সকলে মিলেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জঙ্গলটার আরেকটু ভেতরে যাবে। রৈতির স্পষ্ট মনে আছে সে তার বান্ধবীদের সাথেই হাটছিল। হঠাৎ তার খেয়াল হলো তার আশেপাশে কেউ নেই। সে একা হেটে চলেছে। নিজেকে একা আবিষ্কার করে তারমধ্যে পুরোপুরি ভয়ের সঞ্চার করার আগেই সে চারপাশের প্রকৃতি দেখে বিমোহিত হয়ে পড়লো। কারো সাজানো বাগানে যেন ঢুকে পড়েছে সে। অদ্ভুত রকম দেখতে গাছ, গুল্ম লতা-পাতা গুলো। অদ্ভুত রকম অপরিচিত সব গাছ। সবগুলো গাছই গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত একই রকম, কিন্তু গাছগুলোতে ফোটা ফুল গুলো আলাদা আলাদা। সে বোটানির ছাত্রী হওয়ার সুবাদে অসংখ্য ফুল এবং উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এরকম গাছ বা ফুল সে এর আগে কখনই দেখেনি। যেন সে কোনো রূপকথার রাজ্যে চলে এসেছে। এই গাছগুলো আর ফুলগুলোরও যেন প্রাণ আছে। সে স্পর্শ করতে গেলে এগুলো কথা বলে উঠবে।
সে কিছুটা সংকোচ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। সে যতই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরছে অন্ধকার। অথচ সূর্যের আলোকে আড়াল করার মতো ঘন বা লম্বা কোনো গাছ আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ তার মনে হলো পেছন থেকে সমন্বিত কোমল অসংখ্য কন্ঠস্বর তাকে সামনে এগোতে নিষেধ করে চলেছে। সুরেলা চিকন কণ্ঠ। তার পেছনে তাকাতে ইচ্ছা করছে না। এগিয়েই চলেছে সামনে। চারপাশ পুরোপুরি অন্ধকারে ঢেকে যাওয়ার পরও অন্ধকার হাতড়ে এগোচ্ছে সে। হঠাৎ সামনে শক্ত কিছু একটার ধাক্কায় থমকে দাঁড়ালো সে। দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো নাকি! জঙ্গলে দেয়াল! ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করছে সে। না, বড় একটা গাছ। তবে এর ছাল কেমন যেন তুলতুলে লাগছে। তখনই চারপাশে মৃদু আলো ছড়াতে শুরু করলো। আলোর উৎস অজানা। সেই আলোতে স্পষ্ট হয়ে এলো আবার চারপাশ। ঠিকই আন্দাজ করেছিল সে। তার সামনে একটা মোটা গাছ। হঠাৎ করেই গাছটা কেঁপে উঠে নড়তে লাগলো। আৎকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে এলো রৈতি।
গাছটা এবার উল্টো ঘুরে গেল। অদ্ভুত দুটি মানুষের মতো চোখ আর চওড়া মুখ বেরিয়ে এলো তার ছাল ফুঁড়ে। কী বেমানান! ওটার মুখটা যেন হাসি হাসি হয়ে আছে। থরথর করে কাঁপতে লাগলো রৈতি। গাছটা যদি কথা বলতে শুরু করে এখন, নিশ্চিত সে জ্ঞান হারাবে। গাছ কোনো কথা বললো না। তবে তার মাথার দুইপাশের ছাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো দুটি লম্বা ডাল। ওগুলোকে গাছটির হাতের মতো ব্যবহার করছে। ওটার একটি হাত মুঠিবদ্ধ অবস্থায় চলে এলো তার মুখের কাছাকাছি। মুঠো খুলতেই সেখানে দেখা গেল একটি গাছের বীজ। রৈতি অবাক হয়ে গাছটির দিকে তাকালো। এই বীজটি তাকে ইশারায় নিতে বলছে গাছটি। সে বীজটি তুলে নিল। সাধারণ যেকোনো ফুল-ফল গাছের বীজ থেকে আলাদা এবং বড় এটি। হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে গাছটার দিকে তাকালো আবার সে।
গাছটা এবার পেছাতে শুরু করলো। পেছাতে পেছাতে অদৃশ্য হয়ে গেল আধারে। তখনই তার সমস্ত শরীর কম্পিত হয়ে উঠল। রৈতি লক্ষ্য করলো তার শরীর ধীরে ধীরে একটি গাছে পরিণত হচ্ছে। সে চিৎকার করার জন্য মুখ খুললো আর তার মুখ ফুঁড়েও বেরিয়ে এলো একটি ডাল। পুরোপুরি স্থির একটি গাছ এখন সে। তখনই প্রচণ্ড আরেকটা কম্পন অনুভব করলো সে।
ঘুম ভেঙে গেছে তার। কী অদ্ভুত স্বপ্ন ছিল এটি! সে খেয়াল করলো তার হাত এখনও মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রয়েছে স্বপ্নের মতো। বিস্ময়, কৌতুহল আর আতংক নিয়ে সে মুষ্টি খুললো। না, কিছুই নেই হাতে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ৩ দিনের জন্য জঙ্গলে বেড়াতে এসেছে সে বান্ধবীদের সাথে। ২য় দিন রাতে ক্যাম্প ফেলে জঙ্গলের নিরাপদ জায়গাতেই ঘুমিয়ে রয়েছিল সে তাদের সাথে। তখনই এই স্বপ্ন উকি দিল।
ঘড়িতে এখন ভোর ৫টা বাজে। সূর্য উঠতে আর বেশি দেরি নেই। সে উঠে আজকের দিনের পরিকল্পনার ছকটায় চোখ বুলিয়ে নিল। এই সময় একটু চা বা কফি হলে ভালো হতো। ফ্লাক্সে আছে কী!
খুবই ভালোভাবে জঙ্গলে তিন দিন কাটিয়ে পিকিনিকের পুরো দলের সাথেই সে বাড়িতে ফিরে এলো। এরপর একদিন সকাল বেলা মালির সঙ্গে বাবার চিৎকারের শব্দে রৈতির ঘুম ভেঙে গেল। বাগানে গিয়ে দেখল অনুমতি ছাড়া বাগানে আজেবাজে গাছ লাগানোর জন্য বাবা মালিকে এভাবে ধমকাচ্ছেন। মালি বারবার বলছে চারাটি সে লাগায়নি। কাউকে লাগাতেও দেখেনি। এমনকি গতকাল বিকালে বাগানের গাছগুলোতে পানি দেওয়ার সময়ও এটা এখানে ছিল না। চারাটিকে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে না নতুন লাগানো হয়েছে। যেন মাটি ভেদ করে উঠে আসা একটি চারা। কিন্তু রৈতিও চারাটিকে গতকাল এখানে দেখেনি।
এটি কী ফুল গাছ নাকি ফল গাছ নাকি জংলি কোনো গাছের চারা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চারটিতে শুধু দুটি ডাল রয়েছে, কোনো কুঁড়ি বা পাতা নেই। রৈতির বাবা মালিকে চারাটি তুলে ফেলতে বললেন। রৈতি ঝুকে আলতো করে চারাটির ডগা স্পর্শ করল। কেন যেন চারাটির জন্য একটি অপূর্ব মায়া অনুভূত হলো তার মনে। সে বাবাকে অনুরোধ করলো গাছটি না কাটতে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্রীর এমন আচরণে বাবা অবাক হলেন না। বরং তার রাগ অনেকটা কমে এলো। কে জানে নতুন কোনো ধরণের উদ্ভিদ হতে পারে এটি! কৌতূহলতাই তো মানুষকে সমৃদ্ধ করেছে।
সময় কেটে যায় ক্রমশ। এত দ্রুত কোনো গাছ যে বেড়ে উঠতে পারে তা রৈতির ধারণা ছিল না। মাত্র ৮ মাসে গাছটি প্রায় ৭ ফুট উঁচুতে উঠে গেছে। এর কাণ্ড এর ব্যাসও হবে প্রায় ৪ ফুট। বেশ অদ্ভুত দেখতে এর ছাল। সবুজ আর বাদামি মিশে আছে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে গাছটির কোনো লতা-পাতা নেই। সোজা গাছটি থেকে দুদিকে শুধু ছড়িয়ে আছে দুটো মোটা ডাল। অজানা গাছটির এমন অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য থাকার পরেও কিন্তু রৈতি এটির প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছে না। শুধু গাছটি নয় পুরো বাগানের দিকেই তার কোনো মনোযোগ নেই।
কয়েক মাস ধরে তার বাবা অত্যন্ত অসুস্থ। হাসপাতালে নিয়ে চেকআপ করানো, বাড়িতে শুশ্রূষা , ভার্সিটির ক্লাস সামলাতে গিয়েই তার হিমশিম অবস্থা। ৪ মাস আগে বাগানের মালি খবর পায় গ্রামে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে তার একমাত্র মেয়ে মারা গেছে। বেতন নিয়ে মালি সেদিনই চলে যায়। এরপর আর আসেনি। রৈতিও আর খোঁজ খবর নেয়ার অবসর পায়নি। বাগানটি এক প্রকার অযত্নেই পড়ে আছে।
সময় বয়ে চলে। ক্রমশ আকৃতিতে বড় হচ্ছে সেই অচেনা চারা গাছটি। তবে রৈতি বা তার বাবা কেউই গাছটাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পেল না। তাছাড়া কারো নজরে এটাও এলো না, বাগানে কিংবা বাড়ির আশেপাশে এখন পাখিদের আনা-গোনা একদমই নেই। যেখানে আগে সন্ধ্যায় চেয়ার পেতে বসে রৈতি রোজ পাখির কিচির-মিচির শুনতো। বাগানের সব গাছগুলোও ধীরে ধীরে শুকাতে শুকাতে মরে যাচ্ছে। যেন ওগুলোর শক্তি, প্রাণ কেউ শুষে নিজের মধ্যে নিয়ে হত্যা করেছে ওদের।
এরপর প্রায় এক বছর কেটে গিয়েছে। রৈতির বাবার ফুসফুসে এক অদ্ভুত ভাইরাস জনিত রোগ ধরা পড়েছে। প্রাকৃতিক উপায়ে শ্বাস নেওয়া তার পক্ষে এখন খুব কষ্টের। তাকে হাসপাতালেই থাকতে হয়, কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চলে। মানসিক ভাবেও রৈতি বেশ ভেঙে পড়েছে। নিঃসঙ্গতায় ভোগে প্রায়ই।
একদিন আনমনে বাগানে হাটতে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো বাগানে কোনো ফুল-ফুল, ঔষধি গাছই আর বেঁচে নেই। ওগুলোর শুকনো ডাল আর কাণ্ডই শুধু নেতিয়ে পড়ে আছে মাটিতে। আর বাগান ভর্তি হয়ে জংলি গাছের মতো অসংখ্য নতুন চারা উঠে আসছে। ক্রমশ দিনের পরিবর্তনের সাথে সাথে অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে উঠছে চারাগুলো। পরিণত হচ্ছে বড় গাছে। সবগুলো গাছের মধ্যে মিল একটাই সেটা হচ্ছে কোনো গাছেরই পাতা নেই আর ছালগুলো অদ্ভুত। কিন্তু দেখতে প্রতিটি গাছ থেকে প্রতিটি গাছই আলাদা।
রৈতির হঠাৎ মনে হলো ওই অদ্ভুত চারাটি যেদিন থেকে এই বাগানে জন্ম নিয়েছে তারপর থেকেই তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, মালির পরিবারে দুর্ঘটনা ঘটেছে, বাগানের সব গাছগুলো মরে গেছে। সে কতদিন ধরে পাখির ডাক শোনে না। অথচ গাছের পরেই তার সবচেয়ে প্রিয় শখ ছিল পাখির জগৎ।
সে সিদ্ধান্ত নিল গাছগুলোকে কেটে ফেলবে লোক আনিয়ে। কিন্তু এরপরে তার বাবার অসুস্থতা ক্রমশ এমন ভয়ানক আকার ধারণ করলো যে সে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসাই বন্ধ করে দিল। টানা ৩ মাস যুদ্ধের পর ফুসফুস অবশ হয়ে এলো বাবার। ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেলেন তিনি। একমাত্র অভিভাবক বাবাকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে উঠল রৈতি। ভেবে দেখল দেশে তার আপন আর কেউ রইলো না। তার লেখাপড়াও শেষ হয়ে গেছে। বিদেশে পি.এইচ.ডি করার একটা সুযোগ এসেছিল সামনে। বাবার কারণেই আটকে রেখেছিল সে এতদিন। এবার মনে হচ্ছে কয়েক বছর দেশের বাইরে থেকে আসা উচিত।
বাগানের দিক থেকে মনোযোগ একেবারেই সরিয়ে নিয়েছে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় বিদেশ যাওয়ার সব আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলল সে মাস খানেকের ভেতর।
আগামীকাল সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। বাবার স্মৃতি হিসেবে এই বাড়িটা বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আর অদ্ভুত সেই গাছগুলো! ওগুলো কাটার প্রয়োজন নেই। বাবার মৃত্যু বা তার জীবনের এই হীন অবস্থার পেছনে গাছের প্রভাব আছে এমন চিন্তা পূর্বে মনে আসায় লজ্জিত হলো সে। গাছগুলোকে আজ তার কাছে সুন্দরই লাগছে। অদ্ভুত রঙের পাতাবিহীন সব বড় বড় গাছগুলো। যা আশেপাশে দেখা যায় না। বিশাল লম্বা আর মোটা হয়েছে একেকটা। ঘরে ফিরে যাবে, হঠাৎ তার মনে হলো আশেপাশের সমস্ত কিছু কম্পিত হয়ে উঠল। একি, গাছগুলো নড়ছে! ভয়ানক ভাবে। ওগুলোর উপরে ছড়িয়ে পড়া ডালদুটো হাতের রূপ ধারণ করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। অসংখ্য গাছের হাত তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। সবগুলো হাত মুঠো করা। মুঠো গুলো খুলে যেতেই সেখানে দেখা মিলল একটা করে বীজ। প্রতিটা বীজই দেখতে আলাদা আলাদা বড় আর ভিন্ন রঙের। রৈতির মনে হচ্ছে আগে ঘটা একটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে তার সাথে আবার। সে কতক্ষণ চারপাশে তাকিয়ে জ্ঞান হারালো।
কয়েক মুহূর্ত পরে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে জ্ঞান ফিরলো তার। নাক যা যা করছে। প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। এম্বুলেন্স এ কল করলো সে কিছুটা শক্তি ফিরে পেয়েই।
ডাক্তারেরা বিস্মিত হলেন রৈতির অসুস্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে। এক অজানা ক্ষতিকর গ্যাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসকে বিষাক্ত করে ফেলেছে মেয়েটার। ঠিক যেমনটা তার বাবার চিকিৎসা করতে গিয়ে পেয়েছিলেন। প্রথমে ভাইরাস সন্দেহ করলেও পরে তারা নিশ্চিন্ত হয়ে বলেছিলেন কোনো গ্যাসের প্রভাবেই রৈতির বাবার স্বাস্থ্যের এই দুরবস্থা ঘটে। কিন্তু একই জিনিস রৈতির সঙ্গেও কী করে ঘটলো! মনে হচ্ছে প্রাকৃতিক কিছুর পঁচন থেকে সৃষ্টি হয়েছে এই গ্যাস। মেয়েটার বাক শক্তিও প্রায় ফুরিয়ে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হয় অনেক। বিড়বিড় করে যা বলছে তা এমন, ‘বাগান,,বাআআআগান,,,বীইইইইইজ,,গাছ,,,প্রাণবন্ত,,,,,জঙ্গল,,,,স্বপ্ন,,,!’
আরও কিছুদিন পররৈতি আশেপাশের সমস্ত ঘটনা অনুধাবন করতে পারছে, কথা শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু মুখে কিছু বলার শক্তি তার নেই। এখানে এভাবে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। তার ইচ্ছা করছে বাড়িতে ফিরে যেতে। বাগানের গাছগুলোর কাছে যেতে। এই কৃত্রিম শ্বাস তাকে শান্ত করতে পারছে না। গাছগুলো যেন তাকে টানছে। অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করছে সে। পূর্বে কয়েকবার সে ডাক্তারদের বলেছে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে। ডাক্তাররা জানিয়েছে এটা অসম্ভব। সে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হবে তাকে। বাড়িতে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়।
হয়তো মধ্যরাত। রৈতির ঘুম ভেঙ্গে গেল। রৈতি অবাক হয়ে দেখছে তার চারপাশের সবকিছু বদলে যাচ্ছে। রাত থেকে ক্রমশ দিন হচ্ছে। হাসপাতালের সরঞ্জাম বদলে একটা জঙ্গলে পরিবর্তিত হচ্ছে সব। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলো জঙ্গলে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে হাটতে শুরু করলো সে। বিস্ময় নিয়ে তাকাচ্ছে চারপাশে। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই তার বাগানের সেই মাথাবিহীন মোটা অদ্ভুত গাছগুলোকে দেখতে পাচ্ছে। তবে এইসব গুলো গাছেই রয়েছে রঙিন ফুল। বাগানে যা ছিল না। আরও রহস্যময় আর আকর্ষণীয় লাগছে এখন তার গাছগুলোকে। একি ওরা চলতে পারে! হঠাৎ মাটি কম্পিত হলো, গাছগুলো সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। পেছনে, সামনে , শতশত গাছ সারি বেঁধে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রৈতিও তাদের সঙ্গে তাল রেখে ছুটতে শুরু করলো। প্রথমে ভয় পেলেও এখন তার কেমন আনন্দ লাগছে। নিজেকে তাদের দলে মনে হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে স্বাধীন একটা গাছ সে। তার পাশের একটা গাছ হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। ওটার চোখ না থাকলেও রৈতির মনে হচ্ছে গাছটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওটার মুঠো করা একটি হাত এগিয়ে এলো ধীরে ধীরে তার কাছে। অদ্ভুত একটা বীজ ওটার হাতে , তাকে নিতে বলছে গাছটা ইশারায়। এই বীজ সে চেনে।
সে হাত বাড়িয়ে নিজের হাতে তুলে নিল বীজটা। মুঠোতে পুড়তেই তার সমস্ত শরীর কম্পিত হয়ে উঠল। সে ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে যেন একটি গাছে। এবার সে ছুটছে গাছেদের সারির সঙ্গে একটা গাছ হয়ে। অদ্ভুত সব ফুল ফুটেছে তার ডালে। সে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ছে। কোথায় যাচ্ছে সে জানে না, তবে যেতে মোটেও মন্দ লাগছে না।
রাতের দ্বিপ্রহরে ডাক্তাররা মৃত অবস্থায় রৈতিকে পেল তার কক্ষের বিছানায়। ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে মেয়েটার। একজন ডাক্তার লক্ষ্য করলেন রৈতির বাম হাতটা মুঠো করে কিছু একটা ধরে রেখেছে। তিনি আলতো করে ওটা খুলতেই অদ্ভুত রকম বড় একটা রঙ্গীন বীজ বেরিয়ে এলো। ডাক্তার সেটা নিজের পকেটে ভরে নিলেন। মেয়েটার কয়েকজন বন্ধুকে তার মৃত্যুর খবরটা দিতে হবে।
রৈতিকে যখন কবর দেয়ার জন্য তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো সকলেই তাদের বাগানটি দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। অদ্ভুত দেখতে অসংখ্য পাতাবিহীন দুটি শাখা ওয়ালা গাছ ধূমরে মুচড়ে নুইয়ে পড়ে আছে বাগান জুড়ে। প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডবে যেন তাদের এই দশা! এমন অদ্ভুত গাছ তারা এর আগে কখনই দেখেননি।