আমার ইচ্ছা করলো এক ছুটে এই বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। পালিয়ে যাই। আমি তো দেখি এটা ভূতের খপ্পরে এসে পড়েছি!
অনামিকা ডাক দিল- চাচী! নিচে চল!
আমি শূণ্য দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম।
– কি হল চাচী?
– তোমাদের এই রুমের দরজা না একেবারে বন্ধ করা?
– হ্যাঁ তো!
– তাহলে?
– একবারে বন্ধ হয়েছে তো অণু আর ইমরান মিসিং হওয়ার পর। আগে তো বন্ধ ছিল না। আগে ভূতপ্রেতও ছিল না!
জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম- কোত্থেকে এল ভূত?
কিন্তু তার আগেই দেখি সজীব সাহেব এসে বলছেন- একবার রুমে আসবে রূপরেখা?
আমি তার দিকে চোখ তুলে তাকালাম কিন্তু কিছু বললাম না। সকালে সে কোন কারণ ছাড়া আমার ওপর রাগ করেছিল!
সজীব সাহেব রুমে চলে গেলে আমি অনামিকাকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা অনামিকা! তোমার চাচার বয়স কত? ফোরটি ফাইভ?
অনামিকা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল।
তারপর খিলখিল করে হাসতে লাগল!
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি হল?
– কি বললে চাচী? ফোরটি ফাইভ? চাচার বয়স খুব বেশি হলে বত্রিশ তেত্রিশ বছর হবে! আসলে বড় বড় মোচ রাখে তো তাই বোঝা যায় না!
আমি এবার একটু দমে গেলাম। লোকটা তাহলে বুড়ো নয়!
এবার আবার জিজ্ঞেস করলাম- কবে আসল ওই রুমের ভূত?
অনামিকা হঠাৎ এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে- চাচী! এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। সেই ঘটনার সাথে চাচাও জড়িত! আমরা জানি না! গিন্নীমা, বাবা আর চাচা জানেন। ছয় বছর আগে কিছু একটা হয়েছিল! আর তারপর থেকে এই দুটো রুম অভিশপ্ত! এই যে গিন্নীমাকে দেখছ এসব আজব কাজ কারবার করেন, একা একা খান, এতগুলো প্লেট নেন এগুলো আগে ছিল না! ওই ঘটনার পর থেকে উনি এধরনের আজিব কাজ করেন! তবে সবার মাথার ওপর অনেক আগে থেকেই তিনি লাঠি ঘোরান।
আমি কি করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এই বাসাটাকে এখন একটা ডাস্টবিন মনে হচ্ছে! আর তার ওপর ভূত! আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছি না আমি নিজের চোখে কিছু অস্বাভাবিক বিষয় দেখেছি! যত যাই বলুক, ওই রুমে যাই থাকুক, কোথাও একটা ‘কিন্তু’ আছে। আর সেই ‘কিন্তু’-র উত্তর পেলেই সব ধাঁধা মিলে যাবে।
সজীব সাহেব ডেকেছিলেন। অনামিকাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
– কি চান?- বেশ গরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
– স্যরি! তখন একটু রাগ করেছিলাম!
আমি বিষের মত মুখ করে তার দিকে তাকালাম!
– স্যরি বললে মাফ করে দিতে হয়।
– আর কিছু বলবেন?
– তোমার বাবা-মা অনেকবার ফোন করেছেন। আর..
– আর কি?
– তুষার নামের একজনকে ফোন করতে দেখলাম।
আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি। এখন দেখলাম তার হাতে আমার মোবাইল। আমি ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে নিলাম।
এরপর আবার রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি আমার মোবাইল চেক করছেন? জানেন না এটা একজনের পার্সোনাল জিনিস? জিজ্ঞেস না করে ধরতে হ..
– আস্তে রূপরেখা! আমি তোমার ফোন কেন চেক করব? আর কি করে করব? লক দিয়ে রাখোনি?
আমার খেয়াল হল আসলেই তো আমি লক করে রাখি। আমি মুখটা থমথমে করে রাখলাম।
– বাবা-মা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছেন তুমি নাকি তাদের সাথে কথা বলছ না! আর রুমে ঢুকে দেখি তোমার ফোনটা বাজছে। তুষার নামের একজন ফোন করেছে। তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তার আগেই কেটে গেছে আর তুমি এসে পড়েছ।
আমি কোন কথা না বলে ফোন হাতে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলাম।
অনামিকাকে বললাম- চল! নিচে যাই।
নিচে নেমে আমাকে নিয়ে অনামিকা বাগানে গেল! সেই বিশাল বড় এক বাগান। সেখানে একজনকে কাজ করতে দেখলাম। মাটি কোপাচ্ছে। সে আমাদের দেখে তাকিয়ে সালাম দিল! তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম! এরকম লাল হয়ে আছে চোখ! নেশা করে নাকি!
অনামিকা ফিসফিস করে বলল- একে চিনে রাখ। তৈয়ব দাদু। এ হল গিন্নীমার ডানহাত! এর সামনে বেফাঁস কিছু বলেছ তো গিন্নীমার কাছে রিপোর্ট হয়ে যাবে! আর আমার ধারণা ওই ছয় বছর আগে কি হয়েছিল সেটা এই লোকও জানে।
অনামিকা বাকি জায়গা ঘুরিয়ে দেখাল। দুইটা পুকুর দেখলাম। একটাতে মাছের চাষ হয়। আরেকটায় পরিষ্কার টলটলে পানি। আমরা কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম। পেছনে খসখস আওয়াজে তাকালাম!
তৈয়ব চাচাকে দেখি আমাদের পিছে পিছে হাঁটছে!
অনামিকা বেশ ঝাঁঝের সাথেই বলল- আপনি আমাদের ফলো করছেন কেন?
উনি ঘড়ঘড়ে গলায় উত্তর দিলেন- গিন্নীমা আমাকে আপনাদের সাথে সাথে থাকতে কইছেন।
– লাগবে না। যান।
তবুও উনি যে আসলেই গিন্নীমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন সেটা বুঝতে পারলাম। না করা সত্ত্বেও উনি দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের পিছে পিছে হাঁটতে লাগলেন।
অনামিকা বিরক্ত হয়ে বলে- চাচী চল তো ভেতরে। একটু শান্তি মত কথা বলার উপায় নেই।
আমারও পা ব্যথা হয়ে গেছে হাঁটতে হাঁটতে। এত বড় জায়গা! আরেকপাশ তো দেখতেও পারলাম না ভাল করে।
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অনামিকাকে জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা তোমরা কেন এই ভূতের বাড়িতে থাক?
– কি করব! বাবা-চাচাদের সব ব্যবসা, কাজকারবার এখানে না? কিভাবে যাব? আর তোমার মনে হয় গিন্নীমা এই পূর্বপুরুষদের ভিটা ছেড়ে যেতে দিবেন? আমরা জমিদার বলে কথা!
অনামিকা আমাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে গেল। আমার পা দুটো ব্যথায় টনটন করছে। আমি বিছানায় বসে বালিশে হেলান দিয়ে মাকে ফোন করলাম।
মা ফোন ধরেই হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন- কেন এরকম করছিস?
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম – তোমরা কেন আমাকে এখানে বিয়ে দিলে?
– কেন তুই কি খারাপ আছিস?
বাহ! কি চমৎকার প্রশ্ন! একটা মানুষ একটা ভূতের বাড়িতে আছে। এর থেকে খারাপ সে কি করে থাকবে?
অথচ এখানে বিয়ে না করার জন্য আমি কি না করেছি!
বাবাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি কেন আমাকে গ্রামে বিয়ে দিতে হবে! আমি এখানেই ভাল আছি। আমার জমিদার বাড়ির বউ হওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। তুষারের কথাও বলেছি। তুষার পাত্র হিসেবে মোটেও উড়িয়ে দেবার মতো নয়! সে যথেষ্ট ভাল একটা জব করছে। আমার আর একটা সেমিস্টার বাকি আছে। এরপরেই তার বাসা থেকে আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা! বাবা কোন উত্তর দেননি! বলেছেন এখানেই তার পছন্দ!
আমি বললাম – এইরকম লেইম একটা এক্সকিউজ! তুমি না করে দাও।
মা বললেন – আমি তো বুঝতে পারছি না। সমস্যা কি? ছেলে ভাল, শিক্ষিত, তোর বাবার পরিচিত, এত বড় বাড়ি! ওনারা যদি বিয়ে দিতে চান আমাদের তো রাজি হয়ে যাওয়া উচিৎ। এত ভাল সম্বন্ধ আসে না!
– মা আমি একজনকে ভালবাসি!
– এরকম ভালবাসা অনেক আসে আর যায়! বিয়ে হলে ভুলে যাবি!
আমি কোনভাবেই এসব যুক্তি মেনে নিতে পারিনি। তাই তুষারের সাথে পালিয়ে পর্যন্ত যাচ্ছিলাম। কিন্তু বের হওয়ার সময় বাবা দেখে ফেলেন। বাবা আমাকে নিয়ে আটকে রাখলেন না। বা ধমকও দেননি।
শুধু বললেন – ঘরে যাও।
আমিও অবাক হয়ে ঘরে গিয়ে বসলাম। তুষারকে ফোন করে সব বললাম।
তুষার মেজাজ খারাপ করে চেঁচামেচি লাগাল- একটা কাজও ঠিক করে করতে পার না রূপ তুমি! দেখল কি করে?
যাই হোক আমাকে যেহেতু আটকে রাখেনি আর তাই আমি আবারও সহজে বের হয়ে যেতে পারব তাই আমি ওকে নেক্সট প্ল্যান ঠিক করে জানাব বললাম।
কিন্তু আমি কিছু করার আগেই সেদিন রাতে হঠাৎই বাবা আমার কাছে এসে বলেন- এই যে দেখ আমার হাতে কি?
আমি তাকিয়ে দেখি একটা বোতল! সিরাপের বোতলের মত।
বাবা বললেন- এটা বিষের বোতল। তুই এক্ষুনি বিয়েতে কবুল বলবি। নাহলে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি এই পুরো বোতল খাব!
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম! আমার বাবা এটা কি করে করতে পারেন আমার সাথে! আর আমি তখনই জানতে পারলাম আজ আমার বিয়ে!
কবুল বলে, সাইন করে আমি পাথর হয়ে গেলাম। তুষারকে কিছুই জানালাম না! কোন মুখে জানাব! আর পরদিন মানে গতকাল ওরা আমাকে এই ভূতুড়ে বাড়িতে নিয়ে এল! কাল রওনা দেওয়ার আগে মোবাইল নিতে আমার ঘরে ঢুকেছি আর তখন দেখি টেবিলের ওপর সেই বিষের বোতলের শিশি! ওটা দেখে সব রাগ ওইটার ওপর পড়ল। দড়াম করে আছাড় মারলাম। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ওইটার ভেতর থেকে লাল একটা তরল পদার্থ বের হল। আমি সন্দেহ নিয়ে নিচে বসে চেক করে দেখি চটচটে আঠালো! আর গন্ধ পেয়ে আমি বুঝলাম এটা আসলে কোন বিষ নয়, বরং লিকুইড প্যারাসিটামল সিরাপ ছিল! নামের কাগজটা উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। বাহ! আমার বাবা আমার সাথে এত বড় বুজরুকি করল! এখানে বিয়ে দেওয়ার জন্য!
মা বললেন – বাবার সাথে কথা বল।
আমি দুম করে ফোনটাই কেটে দিলাম। আমি বাবার সাথে কথা বলব না। একদম না। আমি কাল চলে যাব। আমি এবার তুষারকে ফোন করলাম।
তাকে সব খুলে বললাম।
তুষার প্রথমে কোন কথাই বলতে পারল না।
এরপর বলল- তুমি চাইলে আমি পুলিশকে জানাতে পারি।
– হায় হায়!
– হ্যাঁ! তোমার বাবা তো এভাবে জোর করে বিয়ে দিতে পারেন না!
– আ..আমি কালকে ব্যাক করব। তুমি তখন সব ব্যবস্থা করবে।
– করব। অবশ্যই করব!
– আমি এই ভূতের বাড়িতে থাকিব না তুষার! -আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম!
তুষার সব শুনে বলল- আমার মনে হয় পুরোটাই তোমার কল্পনা রূপ!
– কিভাবে? কল্পনা হলে সেটা অনামিকার কথার সাথে হুবহু কি করে মিলে গেল?
– হয়তো কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। কিন্তু এই শতাব্দীতে এসে তুমি যদি এগুলো বল তাহলে তো মুশকিল! তাও তোমার মত শিক্ষিত মেয়ে!
তুষারের সাথে আরো অনেকক্ষন কথা বললাম। ও আমার মনটা ভাল করে দিল! আমাকে হাসাল! আমার ভয় অনেকটাই কেটে গেল!
রাখার আগে ও বলল- শোন রূপ। ভূত বলে কিছু নেই। সবকিছুর একটা ব্যাখ্যা আছে। তবুও আমি আজ সাহিরের সাথে কথা বলব। আমি তোমাকে সব জানাব।
সাহির তুষারের বন্ধু। সে এসব প্যারানরমাল বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে। অনেক পড়াশোনা আছে এই বিষয়ে।
আমি বললাম – থ্যাঙ্কিউ তুষার।
– রাখি রূপ। টেক কেয়ার। লাভ ইউ।
– লাভ ইউ টু! বাই।
এখন বেশ খানিকটা ভাল লাগছে। হঠাৎই নক করে গেটটা খুলে গেল। সজীব সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
– তুমি এখনো গোসল করনি? গোসল করে নাও। সবাই দেখতে আসবে।
বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- সবাইটা কে?
– আমার ফুপা- ফুপু আসবে। ওনাদের ছেলেমেয়ে। আর গ্রামের মানুষজন। সবার জন্য খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।
উঠে বসে বললাম – যাচ্ছি।
উনি নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন – রাগ কমেছে?
সজীব সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার খুব হাসি পেল। সে ভেবেছে আমি তার ওপর রাগ করেছি। আসলে তার কোন অনুভূতির মূল্যই যে আমার কাছে নেই সেটা উনি জানেই না।
আমি ফিক করে হেসে ফেলে বললাম- রাগ করিনি!
সজীব সাহেব খুশি হয়ে বের হয়ে গেলেন। গোসল করে কোন শাড়ি পরব? সকালে মা দুনিয়ার শাড়ি গয়না রেখে গেছেন। আবার কোন নিয়ম আছে নাকি যে বিয়ের পরদিন ওমুক রঙ পরতে হবে? এই বাড়িতে কিছু থাক আর না থাক দুইটা জিনিস আছে। এক হল ভূত আর দ্বিতীয়টা হল নিয়ম নীতি!
আমি তাড়াতাড়ি মাথা থেকে ভূতের ব্যাপারটা সরিয়ে ফেললাম। তুষার বলেছে ভূত বলে কিছুই নেই।
শাড়ির ব্যাপারটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আসেপাশে কেউ নেই। সবাই মনে হয় রান্নাঘরে। মা কি ঘরে আছেন? আমি রুম থেকে বের হয়ে মায়ের ঘরের দিকে গেলাম। নক করে গেট খোলার পরে দেখি ভেতরে কেউ নেই। আমি বের হয়ে গেলাম। আর ঠিক তক্ষুনি আবার খিলখিল করে বাচ্চাদের হাসির শব্দ শুনলাম। আমি চমকে উঠলাম। না আমি ভুল শুনছি। সব কল্পনা। হ্যালুসিনেশন! কিন্তু এবার আমি দেখতেও পেলাম। দুই ঝুটি করা একটা মেয়ে। আমি মায়ের ঘরের দরজা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। মেয়েটা হঠাৎই আমাকে ইশারা করল! না কিচ্ছু নেই। এইসব মিথ্যা। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। একটুপর চোখ খুলে দেখি মেয়েটা নেই কিন্তু ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে ফিক করে হেসে দিল! সেও আমাকে ইশারা করে ডাকল!
আমি কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম- ক..কে তোমরা?
ছেলেটা কিছু না বলে দৌড় দিল। দৌড়ে সে গিন্নীমার ঘরে ঢুকে গেল। আমিও হঠাৎ তার পেছনে গিন্নীমার ঘরে গেলাম। উনার ঘরটা বিশাল বড়! গিয়ে দেখি সব ফক্কা! কিচ্ছু নেই! কেউ নেই। কিন্তু মনে হল আমি যেন কারও গলা শুনলাম। সেই সাথে নূপুরের শব্দটাও হঠাৎই হল! কিন্তু এখন এটাকে আর নূপুরের শব্দ মনে হচ্ছে না। এটা কিসের শব্দ আমি বুঝতে পারছি না! তবে গতরাতের মতই শব্দটা। আর এত জোরে পাচ্ছি যেন এই ঘরের কোথাও থেকে আসছে। সেই সাথে আমি একটা গলা পাচ্ছি! আমি হঠাৎই জোরে ডাক দিলাম- গিন্নীমা!
আর এরপর গলার আওয়াজটা থেমে গেল। কিন্তু নূপুরের শব্দটা আবার পেলাম! আম ভয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। এই রুমে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। আমি বের হয়ে যাচ্ছি। দরজার কাছে গিয়েছি তখন পেছন থেকে আমাকে কেউ ডাকল- নতুন বৌ!
তড়াক করে ঘুরে তাকিয়ে দেখি গিন্নীমা! উনি এখানে কি করে এলেন? উনি তো ঘরে ছিলেন না! আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছি!
উনি কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন- এখানে কি করছ নতুন বৌ?
আমি কাঁপা কণ্ঠে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম- আ..আপনি এখানে কি করছেন?
– তার মানে?
– আমি তো এসে আপনাকে দেখলাম না! মানে..
– আমি ওয়াশরুমে ছিলাম!
– ওই ছেলেটা কোথায় গেল?
মনে হল গিন্নীমার চোখটা ধ্বক করে উঠলো!
– কোন ছেলে?
– একটা বাচ্চা ছে..
বলে আমি থেমে গেলাম। গিন্নীমাকে এসব বলা কি ঠিক হচ্ছে?
উনি থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন – তুমি কোন বাচ্চা ছেলেকে দেখেছ?
আমি বললাম – ন..না! আমি.. না মানে গোসলের পরে কোন শাড়ি পরব সেটা জানতে এসেছি।
– তোমার যেটা খুশি, যেটা ভাল লাগে নিয়ে পরতে পারো! তবে ঘোমটা আর গহনাগাঁটি যেন ঠিক থাকে।
– আ..আচ্ছা।
আমি বের হয়ে এলাম।
বের হয়ে গেটটা আটকে দেয়ার সময় হঠাৎ আমি শুনলাম মনে হল গিন্নীমা বলছেন- এত কৌতূহল ভাল না! বিপদে পরবে!
আমার বড্ড ক্লান্ত লাগছে। আমি কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না! আমি বারবার কেন বাচ্চা দুটো দেখছি!? ওরা কি সত্যি আছে? তাহলে আর কেউ দেখেনা কেন? আর গিন্নীমা হুট করে কি করে এলেন? উনি বললেন উনি ওয়াশরুমে ছিলেন। আমি ওয়াশরুম থেকে কোন শব্দ পাইনি! উনি এত রহস্যময় কেন? উফফ! আমি বাসায় যেতে পারব কখন?
গোসল করে, রেডি হয়ে নিচে গেলাম। মা নিজেই এলেন আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে!
নিচে এত মানুষজন দেখে মাথা ঘুরে গেল! আমার ফুপু শ্বাশুড়ির সাথে পরিচয় হল! আমাকে অনেক আদর করলেন।
মা জিজ্ঞেস করলেন – আসো না কেন?
– ভয় লাগে ভাবী!
– আমরা আছি না?
– থাকলেও। এই বাসায় খারাপ কিছু আছে। অনেক ভয় লাগে!
মায়ের দীর্ঘশ্বাস আমার চোখ এড়াল না!
গ্রামের সব মানুষকে আমার আর সজীব সাহেবের জামাকাপড় দিতে হল। আমার সাথে কয়েকজন কথা বলল। কয়েকজন মহিলা তো মুখে হাত দিয়ে আদর করল। আমার মহা বিরক্ত লাগছিল!
সজীব সাহেব বিড়বিড় করে বললেন – একটু সহ্য কর!
খাওয়ার সময় দেখলাম সেই একই ব্যাপার। গিন্নীমা বিসে রইলেন। সবার সাথে খেলেন না। আর পরে রানু দুইটা থালাসহ একগাদা খাবার নিয়ে গেল। একজন মানুষ একা কি এত খাবার খেতে পারে?
ধীরে ধীরে সবাই বিদায় নিল।
আমার ফুপু শ্বাশুড়িকে থাকতে বললে উনি আঁতকে উঠে বলেন- না না! থাকব না। বড় ভয় লাগে মা এই বাড়ি!
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কেন?
উনি উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই গিন্নীমা হঠাৎ পেছন থেকে ডেকে বললেন – রোকেয়া!
– জ্বি মা!
– যেতে হলে চলে যাও। খামোখা ওকে ভয় দেখিও না। ওর কৌতূহল এমনিতেই বেশি!
ফুপু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি শুনলাম গিন্নীমা যেতে যেতে আবার ফিসফিস করে বলছেন- এত কৌতূহল ভাল না!
রাতে খাওয়ার পর আমি অনেক টায়ার্ড। কিন্তু গতরাতের কথা মনে হয়ে আমার অসম্ভব ভয় লাগছে! রাত কি আর দিন কি! এই বাসায় তো আমি সারাক্ষণ ভূত দেখি!
সজীব সাহেব বললেন – আজও ভয় পেলে ডাক দিও। কিন্তু খামচি দিও না প্লিজ!
আমি চোখ তুলে তাকালাম কিন্তু কিছু বললাম না।
উনি আনন্দিত গলায় বললেন – গ্রামের সবাই বলেছে তুমি অনেক সুন্দর! আর বলেছে আমাদের নাকি অনেক মানিয়েছে!
আমি বিড়বিড় করে বললাম – ভুল বলেছে। মিথ্যা বলেছে।
– কিছু বললে?
– না!
– আচ্ছা তাহলে গুড নাইট।
কিন্তু এই রাতটা আমার জন্য একদমই গুড হল না। সজীব সাহেব কিছুক্ষণ পরেই নাক ডাকতে লাগলেন। আর আমি ভয়ে নির্ঘুম জেগে রইলাম। হঠাৎ দরজার সামনে দেখি সেই বাচ্চা মেয়েটা। অন্ধকারে আমি মেয়েটাকে কিভাবে দেখছি আমি সেটা জানি না! কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখলাম সে ফিক করে হাসল। এরপর আমাকে ডাকল!
আমি সজীব সাহেবকে ডাকার জন্য হা করলাম কিন্তু আমার মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। আমি কাঁপা হাতে তাকে ডাকতে যাব মেয়েটি হঠাৎ মাথা নেড়ে আমাকে নিষেধ করল! এরপর সে ইশারা দিয়ে আমাকে আবার ডাকল!
হঠাৎই আমারও রোখ চেপে গেল! আমি অসহ্য হয়ে গিয়েছি এইসব ঘটনায়। হয় এটা হ্যালুসিনেশন নয়তো সত্যি। কি সেটা আমায় দেখতেই হবে। আমি উঠে গেলাম। মেয়েটাও আবার ফিক করে হেসে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম বের হয়ে দেখব কেউ নেই। কিন্তু বের হয়ে দেখি মেয়েটা আর ছেলেটা দুইজনই দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে ইশারা করল। আমিও হঠাৎই ওদের পেছনে হাঁটা শুরু করলাম। আমার মনে হচ্ছে আমার পা যেন নিজেই আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁটছি ওদের পেছনে। আমি কতক্ষণ হেঁটেছি, কোনদিক দিয়ে এসেছি জানি না। আমার চমক ভাঙল যখন আমি নিজেকে সেই বন্ধ দরজার সামনে আবিষ্কার করলাম! আর এবার আমাকে প্রচন্ডরকম ভয় এসে গ্রাস করল! আর হঠাৎই সেই বন্ধ দরজার ভেতর থেকে দুম দুম আওয়াজ হতে লাগল। কে যেন বের হয়ে আসতে চাইছে। আমি গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলাম!
জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার পাশে আমার ম
আম্মু-বাবা, সজীব সাহেব আর তার মা।
শ্বাশুড়ি মা বললেন – আলহামদুলিল্লাহ! জ্ঞান ফিরেছে তাহলে। আমি মাকে জানিয়ে আসি!
আমার আব্বু জিজ্ঞেস করলেন- কি হয়েছিল মা?
সজীব সাহেব বললেন – তোমাকে বলেছি না একা একা কোথাও যেও না! তুমি সাহস করলে কি করে ওই দরজার সামনে যেতে?
আমি চুপ করে থাকলাম। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। আর শুধু এই বেলাটাই এরপরেই আমি বাবা-মায়ের সাথে চলে যাব। আমি উঠে বসলাম। একটুপর গিন্নীমা এলেন। সাথে শ্বাশুড়িমা।
গিন্নীমা জিজ্ঞেস করলেন – এখন ভাল লাগছে?
আমি মাথা নাড়লাম।
– তুমি অসুস্থ থাকলে আমরা আগামীকাল অনুষ্ঠান করব।
আমি চমকে উঠলাম! আগামীকাল মানে এই বাড়িতে আরেকটা দিন!
আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম – নাআআ!
সবাই খুব অবাক হল!
– না মানে! এত আয়োজন যখন করা হয়েছে, আজকেই হোক। আমি ঠিক আছি!
মা জিজ্ঞেস করলেন- ওই রুমের সামনে গিয়েছিলে কেন মা?
গিন্নীমা বললেন – থাক! এই উত্তরটা আমরা পরে জানব।
একটুপর আমি উঠে রেডি হলাম। বেশ জাঁকজমক করে বৌভাত করা হল। যদিও আমাকে আর সজীব সাহেবকে সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে হল। তবুও আমি অসুস্থ বলে ছাড় পাচ্ছিলাম। আমি খাওয়ার আগে সজীব সাহেব একটা ওষুধ দিলেন।
– কি এটা?
– ডাক্তার ডেকেছিলাম। উনি খাওয়ার আগে তোমাকে এই ওষুধটা খেতে বলেছে।
আমিও ওষুধ খেলাম। একটুপর অনুষ্ঠান শেষ হলে রুমে গেলাম। সাথে আমার মা, ভাবী, অনামিকাও ছিল। আমার হঠাৎই প্রচন্ড ঘুম পেল। ঘুমাব না ঘুমাব না করেও আমি ঘুমিয়ে গেলাম!
ঘুম থেকে আমি জাগা পেয়ে দেখি রুমে কেউ নেই! আমি হাচড়পাঁচড় করে ঘড়ি দেখলাম। ওমা! সাড়ে ছয়টা বাজে! আমি এতক্ষণ ঘুমালাম? মা-বাবা কোথায়? আমি ছুটে বের হলাম। বাইরে অনামিকাকে পেলাম। ও বলল- এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই..
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি দৌড় দিলাম। গেটের কাছে এসে দেখি তালা মারা! হাঁপাতে হাঁপাতে আমি তৈয়ব চাচাকে বললাম- গেট খুলুন। আমি বাইরে যাব!
উনি বললেন – গেট তো খোলা যাইবে না!
– তার মানে?
– গিন্নীমার আদেশ। আপনাকে যেন গেটের বাইরে যাইতে না দিই।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! তার মানে আমি এই ভূতুড়ে বাড়িতে বন্দী?