাম।
আমার সাথে পড়ে আছে আয়ুশের গুলিবিদ্ধ দেহ!!রক্তে সারা মেঝে ভেসে যেতে লাগলো।অনুরোধ হাটু গেড়ে ওর ভাইয়ের সামনে বসে পড়লো।
—আমাকে ক্ষমা করে দে ভাইয়া।আমি পারলাম না। নিজের ভালোবাসার মানুষের বুকে গুলি চালাতে পারলাম না আমি।আমি জানি তুই নিজের স্বার্থে ওর কাছে পাঠিয়েছিল আমায়,কিন্তু তুই এটা জানিস না আমি মাধবীর সাথে কোনো নাটক করি নি।ওকে সত্যি বড্ড ভালোবাসি আমি।আমি পারলাম না তোর কথা রাখতে।নিজের হবু স্ত্রীকে বাঁচাতে তোকে শেষ করতে হলো আমায়।তুই যে আর মানুষ নেই রে। পশু হয়ে গেছিস তুই।যে মানুষ নিজের সন্তানকে হত্যা করতে পারে সে মানুষ তো হতে পারে না।এই পৃথিবীতে অবাধ বিচরণ করার কোনো অধিকার নেই তোর।যা,তোকে চিরমুক্তি দিয়ে দিলাম।ভালো থাকিস।
এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো অনুরোধ।আমি গিয়ে ওর কাঁধের ওপরে হাত রাখলাম।এতো কিছুর ভেতরেও একটা কথা ভেবে ভালো লাগছে।অন্তত কোনো ভুল মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিইনি আমি।কিছু মূহুর্তের জন্য হলেও নিজের ভালোবাসার মানুষের প্রতি বিশ্বাস উঠে গিয়েছিলো সেটা ফিরে এলো আবারো।




খুনের অপরাধে অনুরোধকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।মেডিকেল রিপোর্টে জানতে পারি আমি সত্যিই প্রেগনেন্ট।অনুরোধের সন্তান বড়ো হচ্ছে আমার ভেতরে।ওর সাথে কিছু সময়ের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো ঠিক কিন্তু সেটা এতোদূর পর্যন্ত গড়াবে আমি ভাবতেও পারিনি আমরা।তাই প্রথমে নিজেকে প্রেগনেন্ট হিসেবে ভেবে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।অনুরোধ আমাকে নিজেই অনুরোধ করে যেন আমি নিজের পাপের কথা কখনো প্রকাশ না করি।আমার হাতে আমার বোনের সন্তানের হত্যা হয়েছে এটা কেউ জানলে আমারও জেল হয়ে যেতো।যা আমাদের সন্তানের জন্য মোটেও সুখকর হতো না।মানুষ ভুল করে, অন‌্যায় করে।আইন তার শাস্তি দেয়।কিন্তু কোনো মানুষ প্রকৃতপক্ষে তখনই শুধরোয় যখন তার কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনাবোধের জাগ্রত হয় ।আমি জানি না যে ভুল করেছি তার অনুশোচনার যন্ত্রনা সারা জীবনেও ফুরোবে কিনা।এর থেকে একটা মানুষের জন্য বড়ো শাস্তি আর কি হতে পারে।তবুও নিজের অশান্ত, কলুষিত মনকে শান্তি দেবার জন্য এই সিধান্ত নিলাম বাকিজীবন বিনা পারিশ্রমিকে এই হাসপাতালের প্রতিটি প্রানের জন্ম দেবো আমি।যারা অসহায় তাদের আর্থিক দ্বায়িত্ব দেবো।।এটাই হবে আমার পাপের প্রায়শ্চিত।



নিজের পরিবারের কাছে আর ফিরে যাই নি।কারণ যে সমাজ,যে পরিবার একজন ধর্ষিতাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবার মনমানসিকতা রাখে তাদের কাছে ফিরে না যাওয়াই শ্রেয়।আজকে আমার এই পরিস্থিতি শুধু আমার পরিবার আর আমার সমাজের জন্য।কাছে যেতে না পারি,দূর থেকেই না হয় সবার মঙ্গল কামনা করে যাবো।।এর কয়েক বছর পরে অনুরোধ নিজের সমস্ত অপরাধের সাজা থেকে মুক্তি পায়।যখন আমাদের ছেলে ‘দোয়াত’ মাত্র চার বছরে পা রাখলো!!

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প