রাত তখন প্রায় দুটো। শহর জুড়েই পিনপতন নীরবতা, যেন এক অতলান্ত ঘুমে ঢলে পড়েছে সমগ্র জনপদ। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম একঘেয়ে ডাক আর দক্ষিণ খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধটা জানান দিচ্ছিলো যে কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সায়ন তার ল্যাপটপের উজ্জ্বল আলোয় ডুবে ছিল, অফিসের এক অত্যাবশ্যকীয় প্রেজেন্টেশন শেষ করার শেষ মুহূর্তের তাড়নায়। হঠাৎই বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যাওয়া তারের মতো ল্যাপটপের স্ক্রিনটা আঁধারে তলিয়ে গেল। লোডশেডিং! বিরক্তি আর হতাশায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সায়নের বুক চিরে। এই শহরের বিদ্যুৎ পরিষেবা নিয়ে তার দীর্ঘদিনের অভিযোগ।
মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাল সায়ন। আলোটা সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেখতেই তার বুকটা ধ্বক করে উঠল। কিচেন থেকে একটা আবছা আওয়াজ ভেসে আসছে, যেন কেউ অতি সাবধানে কিছু ঘষাঘষি করছে। প্রথমটায় ইঁদুরের উপদ্রব ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইল, কিন্তু আওয়াজটা বড় বেশি স্পষ্ট, বড় বেশি নিবিড়। তার বুকের ভেতরটা মুহূর্তেই ছমছম করে উঠল। এই ফ্ল্যাটে সে একা থাকে, তিন বছর ধরে এই তার ঠিকানা। এমন কিছু আগে কখনও ঘটেনি।
ধীরে ধীরে, প্রায় নিঃশব্দে, সায়ন কিচেনের দিকে এগোতে লাগল। প্রতি পদক্ষেপে তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি যেন কানের পর্দায় তীব্রভাবে বাজছিল। কিচেনের দরজার কাছ থেকে সাবধানে উঁকি দিল সে। আবছা আলোয় যা দেখল, তাতে তার গলার কাছটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল এক হিমশীতল স্রোত।
দেখা গেল, কেউ একজন বা কিছু একটা, কিচেন প্ল্যাটফর্মে রাখা একটা ধারালো ছুরি দিয়ে অনবরত কিছু একটা কাটছে। কিন্তু তার আকৃতিটা কিছুতেই মানুষের মতো নয়। অবয়বটা বেশ লম্বাটে, যেন কোনও পুরনো গাছের ভাঙা ডালপালা দিয়ে তৈরি, আর তার ওপরের অংশটা ঘোলাটে, যেন জমাট বাঁধা কালো ধোঁয়া ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল তার চোখ দুটো। ঘোর অন্ধকারেও যেন দুটো জ্বলন্ত লাল বিন্দুর মতো জ্বলজ্বল করছিল, এক বীভৎস, অপার্থিব আলো বিকিরণ করে।
সায়নের মনে হলো, তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে পিছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু পারল না। তার পা দুটো যেন হঠাৎ করেই সিমেন্টে গেঁথে গেছে, এক চুলও নড়ানো অসম্ভব। সেই অবয়বটা হঠাৎই থেমে গেল, তার ঘষাঘষির শব্দও থেমে গেল। ছুরিটা প্ল্যাটফর্মে রেখে তার ধোঁয়াটে, দীর্ঘ হাতটা বাড়িয়ে দিল সায়নের দিকে। যেন তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যেন তাকে ডাকছে এক অতলান্ত অন্ধকারে।
এক হিমশীতল, অচেনা বাতাস বয়ে গেল ঘরের ভেতর দিয়ে। সেই অবয়বটা এবার আরও ধীরে ধীরে সায়নের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপেই তার আকার আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর সেই লাল চোখ দুটো যেন আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। সায়নের শরীরটা যেন অসাড় হয়ে আসছিল, এক তীব্র আবেশে সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। তার মুখ থেকে কোনও শব্দই ফুটছিল না, সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু পারল না। তার গলার স্বর যেন তার নিজেরই আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল।
অবয়বটা আরও কাছে এল। সায়ন এবার আরও স্পষ্ট দেখতে পেল, তার হাতে ধরা ছুরিটা থেকে রক্তের মতো টকটকে লাল কিছু চুঁইয়ে পড়ছে, মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে সেই বীভৎস তরল। কিন্তু তার মুখটা… তার মুখটা তখনও দেখা যাচ্ছিল না, শুধু সেই দুটো জ্বলন্ত লাল চোখ আর এক কুৎসিত হাসির আভাস, যা অন্ধকারের আবরণে আরও বীভৎস দেখাচ্ছিল। সেই হাসি যেন সায়নের অন্তরাত্মাকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছিল।
ঠিক তখনই, সায়নের মোবাইলটা তীব্র শব্দে বেজে উঠল। হঠাৎ করে জেগে ওঠা সেই তীক্ষ্ণ শব্দে চমকে উঠল অবয়বটা, যেন এক অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খেল সে। তার গতি থমকে গেল, লাল চোখগুলোতে যেন এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। সায়ন দেখল, স্ক্রিনে তার মায়ের নাম জ্বলজ্বল করছে। সেই মুহূর্তে, যেন এক অলৌকিক ইঙ্গিতে, অবয়বটা দ্রুত কিচেনের জানলার দিকে সরে গেল। তারপর, চোখের পলকে সে মিলিয়ে গেল রাতের ঘন অন্ধকারে, যেন সে কখনও ছিলই না, যেন সায়ন এতক্ষণ এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছিল।
সায়ন হাঁপাচ্ছিল। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল, সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল, তখনও মা ফোন করেই চলেছে। সায়ন কাঁপতে কাঁপতে ফোন ধরল। মায়ের উদ্বিগ্ন গলার আওয়াজ শুনে সে যেন কিছুটা ধাতস্থ হলো, তার মনের ওপর থেকে চেপে থাকা বিশাল পাথরটা যেন কিছুটা সরে গেল।
পরদিন সকালে, সায়ন কিচেনে গিয়ে দেখল। সব কিছু স্বাভাবিক। প্ল্যাটফর্মে ছুরিটা তেমনই পড়ে আছে। কিন্তু সায়ন খেয়াল করল, ছুরির ফলাতে তখনও লেগে আছে কালচে লাল রক্তের মতো একটা দাগ, যা শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে, কিন্তু তার উপস্থিতি এখনও স্পষ্ট। আর কিচেন প্ল্যাটফর্মের ঠিক নিচে, এক টুকরো কালো, শুকনো পাতা পড়ে আছে। ঠিক যেন গাছের ভাঙা ডালপালার মতো। সেই চিহ্ন যেন সেই মধ্যরাতের অতিথির নীরব সাক্ষ্য।
সায়ন সেদিন থেকেই ফ্ল্যাট ছাড়ার কথা ভাবছে। কারণ সে জানে, সেই মধ্যরাতের অতিথি আবার আসবে। এবং পরের বার, হয়তো তার মায়ের ফোন আসবে না, তাকে রক্ষা করার জন্য কোনো দৈব ঘটনাই ঘটবে না। সায়ন এখন প্রতি রাতে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর অপেক্ষায় থাকে সেই লাল চোখের, সেই ধোঁয়াটে অবয়বের। কারণ সে জানে, এই রাতের শহরের প্রতিটি কোণায় এখন লুকিয়ে আছে এক অজানা রহস্য, যা হয়তো একদিন তার সামনে আবার আবির্ভূত হবে।