আমার মনে হল গিন্নীমা তার চোখ দিয়ে আমাকে ভস্ম করে দিচ্ছেন।
উনি বললেন – নতুন বৌ! তুমি এখানে কি করছ?
কথা না মনে হল উনার গলা দিয়ে আমার দিকে বোমা ছুঁড়ে দিলেন!
উনি ভয়ানক গলায় জিজ্ঞেস করলেন- আমার চাবির গোছা তোমার কাছে কেন?
আমি কোনমতে উঠে দাঁড়িয়েছি। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। কি বলব, কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে উনি এখন কি করবেন?
– আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি নতুন বৌ!
উনার কথায় বাড়ির সবাই চলে আসে। সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! আমি এদিকে কারো সাথে দৃষ্টি মেলাতে পারছি না।
আমি কোনমতে বললাম – এ..এদিকে এসেছিলাম। আপনার চাবি খাটে ছিল, সেটা আপনাকে দিতে যাচ্ছিলাম। ত..তখন পড়ে গেছে।
যেই ব্যাখ্যাটা দিলাম সেটা আমার নিজেরই পছন্দ হল না!
গিন্নীমা বললেন – আমার চাবি কি তোমাকে কামড়াচ্ছিল? আর ডাক্তার তোমাকে বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন। তুমি এখানে হাঁটতে হাঁটতে এসেছিলে? এই কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বল?
আমি চোরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি।
গিন্নীমা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন – ঘরে যাও।
আমি কোনমতে তার সামনে থেকে সরে এলাম। তখন নিচু হয়ে চাবি ওঠানোর সময় কোমরে অনেক লেগেছে। এখন হাঁটতে গিয়ে টের পাচ্ছি।
আমি ঘরে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সজীব সাহেব এলেন।
আমার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন – তোমার সমস্যা কি রূপরেখা? সবসময় ঝামেলা সৃষ্টি না করলে তোমার ভাল লাগে না, তাইনা?
আমি ধীরে ধীরে বললাম- আমি..আসলে..
– একদম চুপ! – সজীব সাহেব ধমকে ওঠেন!
আমার সাথে আগে উনি কখনো এরকম খারাপ ব্যবহার করেননি। আমার খুব খারাপ লাগতে থাকে। চোখ উপচে পানি পড়তে থাকে।
– খবরদার কাঁদবে না। সবসময় তুমি যেটা বল, তোমার যা ভাল লাগে সেভাবেই থাকার চেষ্টা করি। তার বদলে আমি কি আশা করতে পারি না যে তুমি আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটু মিলেমিশে থাক? কেন গিন্নীমাকে ঘাঁটাতে যাও?
আমি ভেউভেউ করে কেঁদে দিলাম। আর উনি দড়াম করে দরজা আটকে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর আমি বাইরে থেকে গেট লক করার শব্দ পেলাম।
আমার মাথায় হঠাৎ কেউ ফিসফিস করে বলে- বিপদ! সামনে বিপদ।
আমার আর কোন অনুভূতি কাজ করছে না। সজীব সাহেবকে ভাল মনে করেছিলাম। উনার দিকে আমি একটু একটু করে আকৃষ্টও হচ্ছিলাম কিন্তু উনিও আসলে একই গোয়ালের গরু! গেট লক করার জন্য সজীব সাহেবের ওপর প্রচন্ড রাগ উঠল। এরপরে উনার দুইহাতই কামড়ে দেব বলে ঠিক করলাম!
আমি আর কান্নাকাটি করলাম না। একটুপর মা খাওয়ার জন্য ডাকলেও আমি সাড়া দিলাম না। আমি খাব না। একদমই না। কিছুক্ষণ পর আবার খুট করে গেট খুলে গেল। ভাবী খাবারের থালা নিয়ে ঢুকল।
নরম গলায় বলল – খেয়ে নাও নতুন বৌ!
আমি রাগ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপনাকে আপনার দেবর পাঠিয়েছে? গেট লক করেছিল কেন তাহলে?
ভাবী অবাক হয়ে উত্তর দিলেন – সজীব গেট লক করেনি তো। ও তো কাজে চলে গেছে। গেট গিন্নীমা লাগিয়েছেন।
ও তাহলে আমাকে রুমে বন্দী করে শাস্তি দেয়া হচ্ছে!
– মা আমাকে পাঠালেন তোমাকে খাইয়ে দিতে। আর তুমি ভাবলে কি করে যে সজীব গেট লাগাবে? ও তোমাকে যে ভালবাসে..
আমি মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।
ভাবী হেসে দিয়ে বলে- সজীব অনেক ভাল মানুষ! তোমার ভাই হলে আমার হাড়গোড় আস্ত রাখত না!
আমি চমকে ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললাম – তার মানে.. তার মানে আপনার হাতে মাঝেমধ্যে যে কালশিটে দেখি, গায়ে যে দাগ দেখি.. ভাবী ভাইয়া আপনার গায়ে হাত তোলে? আর আপনি চুপ করে আছেন?
ভাবী ম্লান হেসে বলল – এই গ্রামের সব বিচার আমাদের বাসায় করা হয়। আমি কি জমিদারের কাছেই জমিদারের নামে নালিশ করব?
আমি মাথা নেড়ে বললাম – পুলিশ আছে তো ভাবী! এখানের কাছের শহরে পুলিশ আছে।
– তা আছে। কিন্তু তুমি গিন্নীমাকে চেন না নতুন বৌ। উনি কি পরিমাণ সাংঘাতিক মহিলা! এমনভাবে কেস সাজাবে যে সবাই আমাকেই দোষী ভাববে। আমাকেই খারাপ প্রমাণ করবে। বন্ধ ঘরের ভূতের মত গিন্নীমাকেও ঘাঁটাতে হয় না।
– কিন্তু…
– আর এখন আর এসব করে কি হবে? কতদিনই তো পাড় করে ফেললাম। মেয়েটাও তো বড় হয়ে গেছে। সামনে এসএসসি দেবে। ইশশ! আমার অণু আর ইমরান থাকলে এখন ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়তো! – ভাবীর গলা ধরে আসে, চোখ ভিজে আসে।
আর আমিও অবাক হয়ে দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অণু আর ইমরানেরও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে! আজ এতদিন পর আমি আবার ওদের দেখলাম।
ভাবীকে খাবারসহ পাঠিয়ে দিলাম। আমি খাব না ঠিক করেছি মানে খাবই না। সন্ধ্যায় এবং রাতেও আমাকে মা আর ভাবী সাধাসাধি করলেন। আর সজীব সাহেব সেই যে গিয়েছেন তার টিকিটিও আর দেখাননি আমাকে। রাতে ভাবী ঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গেলেন। গিন্নীমা দয়া দেখিয়ে রাতে আর লক করেননি। রাত এগারোটা বাজে। সবাই সবার ঘরে চলে গেছে। আমার এদিকে ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। ভাবী যে খাবার দিয়ে গেছে তা একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। আসলে আমি মহা বোকা। এভাবে খাবারের ওপর রাগ দেখানো ঠিক হয়নি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। যাই হোক, খাবারের সাথে রাগ করে লাভ কি? খাবারের কি দোষ? আর আমারই কষ্ট হচ্ছে! খাবারের থালাটা হাতে নিয়ে আমি নিচে নেমে গেলাম। হাঁটতে এখনো কষ্ট হচ্ছে। ওভেনে গরম দেব হঠাৎই খুট করে আওয়াজ পেলাম। রান্নাঘরে আলো জ্বলে উঠল। পেছনে ঘুরে দেখি সজীব সাহেব। আমাকে দেখে হাসলেন। আজকে প্রথমবারের মত। আমি মুখটাকে পাথরের মত করে রাখলাম!
সজীব সাহেব আমার সামনে এসে হেসে বললেন – এত রাতে মাথায় কাপড় না দিয়ে তুমি জমিদার বাড়িতে ঘুরঘুর করছ? এটা তো এই বাড়ির বৌ-দের মত আচরণ নয়!
আমি খ্যাক করে উঠলাম – আমাকে এত রাতে দেখার জন্য কে আছে?
সজীব সাহেব মুচকি হেসে বললেন – এই যে! আমি দেখছি!
– রুমের মধ্যে আপনি আমাকে ঘোমটা ছাড়াই দেখেন।
সজীব সাহেব দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বললেন – অন্যভাবে কিন্তু কখনো দেখিনি!
আমি পাথরের মত মুখ করেই ওভেনে থালাটা ঢুকালাম। এই লোককে পাত্তা না দিলেই হল!
সজীব সাহেব এবার খপ করে আমার হাত ধরে বললেন – রূপরেখা বিশ্বাস কর আমি তোমাকে বকতে চাইনি। কিন্তু তোমার এই কাজের জন্য গিন্নীমা সারাজীবন তোমাকে কথা শোনাবেন। আর কেউ তোমাকে খারাপ বলুক, বকা দিক আমার সেটা ভাল লাগে না!
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম!
– আমাকে বকা দিলে দিক, কিন্তু তোমাকে কেউ কিছু বললে আমার খুব খারাপ লাগে। আর উনারা তো গুরুজন। উনাদের মুখে মুখে তো তর্ক করতে নেই! উনি হাত জোর করে বললেন- স্যরি রূপরেখা!
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওভেন শব্দ করে জানিয়ে দিল খাওয়া রেডি।
আমি সেটা বের করতে গেলে সজীব সাহেব আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন – ঠিক আছে। তুমি আমাকে তাহলে বকা দাও, বা মার দাও। যতক্ষণ তোমার ইচ্ছা। এক কাজ কর হাত কামড়ে দাও। আমি একটুও চিৎকার করব না।- সজীব সাহেব তার দুইহাত বাড়িয়ে দিলেন।
আমি খাবারটা বের করে বললাম – আপনার কখনো সন্দেহ হয় না গিন্নীমা এরকম আজব কেন? কখনো জানতে মন চায়নি কি আছে ওই ঘরে? কি এমন হয়েছিল যে ওই দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিতে হল?
– চায় কিন্তু..
– আপনার কিন্তুর উত্তর খুঁজতেই আমি আজ গিন্নীমার ঘরে গিয়েছিলাম।
ডাইনিং এ বসে আমি সজীব সাহেবকে সবকিছু খুলে বললাম। উনি আমাকে ফাঁকে খাইয়ে দিলেন।
কথা শেষ করে আমি বললাম – আমি জানি আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না। না করলে নেই। আ..
সজীব সাহেব মাঝখানে বললেন- কে বলল বিশ্বাস করছি না? আমি বিশ্বাস করেছি।
আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম!
– তোমার মনে আছে আমাদের বৌভাতের দিন তুমি যখন ভাইয়ার সাথে তর্ক করছিলে আমার মনে হয়েছিল আমি একনজর ওদের দেখেছি! কিন্তু এরপর আর দেখিনি বলে ভেবেছিলাম চোখের ভুল। তুমিও ওইদিকেই তাকিয়েছিলে!
আমার এবার খুবই আনন্দ লাগল! যাক! সজীব সাহেব অন্তত আমাকে বিশ্বাস করেছেন।
– গিন্নীমার ঘরে যেখানে দরজার কথা বলছ ওদিক দিয়ে দরজা হলে…
বলতে বলতে সজীব সাহেব হঠাৎ থেমে গেলেন!
এরপর উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন – রূপরেখা ওদিক দিয়ে দরজা হলে.. মানে..মানে ওই দরজা দিয়ে ওই বন্ধ রুমে যাওয়া যায়!
আমি আঁতকে উঠলাম!
– তাহলে? ওই ঘরে কি আছে? বা কে আছে?- আমি গলায় কোন জোর পেলাম না!
– আমি জানি না! আমাদের দেখতে হবে। কিন্তু আজকের পর থেকে গিন্নীমা চাবি আর কাছ ছাড়া করবেন না।
এরপরের কয়েকটা দিন আমরা অনেক ভাবলাম। অনেক রকম প্ল্যান করলাম। কিছুদিন পরেই আবার সজীব সাহেবের সদরে কি কাজে যেন গিয়ে দুইদিন থাকতে হবে। তার আগেই এইদিকের সব ঠিক করতে হবে। ফাইনাল প্ল্যান রেডি হল। কিন্তু সেজন্য অনামিকাকে লাগবে। তাকেও সব বললাম। সব শুনে তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। অনামিকা একবারেই রাজি হয়ে গেল।
আমাদের পরিকল্পনা মত আমি সমস্ত লজ্জা শরম ত্যাগ করে মাকে গিয়ে বললাম – মা! আপনার আলমারিতে আমার বিয়ের শাড়িটা আছে না?
আমার বিয়ের শাড়িটা জায়গা হচ্ছিল না বলে মা তার আলমারিতে রেখেছিলেন।
মা বললেন – হ্যাঁ মা!
– ওইটা একটু লাগত!
– কেন?!
আমি লাজুক মুখে বললাম – সজীব সাহেব ওইটা পরতে বলেছেন। কোথায় যেন ঘুরতে নিয়ে যাবেন!
মা হেসে দিয়ে বললেন – লজ্জায় লাল হয়ে গেছে দেখ! আর সজীব সাহেব আবার কি? সজীব বলতে পারো না?
আর ঠিক এই সময়ে অনামিকা ছুটতে ছুটতে এসে জিজ্ঞেস করে – দাদী! আমার সার্টিফিকেট গুলো পাচ্ছি না। তোমার আলমারিতে কি না দেখ তো!
মা বললেন – হ্যাঁ দেখছি!
কিন্তু মায়ের আলমারির চাবি খুঁজে পাওয়া গেল না। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল! আমরা আগেই জানতাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ অনামিকা আগেই আলমারির চাবি সরিয়ে রেখেছে। তবুও আমরা মায়ের সামনে খোঁজার অভিনয় করে গেলাম!
মা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন – কি আশ্চর্য! ওপরে তো কাজের মানুষ কেউ তেমন আসে না। আর যারা আমাদের বাসায় কাজ করে সবাই খুব বিশ্বস্ত! তাহলে কোথায় রাখলাম আমি?
আমি মন খারাপের ভাব করে বললাম – ওহ! আচ্ছা উনাকে গিয়ে বলি! সজীব সাহেব অনেক আশা করেছিলেন।
অনামিকা মরিয়া হয়ে বলল- কিন্তু আমার ক্লাস এইটের সার্টিফিকেট লাগবে দাদী। স্কুল থেকে চেয়েছে। এসএসসির ফর্মের কিসে যেন লাগবে! আমার মনে আছে আমি তোমার আলমারিতে রেখেছিলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা এক্সট্রা চাবি নেই?
অনামিকা লাফিয়ে বলল- আছে তো! গিন্নীমার কাছেই তো আছে!
মা বললেন – ও হ্যাঁ! মায়ের কাছেই তো আছে। তার চাবির গোছাটা নিয়ে আসি।
অনামিকা বলল- দাদী চল। আমিও যাই।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম – মা! গিন্নীমাকে আমাদের বাইরে যাওয়ার কথাটা বলবেন না প্লিজ! না মানে! উনি এমনিতেই আমাকে পছন্দ করেন না। ওই ঘটনার পর তো শাস্তিস্বরূপ আমাকে লক করে রেখেছিলেন। আবার বাইরে যাওয়ার কথা শুনলে..
মা স্বাভাবিকভাবে বললেন – না না! সেটা কেন বলব! অনামিকা চলো দাদুভাই।
মা আর অনামিকা গেলে সজীব সাহেব মায়ের রুমে ঢুকলেন।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি জানেন না অন্যের রুমে আড়ি পাততে হয় না?
উনি একেবারে আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বললেন- তুমি জানো না বড়দের মিথ্যা কথা বলতে হয় না?
– ইশশ! প্ল্যানটা কে বানিয়েছে?
সজীব সাহেব হাসলেন!
আমি বললাম – মা বলছিলেন আপনার নাম ধরে ডাকতে!
সজীব সাহেব খুশি হয়ে বললেন – নাম ধরে ডাকলে কিন্তু ‘তুমি’ করেও বলতে হয়।
আমি উদাস ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম – দেখি!
এমন সময় অনামিকা এসে জিজ্ঞেস করে – চাচা-চাচী কি করছ তোমরা!
সজীব সাহেব সাথে সাথে আমার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালেন।
বিড়বিড় করে বললেন – ত্যাঁদড় মেয়ে! রোম্যান্টিক মুডটা নষ্ট করে দিল!
আমি তার কথা শুনে হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করলাম- কাজ হয়েছে অনামিকা?
– হয়েছে। তবে দুনিয়ার নথিপত্র বলতে হয়েছে। দাদী কেন চাবি নিচ্ছে, কি দরকার, আমার কোন কাগজ, আগের চাবি কি করে, কখন, কোথায় হারাল সব ফিরিস্তি দিয়ে তারপর দিয়েছে। দাদী নিয়ে আসছে।
মা চাবি আনার পর অনামিকা একটা কাগজ এনে হঠাৎই বলে- দাদী এবারের রানুর বেতনটা দেয়া হয়েছে কি না মা জানতে চেয়েছিল। এই যে এটা যার যার বেতন দেয়া হয়েছে তাদের পাশে টিক চিহ্ন দিতে বলেছে।
সজীব সাহেব বললেন – মা চাবিটা আমাকে দাও। তুমি ওর কি কাজ দেখ।
মা চাবি দিয়ে দিলে সজীব সাহেব সেটা দিয়ে আলমারি খুললেন। আর এরপর উনি উনার পকেট থেকে একটা সাবান বের করলেন। সব চাবির গায়ে মার্ক করা। কোনটা কিসের। শুধুমাত্র একটা চাবির গায়েই মার্ক করা নেই। আমিও স্বপ্নটাতে কোন চাবির গায়ে মার্ক দেখিনি। আমি ধারণা করলাম যেটাতে মার্ক করা নেই সেটাই হবে। উনি সেই চাবিটা সাবানের ওপর বসিয়ে একটা ছাঁচ নিয়ে নিলেন। এরপর স্বাভাবিকভাবে আমি শাড়ি বের করলাম। অনামিকা কিছুক্ষণ তার সার্টিফিকেট খোঁজার ভান করল।
এরপর বলল- নাহ! পাচ্ছি না। মায়ের কাছে দেখি আছে কি না।
আমরা রুমে যাওয়ার পর সজীব সাহেব বললেন – যাই আমি গিয়ে চাবি বানিয়ে নিয়ে আসি।
– ঠিক আছে।
সজীব সাহেব হঠাৎ হেসে বললেন – এত কাহিনী করে শাড়িটা নামালে একটু পরো দেখি কেমন লাগে। বিয়ের দিন তো দেখতেই পারিনি। এসে দেখি ঘুমাচ্ছ। আর এরপর তো খাট ধরে ঝুলছিলে!
আমি নিজেও হেসে দিলাম সেদিনের কথা মনে করে!
– আর..
– আর?
– তুমি চাইলে আমরা একটু বাইরে থেকেও ঘুরে আসতে পারি। আজকে নদীর ধারে মেলা বসেছে!
আমি হাসি চেপে বললাম – দেখি!
সজীব সাহেব মুখ গোমড়া করে বললেন – আচ্ছা দেখাদেখি শেষ করে জানিও!
উনি চলে গেলে আমি আপন মনেই হাসলাম। এরপর সত্যি সত্যি শাড়িটা পরলাম। সুন্দর করে সাজলাম আজ অনেকদিন পরে!
ফিরে এসে সজীব সাহেব আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন!
আমি ধাক্কা মেরে বললাম – কি হল?
উনি বললেন – ভাগ্যিস শাড়ি বের করার বুদ্ধিটা করেছিলাম! তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে! খুব সুন্দর!
– থ্যাঙ্কিউ।
– চল- বলে উনি আমার হাত ধরলেন।
এরপর আবার ছেড়ে দিয়ে বললেন – স্যরি। মে আই?
আমি নিজেই তার হাত ধরে হাসতে হাসতে বললাম- কামড়ে দেব কিন্তু!
একটা গ্রামীণ মেলা ঘুরে দেখলাম। দেখে ভাল লাগল যে সজীব সাহেব সবার সাথে ভাল করে সাধারণ মানুষের মতই মিশলেন। আমি শিওর অন্য কেউ হলে অহংকারে কথাই বলত না।
সজীব সাহেব আমাকে অনেকগুলো কাঁচের চুড়ি কিনে দিলেন। আসার সময় চাবি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। চাবিটা মনে হল যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখি!
আজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সজীব সাহেবকে বললাম- থ্যাংকস ফর দ্যা ডে সজীব।
সজীব সুন্দর করে হেসে বলে- ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।
রাতটা প্রচন্ড উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেল। আগামীকাল সব রহস্য উন্মোচন হবে! আমরা কি পারব?
আমি আজ মনে মনে অণু আর ইমরানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওরা কোন কথা বলল না। রাতে ওদের স্বপ্ন দেখলাম অণু আর ইমরানকে খুব খুশি মনে হল!
সকাল থেকেই বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে শুরু করল। সব ঠিক হবে তো আজ?
নাস্তা খাওয়ার পর আমি আর সজীব একসাথে গিন্নীমার ঘরের কাছাকাছি থাকলাম। সাহিরকেও আজ আসতে বলেছি।
পরিকল্পনা মোতাবেক অনামিকা হঠাৎই ওর পেট ধরে সিঁড়িতে বসে পড়ে চিল চিৎকার শুরু করে দিল- ওরে বাবা! মা গো! বাঁচাও! মরে গেলাম!
সবাই ছুটে গেল। গিন্নীমাকেও বেরিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে দেখলাম।
উনি দৃষ্টির আড়াল হওয়া মাত্র আমি আর সজীব তার ঘরে গেলাম। নিঃশব্দে দরজা আটকে দিলাম। এরপর সজীব একটানে বাথরুমের পাশের ওয়ালের পর্দাটা সরিয়ে ফেলে! ওখানে সত্যি সত্যি আরেকটা দরজা। সজীব চাবি দিয়ে সেই দরজাটা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু দরজাটা খুলল না।
সজীব আমার দিকে তাকাল। আমার মনে হচ্ছে টেনশনে, ভয়ে আমি কেঁদে দেই!
আমি কাঁপা কণ্ঠে বললাম – আবার চেষ্টা কর।
সজীব আবার চেষ্টা করল। আর এবার সত্যিই দরজাটা খুলে গেল। দরজাটা খোলার পর আমি নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর তক্ষুনি আবার সেই শব্দটা শুনলাম। কিন্তু এটা নূপুরের শব্দ না। লোহার গায়ে লোহা দিয়ে বাড়ি দিলে যেরকম শব্দ হয় অনেকটা সেরকম। অনেক স্পষ্ট! আমি শক্ত করে সজীবের হাত ধরলাম। আমরা ভেতরে ঢুকে সামনে এগোলাম।
আরেকটু আগাতেই সজীব ভীত গলায় বলল – এটা সেই বন্ধ রুম!
আমার মনে হল হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। দিনের বেলা কিন্তু রুমের ভেতরে অন্ধকার। শব্দের দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম। সজীব তার মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে রুমের দিকে তাক করল! এরপরের দৃশ্য দেখার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না! আমরা দুইজনেই একসাথে চিৎকার করে উঠলাম!