পিছন থেকে নানু আমার হাত ধরে ফেলে আর আমি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যাই। নানু রাতে বাহিরে যাওয়ার জন্য বের হয়, তখন দেখে আমি যেই ঘরে ছিলাম সেই ঘরের দরজা খোলা। সে ঘরে গিয়ে দেখে আমি বিছানায় নেই, ওয়াসরুমেও নেই। পরে আমাকে ডাকতে থাকে। নানুর ডাকাডাকিতে মামা মামি উঠে যায়। কিন্তু আমি নানুর সেই ডাক শুনিনি। পরে নানু ঘরের পিছনে এসে দেখে আমি ডোবার দিকে নেমে যাচ্ছি দুহাত বাড়িয়ে। তাই সে তাড়াতাড়ি এসে পিছন থেকে আমার হাত ধরে ফেলে আর আমি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যাই। পরে আমার মামা আমাকে ঘরে নিয়ে আসে।
যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন সকালের সূর্য উঁকি দিচ্ছে জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর। ঘর থেকে বের হতেই দেখি মামি রান্না শেষ করে ফেলেছে। আমাকে দেখে মামি বলল,
– রিফাত তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। তোমার মামা বাজারে গেছে। বাজার থেকে উনি ফিরলেই তোমাকে নিয়ে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাবে। সাথে তোমার নানুও যাবে।
তখনই আমার কালরাতের ঘটনা মনে পড়ল। আমি তো বাশঝোপের ভিতর ছিলাম। যতদুর মনে পড়ে আমি ডোবার দিকে এগোতে লাগছিলাম। কিন্তু আর মনে পড়ছে না কিছুই। আমি মামিকে জিজ্ঞেস করলাম,
– মামি, আমি কাল রাতে বাহিরে গিয়েছিলাম প্র*সাব করতে। কিন্তু আমি কাউকে দেখে ডোবার দিকে এগোতে লাগছিলাম। তারপর আর কিছুই মনে পড়ছে না।
– কাকে দেখেছিলে?
– একটি বাচ্চা। সাত কী আট বছরের একটি ছেলে। কাঁদতে ছিল। যাকে এর আগেও দেখেছিলাম সেই ছেলেটি।
তারপর মামি কাল রাতের পুরো ঘটনা আমাকে বলল।
তারপর মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। আমার খাওয়ার সময় মামা বাজার থেকে ফিরেছে। সবাই আগেই খেয়েছে। আমার খাওয়া শেষ হলে আমি, মামা, আর নানু মিলে বেড়িয়ে পরি কবিরাজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তার বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে। আমাদের দুই গ্রামকে ভাগ করেছে ইছামতী নদী।
আমরা দুপুর ১২ টার কিছু সময় আগে সেখানে পৌছাই। গিয়ে দেখি তার কাছে অনেক মানুষ এসেছে। সবার সমস্যাগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের সিরিয়াল আসতে আসতে তখন প্রায় পড়ন্ত বিকেল। আমরা তিনজনে গিয়ে কবিরাজের ঘরে ঢুকলাম। তারপর পুরো ঘটনা তাকে খুলে বললাম। সে আমাদের পরের দিন আসতে বলল। কেননা সে আজরাতে তার জ্বিনের সাহায্যে এই ঘটনার কারণ আর সমাধান জানবে।
আমরা তিনজনেই বেড়িয়ে পড়ি কবিরাজের বাড়ি থেকে। আমরা নদীর কাছে আসতে আসতে প্রায় দেরি হয়ে গেছে। সেই সময় নদীতে প্রায় বুক সমান পানি রয়েছে। ছোট্ট নদীর উপর বাশের সাঁকো বানানো হয়েছে দুই গ্রামের মানুষের পারাপারের জন্য। যখনই নদীর ধারে আসলাম, তিনজনেই দেখলাম সাঁকোর সাথেই কেউ বসে আছে। দু পা জড়িয়ে হাঁটুতে মুখ রেখে কান্না করছে।
কান্নার শব্দ শুনেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটি হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল। এটি যে সেই চেনা বীভৎস কান্না। এ তো সেই ছেলেটি। তখনই ছেলেটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে, “আমাকে বাঁচান।”
আমি আর মামা কিছুটা ভয় পেলেও আমার নানু ভয় পায়নি। তিনি দোয়া পড়ে এগোতে থাকেন। আর আমাদের বলেন, “তোরা দুজন আমার পিছু পিছু আয়।”
নানু দোয়া পড়ে এগোতে শুরু করলেন। নানু এবার একটু জোরেই দোয়া পড়া শুরু করলেন। হটাৎ করেই তখন দেখি ছেলেটি উধাও। আমরা তিনজনই হাফ ছেড়ে বাঁচি। আমি আর মামা দুজনেই ঘেমে একাকার। কী বীভৎস সেই চেহারা। যখনই আমরা সাঁকোর বাশে হাত রাখলাম তখনই একটি তীব্র গন্ধ নাকে এলো। মনে হচ্ছে কোন পঁচা জিনিস অনেকদিন ধরে পানিতে ফেলে রাখা হয়েছে। আমরা দ্রুত বাড়ি পৌঁছে যাই।
পরের দিন,
আমরা কবিরাজের বাড়িতে যাই। তিনি আমাদের বসিয়ে বলতে শুরু করেন।
– এই ছোট্ট ছেলেটি পানিতে পড়ে মারা যায়। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যাটা হলো তার দাফনে। তার দাফন ঠিক মতো দেওয়া হয়নি। যার জন্য ছেলেটির আত্মা এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনারা যত দ্রুত পারেন ছেলেটির দাফন আবার নতুন করে করানোর ব্যবস্থা করুন।
আমরা সবটা শুনে চলে আসবো ঠিক তখনই মনে পড়লো গতকাল ঘটে যাওয়া নদীর পাড়ের ঘটনা। সে ঘটনা কবিরাজকে খুলে বললাম। তিনি আমাদের তিনজনের হাতে তাবিজ বেঁধে দিলেন।
সেইদিন বাড়ি ফিরেই আব্বুকে সবটা জানানো হয়। তিনি ছেলেটির পরিবারের সাথে কথা বলেন। তারপর একটি হুজুরকে সাথে নিয়ে সবকিছু ঠিক করা হয়। তারপর থেকে আর কোন সমস্যা নেই। কেটে গেছে।
আপনাদের আরেকটি কথা বলা হয়নি। যখন ছেলেটিকে নতুন করে দাফন দেওয়ার জন্য কবর থেকে উঠানো হয়, তখন দেখা যায় ছেলেটির দুটো চোখই নেই। চোখের জায়গায় বিশাল দুটি গর্ত।
প্রায় এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। আমি রাতে বাসায় ফিরছি তখন কেউ রাস্তার পাশে বসে রয়েছে মনে হচ্ছে। যেই আমি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসবো তখন আবার সেই কণ্ঠ।
– আপনাকে ধন্যবাদ। আমাকে বাঁচানোর জন্য।
বলেই আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো। সেই একই চেহারা, আজকে শুধু ছেলেটির মুখে হাসি। কী আশ্চর্য! আমার একটুও ভয় করছে না সেই বীভৎস চেহারা দেখে। বরং ছেলেটির সাথে সাথে আমিও একটি ছোট্ট হাসি দিলাম। চোখের একটি পলক পড়তেই দেখি সেখানে কেউ নেই।
এটা কী ভূত ছিল? নাকি আমার ইলিউশন?