আমার মুখ ঢেকে ফেলা হয়েছে একটা কালো কাপড় দিয়ে। আমার হৃৎপিণ্ড ধকধক করছে জোরে জোরে। তবে কি সত্যিই আমাকে বলি দিয়ে দিবে এই পশুগুলো? সেই মেয়েটাকেও আর দেখতে পাচ্ছি না। তার কোনো আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি না। চিরকাল ভয় না পাওয়া আমারও গলা শুকায় আসে ভয়ে। চোখে না দেখতে পেলেও আমি বুঝতে পারি কিছুক্ষণ আগেই ওই মেয়েটার সাথে যা যা হচ্ছিলো আমার সাথেও তাই হতে চলেছে। আমাকেও সেই এক টুকরো কালো কাপড় পরানো হয়েছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি একমনে,”হে আল্লাহ! আপনি অশুভ শক্তি থেকে আমাদের রক্ষা করুন।”
ফিসফিস করে অনেকের কথা বলার শব্দ শুনছি পাশ থেকে। কিন্তু তাদের ভাষার কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু ভালো করে শুনে বুঝতে পারলাম ওরা কোনো একটা মন্ত্র পড়ছে। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। আমি ঠিক বুঝতে পারি এরা শয়তানকে ডাকছে। আমাকে বলি দিবে সেই শয়তানের উদ্দেশ্যে। আমি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকি।
হঠাৎ আবু মিয়ার গলার স্বর শুনতে পেলাম। বেশ ভারিক্কি গলায় কথা বলছে সে।
“মা জননী, আপনাকে আমি বলেছিলাম নিজের মতো থাকেন, আমাদের ব্যাপারে নিজেকে জড়াবেন না। কিন্তু না, আপনি আমার কথা শুনলেন না। শুধু আপনার জন্য, আমরা আমাদের লক্ষ্যের খুব কাছে এসেও অনেক দূরে চলে যাচ্ছিলাম। আমরা যার উপাসনা করি, সে আমাদের উপর ভীষণ রেগে গিয়েছেন। আমরা জানিনা তিনি আর কোনোদিন আমাদের ডাকে সাড়া দিবেন কিনা। আমাদের আর কিচ্ছু করার নেই। এই হানাবাড়িতে আজ জোড়া কুমারী বলি হবে তার উদ্দেশ্যে। শুরুটা আপনাকে দিয়েই হবে। প্রস্তুত হন একটা নির্মম মৃত্যুর জন্য।”
আমি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করি। এই পরিস্থিতিতে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখতে হবে। ভিতরের ভয়টাকে চেপে রেখে কড়া গলায় আমি বলি,”ভুল করছিস তোরা, বড় ভুল করছিস। অশুভ শক্তির রাজত্ব এই দুনিয়ায় কোনোদিন হয়নি আর হবেও না। হয়তো কিছু সময়ের জন্য সেই শক্তির জয় হয় কিন্তু তা অতি ক্ষনিকের জন্য। তোরা মরবি, অবশ্যই মরবি। যতো বড় শক্তিশালী তোরা হোস না কেনো, তোদের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে রাঘানিয়া জাতি। খুব তাড়াতাড়ি।”
কথা শেষ করতেই একটা শক্ত হাতের থাপ্পড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম আমি। তীব্র ব্যথায় গোঙানি দিয়ে উঠলাম আমি। ঠোঁটের পাশে নোনতা স্বাদ টের পেলাম, নিশ্চয়ই কেটে গেছে। এদিকে চোখ মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে,কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। হাতটাও বাঁধা পিছন থেকে।
সেই মোটা গলার বয়স্ক লোকটার কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
“এতো তেজ? এতো সাহস? তুই চিনিস এই রাঘানিয়া জাতিকে। এক মুহূর্তে এই এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারি আমরা। তুই তো মরবিই সাথে তোর পরিবারও মরবে। এই তোমরা দাঁড়ায় থেকো না। কাজ শুরু করো যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। এই মেয়েকে আগে বলি দিয়ে ওই মেয়েটাকেও দিতে হবে। অনেক কাজ। আর সব শেষ করতে হবে ভোরের আজান দেওয়ার আগেই। ভোরের আজান দেওয়ার সাথে সাথেই আমাদের শক্তি কমতে শুরু করবে। আমরা আর দিনের আলোয় নিজেদের মানুষরূপে উন্মুক্ত করতে পারবো না। আর বেশি সময় নেই। দ্রুত হাত চালাও তোমরা।”
আমার মনোবল ভেঙে গেলো। বাঁচার আশা বোধহয় আর নেই। আর যদি শয়তান এদের উপর খুশি হয়ে যায়, তাহলে? এরা রাজত্ব করবে এই গোটা বিশ্ব? না না, তা হতে পারে না। আজান দেওয়ার হয়তো আর বেশি সময় নেই। যা করার আমাকে এর মধ্যেই করতে হবে। কিন্তু এতোগুলা নরপশুর মধ্যে কি বা করার ক্ষমতা আছে আমার? ওই মেয়েটা আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো, এই রাঘানিয়া জাতির ধ্বংসের উপায়। কিন্তু তাও তো শোনা হয়নি। কি করবো এখন আমি? বড্ড অসহায় লাগে নিজেকে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসে আমার। বাবা মায়ের মুখটা সামনে ভেসে ওঠে। ছোট দুইভাইকেও দেখতে ইচ্ছা করে ভীষণ। বাহাদুর আর রাণীকেও বড্ড মনে পড়ে। ওরা হয়তো কিছু আঁচ করতে পেরেছিলো, অবলা প্রাণী তো। এজন্যই সেদিন ওরা বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই চাচ্ছিলো না। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। আরে হ্যা, তাইতো। আবু মিয়া তো বলেছিলো এই বাড়িতে কোনো কুকুর পোষা যাবে না। সে নাকি কুকুর সহ্য করতে পারে না।
তবে কি রাঘানিয়া জাতি কুকুর অপছন্দ করে? এই মুহুর্তে যদি কুকুর আসে এখানে তবে কি ওদের শক্তি কমবে কিছুটা? নাকি এটা সবটাই আমার ভ্রান্ত ধারণা? কিচ্ছু আসছে না আমার মাথায়। হতেও তো পারে হয়তো আবু মিয়ার ব্যক্তিগত ভাবে কুকুর অপছন্দ। এর সাথে রাঘানিয়া জাতির ধ্বংসের কোনো সম্পর্ক নেই।
আমাকে ধাক্কা দিয়ে একটা ধাতব কিছুর উপর ফেলে দেওয়া হলো। কেউ একজন আমার হাতের বাঁধন খুলে দিলো। দুইজন দুইপাশ থেকে আমার হাত চেপে ধরলো। আমি পালানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ছটফট করছি ওঠার জন্য। কিন্তু আমাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরছে তারা। হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম আমি। তবে কি এভাবেই হবে আমার মৃত্যু? চারপাশের মন্ত্র পড়া আরো জোরালো হলো। সবাই মিলে একসাথে কোনো একটা মন্ত্র পড়ছে। আমি ভাবলাম মরতে তো হবেই। শেষ একটা চেষ্টা করতে হবে আমাকে। করতেই হবে।
বাহাদুর আর রাণী যখন খুব ছোট তখনই ওরা আসে আমার কাছে। আমি খুব যত্ন নিয়ে পালি ওদের। খুব সুন্দর করে ডাকি আমি ওদের সবসময়। এমন ভাবে ডাকি, ওরা অনেক দূর থেকেও আমার গলা শুনতে পায়। ছুটে আসে আমার কাছে। হ্যা আমাকে সেই ডাকটাই এখন কাজে লাগাতে হবে।
আমি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে মাথাটা কিছুটা তুলে ডাক দিই।
“আমার বাহাদুর, আমার রাণী। কোথায় আছিস তোরা? আয় রে আয় আমার কাছে। আমার বাহাদুর, আমার রাণী।”
হঠাৎ মন্ত্র থেমে যায়। আমার দুই হাত চেপে ধরা থাকলেও কিছুটা আলগা হয়ে যায়। আমার বুক কাঁপতে থাকে ধকধক করে। কি হতে চলেছে এবার?
আমি থরথর করে কাঁপছি। জানিনা কি হতে চলেছে। সবাই এমন চুপ কেনো হয়ে গেলো? আমার হাতের বাঁধনও আস্তে আস্তে আলগা হতে শুরু করেছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমি। মুখের উপর কালো কাপড় থাকার কারণে দেখতেও পাচ্ছি না কি হচ্ছে। হঠাৎ করে ওই মেয়েটার চিৎকার শুনে আমার ঘোর কাটে। মেয়েটা কাঁদছে, ভীষণ জোরে জোরে কাঁদছে। তবে আমার মনে হচ্ছে এই কান্না আনন্দের। কেনো মনে হচ্ছে আমি জানিনা। আমি অস্থির হয়ে গিয়েছি চারপাশ দেখার জন্য। হঠাৎ আমার হাতের বাঁধন একদমই আলগা হয়ে যায়। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াই। কেউ একজন মনে হলো আমার মুখে যে কালো কাপড়টা বাঁধা ছিলো তা খুলে দিলো। আমি এক ঝটকায় কাপড় টেনে ফেলে দিয়ে তাকালাম। ওই মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আমাদের বিপদ কাটতে শুরু করেছে। তুমি আসলেই দেখিয়ে দিয়েছো। আল্লাহর দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া।”
আমি এখনো ধাতস্থ হতে পারিনি। অনেকক্ষণ চোখ বাঁধা থাকার ফলে চোখ খুলেই সব কেমন ঝাপসা দেখা শুরু করেছি। শুধু বুঝতে পারছি প্রায় অন্ধকার ঘরে বেশ কিছু মোমবাতি জ্বলছে শুধু। তাতে যেনো অন্ধকারটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু মেয়েটা কি বললো? আমি কি করেছি? যার জন্য বিপদ কাটতে শুরু করেছে?
হঠাৎ কারো গোঙানির আওয়াজ শুনে আমি এক ঝটকায় সেদিকে তাকালাম। আর যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার কলিজা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেলো। কি হচ্ছে এসব?
দেখলাম বাহাদুর, হ্যা আমার বাহাদুর এখানে। আবু মিয়ার হাতে মস্ত বড় একটা ধারালো চাপাতি। মোমের আলোয় যার চকচক তল বুঝিয়ে দিচ্ছিলো কতোটা ধারালো হতে পারে। এটা দিয়েই তবে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো এই নরপশুগুলো? আমি শিউরে উঠি। কিন্তু এ কি? বাহাদুর চাপাতির ধারালো অংশটা এভাবে দাঁত দিয়ে কামড়ে রেখেছে কেনো? ব্যাপারটা এমন যে আবু মিয়া আমাকে কোপ দিতে আসছিলো,ঠিক তখনই বাহাদুর এসে চাপাতিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে। চাপাতির বাকি অংশটা এখনো আবু মিয়া শক্ত করে ধরে আছে। তার চোখ ভয়াবহ মাত্রায় লাল। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ করছে। ওদের দলের বাকি সবাই আমার বাহাদুরকে ঘিরে ধরেছে। সবার চোখ মুখ লাল। সবাই মুখ দিয়ে ওই একই বীভৎস একটা শব্দ করছে। কিন্তু না, আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। বাহাদুরকে তো এরা মেরে ফেলবে। এদের হাত থেকে বাহাদুরকে রক্ষা করতে হবে। আরেকটু হলে তো চাপাতির ধারালো অংশে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে বাহাদুরের মুখ। এতোগুলা নরপশুর কবল থেকে আমি একা ওকে উদ্ধার করতে পারবো কিনা এসবা আমার মাথায় নেই। আমার মাথায় আছে শুধু, বাহাদুরকে আমাকে বাঁচাতে হবে। যেভাবে হোক। আমি ছুটে যেতে যাবো ওর কাছে ঠিক এমন সময় ওই মেয়েটা আমার হাত চেপে ধরলো।
“আরে, কোথায় যাও? কি করছো তুমি?”
আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম,”কোথায় যাই মানে? দেখছো না আমার বাহাদুরের কি অবস্থা? ওকে সবাই ঘিরে ধরেছে। ওকে তো শেষ করে দিবে এখনই। ছাড়ো আমাকে। ওকে বাঁচাতে হবে।”
“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? ওকে বাঁচাতে যাওয়া মানে এই বাড়ির সবার মৃত্যু ডেকে আনা। তবে শোনো, আমার দাদীর কাছে আমি শুনেছিলাম, এই রাঘানিয়া জাতির ধ্বংসের উপায়। আর তা হলো, এই রাঘানিয়া জাতি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভয় আর ঘৃণা করে কুকুরকে। কারণ এরা যার উপাসনা করে সে কুকুর অপছন্দ করে। সেই শয়তানের উদ্দেশ্যে কুমারী মেয়ে বলি দেওয়ার সময় কুকুরের উপস্থিতি। মানে বুঝতে পারছো? এই রাঘানিয়া জাতি আর কোনোদিন শয়তানের কাছ থেকে কোনো শক্তি নিতে পারবে না। শয়তান এদের ধ্বংস করে দিবে। এই এক্ষুনি এরা এদের মানুষের মতো রূপ থেকে বের হয়ে সেই পশুর মতো চেহারা পেয়ে যাবে। আর কোনোদিন এরা মানুষের মতো রূপ নিতে পারবে না। আর তারা যেখানে অবস্থান করবে সেখানে আগুনের বিস্ফোরণ ঘটবে। খুব তাড়াতাড়ি এই জায়গায় আগুন লাগবে। নিঃশেষ হয়ে যাবে এই রাঘানিয়া জাতির শেষ সদস্যগুলো। আর কোনোদিন এরা বংশবৃদ্ধিও করতে পারবে না। পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেবে এই নরপশুগুলো।”
“যাই হয়ে যাক, বাহাদুরকে না নিয়ে আমি এখান থেকে একদম যাবো না।”
“দেখো মেয়ে, পাগলামি করো না। তুমি বাঁচতে চাও না? তুমি চাওনা তোমার পরিবার বাঁচুক? এখনি এই বাড়িতে ভয়াবহ আগুনের বিস্ফোরণ হবে। সবাই মারা পড়বে। একটা কুকুরের জন্য সবার জীবন শেষ করে দিবে তুমি?”
আমি চিৎকার করে উঠি,”আর একটা কথাও বলবে না তুমি। তুমি চলে যাও এখান থেকে। নিজের জীবন বাঁচাও। আর বাহাদুর আমার কাছে সামান্য কুকুর নয়। ও আমার কাছে কী এটা আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমার বাহাদুরকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দিয়ে আমি এখান থেকে স্বার্থপরের মতো চলে যাবো? কোনোদিন হতে পারে না। তুমি চলে যাও। যদি বাঁচি বাহাদুরকেও সাথে নিয়ে বাঁচবো। মরলেও একসাথেই মরবো। তুমি যাও। যাও বলছি।”
হঠাৎ করে ঘরের দরজা খুলে গেলো। আমি তাকাতেই দেখলাম আর আব্বা, মা, রাফি নাফি আর রাণী। রাণী ঘরে ঢুকেই বাহাদুরকে দেখলো ওদের মাঝে। ওর সারা শরীর কেঁপে উঠলো। ছুটে যেতে লাগলো সেদিকে। আব্বা ওকে চেপে ধরলেন। মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
“চল মা, এখান থেকে পালা। চল।”
আমি চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মা আমাকে একচুলও সরাতে পারলো না।
“মা, তোমরা সবাই পালাও। বাহাদুরকে না নিয়ে আমি এখান থেকে এক পা ও নড়বো না।”
“তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে তিথি? এরা কারা আমরা জানিনা। তবে আমার মনে হচ্ছে এখানে থাকলে সবাই মরবো আমরা। আর মা হয়ে তোকে এখানে রেখে আমি কীভাবে যাবো? চল আমার সাথে।”
আমি দরজার বাইরে তাকালাম। প্রকৃতি দেখে মনে হলো আজান দিতে আর খুব বেশি দেরী নেই। হয়তো আর দুই/তিন মিনিট। আমার মন বলছে আজান দেওয়ার আগেই এই বাড়ি ধ্বংস হবে। যা করার আমাকে এর মধ্যে করতে হবে। আমি বাহাদুরের চোখের দিকে তাকালাম। ওর চোখে আমার জন্য সীমাহীন ভালোবাসা। যদি ওর জবান থাকতো, তবে হয়তো এখন বলতো সবাই পালাও, আমার যা হয় হোক। সবাই পালাও।
হঠাৎ খেয়াল করলাম নরপশু গুলো আস্তে আস্তে মানুষের রূপ থেকে বের হয়ে আসছে। প্রথমে হাত পায়ের নখগুলো ইয়া বড় বড় হয়ে গেলো, সারাগায়ে কালো পশমে ভরে যেতে লাগলো। দাঁতগুলো বড় হতে হতে প্রায় বুক পর্যন্ত নেমে আসতে লাগলো। বুনো পশুদের মতো হতে থাকলো সবাই। মা “ইয়া আল্লাহ” বলে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আব্বা রাণী,রাফি আর নাফিকে জড়িয়ে ধরলো। আমার কেনো জানি ভয় হলো না। এতোগুলা নরপশুর মধ্যে আমার বাহাদুর একা। কি ভীষণ অসহায় লাগছে ওকে। ওই মেয়েটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। মনে হয় পালিয়েছে। এতোকিছু ভাবার সময় নেই। মাত্র এক মিনিটের মধ্যে বাহাদুরকে এদের হাত থেকে রক্ষা করে এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে।
আমি এগিয়ে যাবো ঠিক তখন “ইয়া আল্লাহ” বলে একটা আর্তচিৎকারে আমরা থমকে গেলাম। হ্যা ওই মেয়েটা যাকে কিনা আমি ভেবেছিলাম সুযোগ বুঝে পালিয়েছে ও একটা ধাতব গাছের গুঁড়ির মতো একটা জিনিস মাথার উপরে তুলে নিয়েছে। যেটা দেখে মনে হলো ওটার ওজন ১০-১২ কেজি হবে। কিন্তু এতো ভারী একটা জিনিস ও কীভাবে উঁচু করলো। সবাই অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। ও ফুঁসতে ফুঁসতে ওই ধাতব জিনিসটা নিয়ে ছুটে যেতে লাগলো ওদের মাঝে। ঠিক তার পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় কাউকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই ওই জিনিসটা ছুঁড়ে দিলো আবু মিয়ার মাথায়। যদিও সে এখন পশুরূপে আছে। বিকট একটা শব্দ হলো। আমরা সবাই কেঁপে উঠলাম। আবু মিয়ার হাত আলগা হয়ে গেলো চাপাতি থেকে। সেই সুযোগে বাহাদুর এক ঝটকায় ছুটে আসতে থাকে। দলের বাকি পশুগুলো ওকে আটকাতে যায় তার আগেই আমি ওকে ধরে ফেলি। পশুগুলো হন্যে হয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসতে থাকে। আমার মা আমাকে আর ওই মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরে ছুটতে ছুটতে পালিয়ে আসে ওই অভিশপ্ত ঘর থেকে। আব্বাও রাফি,নাফি আর রাণীকে নিয়ে ছুটে বের হয়ে আসে। আমার কোলে বাহাদুর চুপটি করে আছে আর বারবার পিছনে ঘুরে রাণীকে দেখছে যে ও ঠিক আছে কিনা।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওই অভিশপ্ত হানাবাড়ি থেকে বের হয়ে আসি আমরা। আর তার ঠিক দুই/তিন সেকেন্ডের মধ্যে বিকট একটা শব্দ শুনতে পাই আমরা পেছন থেকে। সেদিকে তাকিয়ে আমাদের গলা শুকিয়ে যায়। আগ্নেয়গিরির লাভা বিস্ফোরণ হলে যেমন দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ঠিক তেমন আগুন জ্বলছে ওই হানাবাড়ি থেকে। অবাক কাণ্ড, পাশের হানাবাড়িটাতেও একই ভাবে আগুন জ্বলছে। আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছি। আর ভিতর থেকে একদল নরপশু, হ্যা সেই রাঘানিয়া জাতির চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।