যেখানে ভালোবাসা থেমে থাকে পর্ব ৪

বিকেলটা যেন একটু বেশিই নিরালায় ঢাকা ছিল। আকাশ মেঘে ঘেরা, বাতাসে হালকা শীতের গন্ধ। অভি আর নিশু চলেছে শহরের এক পুরনো লাইব্রেরির দিকে—একটা প্রজেক্টের জন্য কিছু রেফারেন্স বই খুঁজতে হবে।
রাস্তাটা চুপচাপ। অভি হেঁটে চলেছে হাতে একটা নোটপ্যাড নিয়ে, মাঝে মাঝে থেমে কিছু লিখছে। নিশু তার পাশ দিয়ে হাঁটছে, কিন্তু মনের ভেতর অন্য কিছু খেলে চলেছে—অভির আচরণ, অভির বলা কিছু কথা, আর সবচেয়ে বড় কথা, তার চোখ।
অভির চোখ যেন কোথাও গিয়ে রুদ্রের চোখের সঙ্গে মিলে যায়। অথচ অভি কখনো রুদ্রের নাম করেনি, এমনকি কোনো মিল থাকার কথাও বলেনি। কিন্তু নিশুর মন বলছে—কিছু একটা আছে, কোনো এক হারানো সুর, যেটা ফিরে এসেছে।

লাইব্রেরির ভেতর
পুরনো কাঠের র‍্যাক, ধুলোমাখা বইয়ের পাঁজা আর চাপা গন্ধ—সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। অভি আর নিশু আলাদা আলাদা র‍্যাকে বই খুঁজছে।
হঠাৎ অভির চোখে পড়ে একটা বই—“ভালোবাসা ও প্রতীক্ষা”, লেখক অজানা, কিন্তু কাভারে একটা ছোট লেখা চোখে পড়ে:
> “তিথির জন্য—যদি কখনো আবার দেখা হয়।”
অভি বইটা হাতে তুলে নেয়। বইয়ের ভেতর একটা পুরনো বুকমার্ক পড়ে ছিল—হাতে লেখা:
> “রুদ্র + তিথি = একই গল্পের দুই পৃষ্ঠা।”
তার আঙুল কেঁপে ওঠে।
সে নিশুকে ডাকতে যায়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। শুধু বুকমার্কটা পকেটে রাখে চুপচাপ।

নিশুর চোখে ঝলক
সেই বইয়ের নামটাই নিশুকে কেমন যেন করে তুলেছিল।
সেই তো বইটা সে একবার রুদ্রকে দিয়েছিল—জন্মদিনে। নিজের হাতে কভার বানিয়েছিল, আর বুকমার্কে সেই লেখাটা লিখে দিয়েছিল।
কিন্তু বইটা তো হারিয়ে গিয়েছিল…
সে অভির মুখের দিকে তাকায়—অভি তখন চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে।
নিশু একটু এগিয়ে গিয়ে বললো, “এই জায়গাটা কেন যেন চেনা লাগছে তোমার?”
অভি ঘুরে তাকায়, হালকা হাসে, “শহর তো চেনা গল্পের মতো—কখন যে কে কাকে মনে করিয়ে দেয়, বোঝা যায় না।”
নিশু হেসে ওঠে না, শুধু বলে, “তোমার কথাগুলো মাঝে মাঝে খুব… চেনা লাগে।”

রাতের ডায়েরি
> “আজ সেই বইটা আবার খুঁজে পেলাম। বুকমার্কটা তখনই চিনতে পারলাম—তিথির হাতের লেখা।
কিন্তু কীভাবে এখানে এল? নিশুর সামনে বলিনি, ভয় লাগছিল।
আমি বুঝতে পারছি না—তিথিকে আমি ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু নিশুর চোখে তাকালে সেই ভালোবাসা যেন আবার জেগে ওঠে।
আমি কি নতুন কাউকে ভালোবাসছি, না পুরনো কাউকে নতুন নামে চিনছি?”
অভি কলম বন্ধ করে, মাথা নিচু করে বসে থাকে। জানালার বাইরে আজ কোনও বৃষ্টি নেই, কিন্তু হাওয়া খুব নরম, যেন কিছু বলার আছে তার।

রাতের শহর
নিশুর ঘুম আসছে না। ঘরে অদ্ভুত এক চাপা হাওয়ার গন্ধ, যেন সময় থমকে আছে কোথাও।
সে হেঁটে বেরোয় রাস্তায়। পেছনে তার ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে রুদ্রর মুখ, হাসি, সেই শেষদিনের ট্রেন স্টেশনের মুহূর্ত।
> “তুই যদি হারিয়ে যাস, আমি ঠিক খুঁজে নেব তোকে, তিথি।”
তিথি…
নিশু থেমে যায়।
নিজেকে প্রশ্ন করে, “আমি কি তখন তিথি ছিলাম? রুদ্র কি আমাকেই বলেছিল, আমিই কি হারিয়ে গিয়েছিলাম?”

এক অচেনা মুখ, এক চেনা প্রশ্ন
শহরের এক কোণায়, এক পুরনো চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নিশু।
সেই মুহূর্তে এক মাঝবয়সী লোক পাশে এসে বলে,
“তুমি তো… তিথি, তাই না?”
নিশু চমকে তাকায়।
লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি রুদ্রর বন্ধু ছিলাম—ও তোকে অনেক ভালোবাসতো। তারপর… তুই তো হঠাৎ হারিয়ে গেলে!”
নিশুর ঠোঁট কাঁপে। সে কিছু বলার আগেই লোকটা বের করে একটা ছবি—রুদ্র আর তিথির, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। পাশে লেখা:
> “আমরা হারিয়ে যাব না, একে অন্যের ভেতরে বেঁচে থাকব।”
নিশু জানে না, কী বলবে। তার বুকের ভেতরে তীব্র কাঁপুনি। সে ফিরে তাকায় শহরের অন্ধকার রাস্তায়, আর মনে মনে বলে—
> “রুদ্র… আমি কি তোমাকে ভুলেই গিয়েছিলাম, না কি তুমি আমাকে নতুন করে চিনতে আসছো?”
পেছনে কোথাও অভি দাঁড়িয়ে, তার চোখেও কুয়াশা জমেছে।
সে বুকমার্কটা হাতে ধরে, ফিসফিস করে বলে—
> “তিথি…”

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প