রাতের শহরটা তখন নিস্তব্ধ। জানালার বাইরে ছড়িয়ে থাকা ঝাপসা আলো আর স্নিগ্ধ বৃষ্টি, নিশুর ঘরের ভেতর নিঃশব্দ এক আত্মসংলাপ।
নিশু বিছানায় বসে পুরনো একটা নীল ডায়েরি খুলে বসেছে। পাতাগুলো কিছুটা হলুদ হয়ে গেছে, কিছু কিছু পাতায় জলের দাগ — হয়তো পুরনো কষ্টের ছাপ। হঠাৎ একটা পাতায় চোখ আটকে গেল।
> “তোর হাসিটা জানিস, বইয়ের পাতা ওলটানোর শব্দের মতো। হালকা, ধীর, আর গভীর। তোর মতো হাসি আমি কোথাও দেখিনি, তিথি।”
— রুদ্র, ২০১৯
নিশু হঠাৎ যেন সময়ের মধ্যে ডুবে গেল। বুকের ভেতর কিছু একটা গুঞ্জন তুলছে। সেই লাইনটা—“বইয়ের পাতা ওলটানোর শব্দের মতো”—আজ দুপুরে যেন একই কথাটা শুনেছিল, অন্য কারো মুখে।
—
তিন ঘণ্টা আগের দুপুর, অভির ঘরে
“তুই জানিস, তোর হাসিটা কেমন?” অভি এক চুমুক কফি নিয়ে বলেছিল।
নিশু হেসে বলেছিল, “আবার কী কবিতা আওড়াচ্ছো?”
“না রে, সত্যি বলছি। তোর হাসিটা একেবারে বইয়ের পাতা ওলটানোর মতো—একটা শব্দ নেই, কিন্তু মন ছুঁয়ে যায়।”
নিশু সেই মুহূর্তে চুপ করে গিয়েছিল।
হাসি জমে গিয়েছিল ঠোঁটে।
অভির দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ—তাকিয়ে থাকলেও যেন চিনতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, এই মুখটা কোনো চেনা সময় থেকে উঠে এসেছে। অতীতের ছায়া যেন বর্তমানের শরীরে এসে বসেছে।
—
ফিরে আসা স্মৃতিরা
রুদ্র।
নিশুর প্রথম ভালোবাসা। একসাথে কলেজ, একসাথে প্রথম বৃষ্টি, প্রথম চিঠি, আর প্রথম ভাঙন।
রুদ্র একদিন হঠাৎ করেই চলে গিয়েছিল। বলেছিল—“তুই আর আমি, দুইটা সমান্তরাল রেললাইন—একসাথে থাকি, কিন্তু মিশি না।”
নিশু কিছু বলতে পারেনি সেদিন। শুধু বলেছিল, “যদি কোনোদিন ফিরে আসিস, আমি একটা জানালার পাশে বসে থাকবো—কলম হাতে, গল্পের খাতায়।”
—
রাত — নিশুর জানালার পাশে
আজ অনেকদিন পরে কলম হাতে নিয়েছে নিশু। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, আর ঘরের আলোটা একটু ম্লান।
সে ডায়েরির পাতায় লিখে গেল…
> “আজ অভি আমাকে সেই কথা বললো, যেটা একদিন রুদ্র বলেছিল। এটা কি কাকতালীয়, না কি সময় সত্যিই আমাদের নিয়ে খেলে? আমি বুঝতে পারছি না—অভি কে? সে কি শুধু অভি, নাকি রুদ্রের ছায়া হয়ে ফিরে আসা কেউ?”
তার চোখে জল জমে, কিন্তু সে থামে না।
> “আমি জানি, ভালোবাসা কোনো ঠিকানায় থেমে থাকে না। কিন্তু কিছু অনুভূতি, কিছু চেনা শব্দ, চিরকাল বেঁচে থাকে—নতুন কারো ঠোঁটে, পুরনো কোনো ভালোবাসার মতো।”
—
অন্যদিকে অভি
অভিও আজ অস্থির।
নিজের ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে একটা পুরনো স্কেচ বের করলো—একটা মেয়ের মুখ।
চোখ দুটো গভীর, চুল গালে পড়ে আছে, ঠোঁটে হালকা হাসি।
নিচে লেখা ছিল, “তিথি — ২০১৯”
অভি ফিসফিস করে বলে, “তুই কি ফিরে এসেছিস, তিথি? এই নতুন নামে, নতুন চেহারায়, তবু সেই একই চোখ নিয়ে?”
সে জানালার দিকে তাকায়, বাইরের আলোয় একটানা বৃষ্টির রেখা পড়ে আছে। স্কেচের নিচে রাখা একটা পুরনো টিকিট — শেষবার তারা একসাথে ট্রেনে উঠেছিল যেদিন, সেই দিনের।
—
নিশু জানালার পাশে বসে লিখছে।
অভি নিজের ঘরে বসে স্কেচের দিকে তাকিয়ে আছে।
তাদের মাঝখানে একটাই শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—”ফিরে আসা”।
> “ছবিটার মুখ আজ নিশুর মতো, আর নিশুর মনে সেই পুরনো নামটা আজ আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে—রুদ্র!”