সহচারি

সেদিন ফকফকে জোছনা। সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হয়েছে, বন্ধুরা সব মেসের ছাদে উঠে আড্ডা দিচ্ছি।
দিপু, আমার বন্ধু, এখন বেসরকারি এক ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে আছে, চুপচাপ বসে ছিলো। ও সবসময়টাই চুপচাপ থাকে। তো, আমরা আড্ডা দিতে দিতে ভূতের গল্প বলা শুরু করলাম। অনেক অনেক ভূতের গল্প বলি, কিন্তু ভয়টা ঠিক জমে না। গল্পগুলা সব একঘেয়ে, এর নানা মাছ আনতে গিয়ে কাকে দেখেছে, ওর দাদা রাতে হাঁটতে গিয়ে কাকে দেখেছে, এসব। নিজে কেউ ভূত দেখেনি। ভূতের গল্প বলতে গিয়ে সবাই হাসাহাসি করছি। দিপু হঠাৎ বললো, একটা গল্প বলি তোদের। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ভূতের কিনা। দিপু বললো, জানি না। বলি, বুঝতে পারবি।
আমরা মনোযোগ দিলাম দিপুর গল্প শোনার জন্য। ও সাধারণত খুব একটা গল্প বলে না। যখন বলছে, তখন নিশ্চয়ই সিরিয়াস কোনো গল্প।
এইখানে বলে রাখি, দিপুর আসল নামটা এখানে নেইনি। ওর আসল নামে গল্পটা বলা হবে, এতে দিপুর খুব আপত্তি। গল্পটা পাবলিকলি বলা হবে, এটাও ওর পছন্দ নয়। গল্পটা ওর অনুমতি না নিয়েই বলা হচ্ছে। আশা করি দিপু গল্পটা পড়বে না।‌ পড়লে ওর সাথে সম্পর্কটা কেমন থাকবে, জানি না।
যাই হোক, দিপুর জবানিতেই ওর গল্পটা বলি-
‘আমরা তখন আমাদের নতুন কেনা ফ্ল্যাটে উঠেছি। ফ্ল্যাটটা বেশ বড়, তিনটা বেডরুম, একটা ড্রয়িং আর একটা ডাইনিং। আব্বু-আম্মু নিলো একটা বেডরুম, আমার আর আমার ছোটভাইকে দেয়া হলো আব্বু আম্মুর পাশের বেডরুমটা। আর একটা রুম খালি পড়ে রইলো। ওখানে কোনো গেস্ট এলে উঠতে দেয়া হবে।
আমরা বাড়িটায় উঠার আগে বাড়িটা একমাসের মতো খালি পড়েছিলো। তখন অনেকের কাছে শুনেছিলাম যে, কোনো বাড়ি খালি পড়ে থাকলে নাকি ওখানে ওঠার আগে মিলাদ পড়িয়ে উঠতে হয়, খালি বাড়িতে নাকি খারাপ জিনিস বাসা বাধে। এসব যদিও আমরা তেমন বিশ্বাস করি না, তবে বাড়িতে ওঠার পরপরই বড় করে মিলাদ দেয়া হলো। পুরো অ্যাপার্টমেন্টের সবাইকেই মিলাদে দাওয়াত দেয়া হয়েছিলো, সবাই এসেছিলেনও মিলাদে। বাড়ির পাশের মসজিদের ইমাম সাহেব নিজে মিলাদ পড়িয়েছিলেন, বেশ ভালো মতোই পড়িয়েছিলেন। আমরাও নিশ্চিন্ত হয়ে রইলাম, খারাপ কিছু বাসা বাধলে এখনই বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা।
বাড়িটায় উঠেছি একমাসের মতো হয়েছে। একরাতে, আমি পড়ছি রাত জেগে। ঘড়িতে তখন একটার মতো বাজে। তপু, মানে আমার ছোটভাই ঘুমিয়ে গেছে, পাশের রুমে আব্বু-আম্মুও ঘুম। আমারও একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। টেবিলে বসে ঝিমাচ্ছি, হঠাৎ শুনি, কে যেন সামনের ড্রয়িংরুমে হাঁটছে। আব্বু আম্মু মাঝেমাঝে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ড্রয়িংরুমে এসে পানি খান, আমিও ভাবলাম আব্বু আম্মুর মধ্যে কেউ একজন উঠেছে। আমারও তখন একটু বাথরুমে যাওয়ার দরকার, তাই আমিও রুম থেকে বের হলাম। ড্রয়িংরুমটা অন্ধকার, আমার ঘর থেকে আসা আলোয় ঘরটা আবছাভাবে আলোকিত হয়ে আছে। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে বাথরুমে যেতে হয়। তো, আমি ড্রয়িংরুমে এসেছি, ভাবলাম আব্বু আম্মু কাউকে তো দেখবো। দেখি একজন হাঁটছে। অন্ধকারে আব্বু না আম্মু বুঝলাম না, লম্বা দেখে মনে হলো আব্বু। সে হেঁটে হেঁটে আমাদের সেই খালি রুমে ঢুকে পড়লো। আমার একটু অদ্ভুত লাগলো যদিও, আব্বুর তো এতো রাতে ঐ রুমে ঢোকার কথা না, তাও ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে বাথরুম সেরে এসে রুমে পড়ার টেবিলে বসলাম। পড়তে পড়তে ঝিমুনির মতো এসেছে, দরজার দিকে তাকিয়েছি, হঠাৎ দেখি একটা মাথা দরজা থেকে উঁকি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাসছে সে। লোকটাকে আমি চিনি না।
আমি খুব জোরে একটা চিৎকার দিলাম। আমার চিৎকারে তপু তো উঠলোই, পাশের রুম থেকে আব্বু আম্মুও দৌড়ে আসলো।
আব্বু আম্মু আসার পর আমি কি দেখেছি বললাম। আব্বু আম্মু না, একদমই বিশ্বাস করলো না। বিশ্বাস না করারই কথা। ছ’তলার উপর ফ্ল্যাট। দরজা ভেতর থেকে লক। প্রত্যেক জানালা আর ব্যালকনি রেলিং দিয়ে ঘেরা। এরমধ্যে কেউ একজন ঘরে ঢুকবে কিভাবে?
আমি আব্বুকে বললাম, ‘তুমি তো পাশের রুমে গেছিলে, কাউকে দেখোনি?’
আব্বু অবাক হয়ে বললো, ‘আমি কখন পাশের রুমে গেলাম? আজকে তো আমি উঠিই নাই ঘুম থেকে।’
আব্বুর কথা শুনে সত্যি অবাক হলাম। আব্বু ঘুম থেকে ওঠেনি, আম্মুও ঘুম থেকে উঠেনি। তাহলে পাশের রুমে কাকে যেতে দেখেছিলাম আমি?
আব্বু আম্মু ব্যাপারটাকে একদমই পাত্তা দিলো না। তারা উপসংহার টানলো, যে পড়তে পড়তে ঝিমুনির মধ্যে আমি উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখেছি।
আমাদের পাশের বাসার যে আন্টি, তার সাথে আমাদের খুব খাতির হয়ে গেলো। তিনি এসে একদিন একটা গল্প বললেন। আমাদের ফ্ল্যাটের যে আগের মালিক, তার বাবা একদিন ফ্ল্যাটে একা ছিলেন। পরদিন সকালে ফ্ল্যাটের মালিক অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করার পরও ভেতর থেকে তার বাবা দরজা খুলছিলো না। শেষে দরজা ভাঙতে হয়েছিলো। ভেঙে দেখা গেলো, তিনি ড্রয়িংরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন। মুখে ভীষণ আতংকের ছাপ। কি দেখে যেন ভীষণ ভয় পেয়েছেন। তার শরীরে প্রাণের স্পন্দন নেই।
আগের রাতে নিচেরতলার ফ্ল্যাটের লোকরা নাকি শুনতে পেয়েছিলো, অনেক লোক একসাথে হাঁটাহাঁটি করলে যেমন শব্দ হয়, তেমন শব্দ হচ্ছিলো উপরতলার ফ্ল্যাটে। অথচ ফ্ল্যাটে সেই ফ্ল্যাটমালিকের বাবা ছাড়া কেউ ছিলেন না। তিনি যে কাউকে ডেকে এনেছিলেন ফ্ল্যাটে, এমন প্রমাণও নেই।
আমরা ফ্ল্যাটটায় থাকছি। একদিন তপু আমাকে বলে, ‘ভাইয়া, আমাদের ফ্ল্যাটে আমরা ছাড়াও আর কারা জানি থাকে।’
তপু খুব সিরিয়াস ধরণের ছেলে, পড়ালেখায় আমার থেকেও ভালো, সাহস আমার থেকে অনেক বেশি। আমার সাথে কখনোই ফাজলামি করে না। আমি বললাম, ‘তুই কেমনে বুঝলি?’
ও বললো, ‘কালকে রাতে বাথরুম করতে উঠেছিলাম। তখন ঐ খালি রুমটা থেকে শব্দ আসছিলো। অনেক মানুষ একসাথে কথা বললে যেমন একটা শব্দ আসে না, তেমন একটা শব্দ।’
আমার মনে তখন ঐ খালি রুমটা নিয়ে একটা ভয় তৈরি হলো। এইরকম ভয় আর কখনো কোনো কিছু নিয়ে হয়নি।
আমার এক বন্ধু ছিলো সাঈদ, ওর এই জ্বীন নিয়ে খুব আগ্রহ ছিলো। ও একবার বলেছিলো, জ্বীন আর মানুষ নাকি একই জায়গায় থাকে।‌ অর্থাৎ আপনি যে বাসাটায় এখন আছেন, যে রুমটায় আছেন, সেখানে এখন জ্বীনেরাও আছেন। তবে তাদের ডাইমেনশন আর আমাদের ডাইমেনশন আলাদা বলে আমরা তাদের দেখতে পাই না। তবে মাঝে মাঝে এই দুই ডাইমেনশনে ইন্টারঅ্যাকশন হয়, তখন আমরা পরস্পরকে দেখতে পাই। এজন্যই এতো জ্বীন বা ভূত দেখার ঘটনা ঘটে।
আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলেছিলাম। একদমই বিশ্বাস করি নাই।
২০০৭ -এ দেশে কয়েকটা কারফিউ এসেছিলো। এমন এক কারফিউয়ের রাতে, বাবা বাড়ি আসতে পারেন নাই।‌ অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলো, সন্ধ্যার সময়ই ফিরে আসার কথা, কিন্তু বিকেলের মধ্যেই কারফিউ জারি করা হয়েছিলো তাই তিনি আর ঢাকায় ব্যাক করেননি। বাসায় আমি, আম্মা আর তপু ছিলাম।
রাতে খেয়ে দেয়ে আমরা ঘুমাতে গেলাম। আম্মাও তার রুমে ঘুমাতে চলে গেছেন। মাঝরাতে কার ডাকে ঘুম ভাঙলো। তাকিয়ে দেখি আম্মা। আমাদের বিছানার কাছে এসে ফিসফিস করে ডাকছেন। আম্মার মুখ ভয়ে আতংকে এতোটুকু হয়ে গেছে। চোখে পানি। আম্মাকে এমন ভয় পাওয়া অবস্থায় আমি আর কখনো দেখি নাই।
আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’
আম্মু বললো, ‘বাবা, পাশের রুমে কারা যেন কথা বলছে।’
আমার শুনে খুব ভয় লাগলো। একটু কান পাতলাম। নিঝুম চারদিক। এই নীরবতার মাঝেই কথা বলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। পাশের রুমে আসলেই কারা যেন কথা বলছে।
আমি উঠে বললাম, ‘চলো, দেখে আসি।’
আম্মা যেতে রাজি হচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে। আব্বাও নাই‌। আব্বা থাকলে এতো ভয়ের ব্যাপার হতো না।
তপুও উঠে গেছে তখন। সেও বললো, চল, দেখে আসি। আমরা দুজন উঠে দরজার দিকে গেলাম। আম্মা বারবার মানা করছে। আম্মার কথা শুনলাম না।
দরজা পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসেছি, অন্ধকার, অন্ধকারে একটু চোখটা সয়েছে, দেখি, মানুষ। সেই অন্ধকার রুমের সামনে পাঁচটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই কেমন যেন উঁচু। ওরা আমাদের দিকে আগাতে শুরু করলো।
আমি আর তপু ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ঘরের বাইরে ওরা এসে দাঁড়িয়েছে। আমি, তপু আর মা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দরজায় বাড়ি পড়লো। বাইরের মানুষগুলো দরজায় বাড়ি দেওয়া শুরু করেছে। অনেক জোরে জোরে বাড়ি।‌ তারা যেন দরজা ভেঙেই ফেলবে।
আমরা তিনজন চিৎকার করছি। বাঁচার জন্য চিৎকার। আমাদের চিৎকার যেন কেউ শুনতেই পারছে না।
বাইরে বাড়ির শব্দ বাড়ছে‌। এতো জোরে বাড়ি পড়ছে, দরজার কপাট নড়তে শুরু করেছে। ভেঙে পড়বে দরজা কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাইরে কে যেন হেসে উঠলো। এমন ভয়ংকর গলার হাসি আর কখনো শুনি নাই।
বাড়ির শব্দ চলতে চলতেই হঠাৎ শব্দটা থেমে গেলো। বাইরে আর কোনো শব্দ নাই। একদম নিস্তব্ধতা।
আমরা তারপরও দরজা খুলি নাই। সারারাত দরজা আটকেই বসেছিলাম।‌ সকালে সূর্য ওঠার পরপরই দরজা খোলা হলো। দুপুরের দিকে কারফিউ শিথিল হয়েছিলো জুম্মার নামাজের জন্য। সেসময়টায় আমরা মামার বাসায় চলে গিয়েছিলাম। আর ফিরিনি সেই বাসায়। বাবা পরে গিয়ে আমাদের মালামাল নিয়ে এসেছিলেন। বাবাও গিয়ে দেখেছিলেন, দরজার কপাট প্রায় ভাঙা। আমাদের তিনজনের পক্ষে দরজার কপাট ওভাবে ভাঙা সম্ভব নয়।’
দিপু এটুকু বলেই থামলো। আর কোনো কিছু বলার নাই তার। আর কিছু বলেও নাই সে।
বাসাটার লোকেশন আমরা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি দিপুর কাছে। দিপু কোনোদিন বলেনি। এতে অনেকে ধারণা করেছে, দিপুর গল্পটা বানানো। আমারও তাই মনে করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দিপুর মতো সিরিয়াস ছেলে এমন একটা গল্প বানাবে, কেন যেন বিশ্বাস হয় না।
হয়তো এমন একটা বাসা সত্যিই আছে। ঢাকাশহরের হাজার হাজার বাড়ির মধ্যে পড়ে আছে সেই বাসা। হয়তো আমি নিজেই সেই বাসায় থাকি এখন, আমি জানি না। হয়তো, এই গল্পটা যিনি পড়ছেন, তিনি সেই বাসাতেই আছেন। তিনি নিজেও জানেন না। কিছুদিন পর জানবেন।
আমি শুধু জানি, সেই গল্প শোনার পর সেই রাতে আমি লাইট নিভিয়ে ঘুমাতে পারিনি।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প