মর্গে নাইট ওয়াচম্যানের চাকরি’টা পেয়েছি সপ্তাহ খানেক হলো। চার দেয়ালের শ’খানেক লাশের মাঝখানে বসে থাকার দায়িত্ব টা একটু ভয়ানক বটে। রাত প্রায় বারোটা বাজতে চললো। ডে ওয়াচম্যান অস্টিন বাবু চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে,রেকর্ডের খাতা দেখিয়ে কাজ গুলো বুঝিয়ে দিলেন আমায় প্রতিদিনের মতই। অস্টিন বাবু চলে যেতেই লোহার দরজা লক করে চলে এলাম মেইন রুমে। এখন আমার অবসর সময়। আজ নতুন কোনো লাশ আসেনি। এইজন্য পরিশ্রম ও কম, কষ্ট করে আর লাশ কাটার আয়োজন করতে হবে না। আনমনে বসে রেকর্ডের ভারি খাতাটায় চোখ বুলাতে লাগলাম। এই খাতায় মর্গে যতগুলো মৃতদেহ আছে, আসছে, বিদায় নিয়েছে তাদের সমস্ত হিসেব লেখা থাকে। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম ২৭ নম্বর ড্রয়ারটা বেশ কয়েকদিন যাবৎ খালি পড়ে আছে। এই ড্রয়ার টাতে কোনো মৃতদেহ রাখা হয়নি।
মিনিট ছ’য়েক পর হঠাৎ যেনো কোনো একটা ড্রয়ার একটু নড়ে উঠলো। চারপাশের ড্রয়ার গুলোতে চোখ বুলিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম, কোন ড্রয়ার টা! চেয়ার থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে লাগলাম প্রত্যেকটা ড্রয়ার। কিছু বুঝতে না পেরে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। বেশ কিছু সময় পার হওয়ার পর স্পষ্ট শুনতে পেলাম সাতাশ নম্বর ড্রয়ার টা থেকে এক বিদঘুটে আওয়াজ আসছে। কোনো মেয়ের কান্না জড়িত কণ্ঠ। ভয়ে ভয়ে সাতাশ নম্বর ড্রয়ার টার সামনে গেলাম। ড্রয়ারের হাতলে ধরে সজোরে একটা টান দিলাম। নিচে লাগানো চাকায় ভর করে বাইরে বেরিয়ে এলো ড্রয়ার টা। একটু ঝুঁকে ড্রয়ারের ভেতরে তাকাতেই একজোড়া মৃত চোখের দৃষ্টি এসে পড়লো আমার দিকে। চোখে মণি নেই। চোখ হতে অঝোরে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আমার মুখ থেকে অজান্তেই একটা চাঁপা চিৎকার বের হয়ে এলো। আঠারো-ঊনিশ বছর বয়সী এক যুবতীর মৃতদেহ। মৃতদেহ তো নয় যেনো ক্ষত-বিক্ষত হওয়া পুতুল, ছুড়ির আঘাতে ঝলসানো চামড়া, হাতের আঙুল নেই বেশ কয়েকটা। মেয়েটা ছোট্ট একটা লকেট পড়ে আছে গলায়। তার মাঝে খোদাই করে ইটালিক অক্ষরে লেখা ‘এ্যালেনোর’।
দৌড়ে পাশের রুমে চলে গেলাম রেকর্ডের খাতাটা আবার চেক করতে। সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে সাতাশ নম্বর ড্রয়ারে কোনো লাশ নেই। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, শরীর থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেনো ডাকলো ‘অ্যাডিসন,অ্যাডিসন’! পেছন তাকাতেই দেখলাম সেই মেয়েটার মৃতদেহ সঙ্গে বিশ্রী দেখতে একটা পুতুল। পুতুল টা হাসছে কি ভয়ানক ভাবে! ইতিমধ্যেই রুমের লাইট অফ-অন হতে শুরু করলো। চারপাশের দেয়ালের মাঝখান থেকে ভেসে আসতে থাকলো লাশ গুলোর আত্মচিৎকার। নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলাম না। জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে গেলাম ফ্লোরে।
সকালে নিজেকে আবিষ্কার করলাম নিজের ছোট্ট রুম’টায়। শুনলাম মর্গে’র কেয়ার টেকার নাকি আমায় অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে লাশঘরে। সেখান থেকেই বাসায় দিয়ে যায় কিছুক্ষণ আগে। মেয়েটা’কে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন মনে ঘোরপাক খাচ্ছে। কে এই এ্যালেনোর? পরদিন রাত ১১:৩০ চলে গেলাম মর্গে। অস্টিন বাবু চলে গেছেন প্রায় মিনিট দশেক আগে। অখণ্ড সময় কাটাতে চলে এলাম মর্গের কেয়ার টেকারে’র কাছে। হঠাৎ কেয়ার টেকারকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মর্গে কি এ্যালেনোর নামের কোনো মেয়ের বডি এসেছিলো? বয়স ১৮ কিংবা ১৯ হবে!” কেয়ার টেকার বললেন, বছর তিন’এক আগে এ্যালেনোর নামের মেয়ের বডিটা একদল উদভ্রান্তের মত লোক এসে মর্গে দিয়ে যায়। মাসের পর মাস পার হয়ে যায় কিন্তু বডি কেউ নিতে আসে না। এইজন্য মেয়েটার লাশ মর্গের পেছন দিকের বাগান টায় পুঁতে দেওয়া হয়েছিলো। মেয়েটার সাথে একটা পুতুল ছিলো। পুতুল টাকে রাখা হয় মর্গের স্টোর রুমে। এরপর থেকে ভীষণ ভয়ংকর এক ব্যপার ঘটতো প্রতিদিন রাতে,সেই স্টোর রুম থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতো। তাই পুতুল টাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো। কিছুদিন পর জানা যায় এ্যালেনোর পাশের শহর টা তে থাকতো। এক বৃদ্ধা মহিলা ছিলেন যার কাছে এ্যালেনোর বড় হয়েছিলো, বাবা-মা ছিলো না এ্যালেনোরের। বৃদ্ধা অসুস্থ ছিলেন, চিকিৎসার অভাবে প্রায় মড় মড় দশা। একদিন কিছু লোক বৃদ্ধার বাড়িতে আসেন এবং বলেন এ্যালেনোর কে তারা কাজ দেবে,তার দেখাশোনা করবে এবং বৃদ্ধার চিকিৎসাও করাবেন। লোক গুলোর আচরণ দেখে তাদের উপর বিশ্বাস জাগে, তাই এ্যালেনোর কে সাথে দিয়ে দেয় সঙ্গে এ্যালেনোরের প্রিয় পুতুল টাও। মাস যায় বছর যায় এ্যালেনোর আর ফেরে না। বৃদ্ধা এ্যালেনোরের চিন্তায়, চিকিৎসার অভাবে একদিন মারা যায়। বেশ কিছুদিন পর এ্যালেনোরের ঠাই হয় মর্গের এই সাতাশ নম্বর ড্রয়ার টাতে। এ্যালেনোর কিভাবে মারা গেলো তা এখনো জানা যায় নি। পুলিশ অনেক ইনভেসটিগেশন করার পরও জানতে পারেনি। এ্যালেনোরের মৃতদেহ যারা নিয়ে এসেছিলো তাদের ও আর খোঁজ পাওয়া যায় নি কখনো। এ্যালেনোরের মৃতদেহ মর্গে আসার পর থেকে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। কোনো মানুষ’ই দু’দিনের বেশী নাইট ওয়াচম্যানের কাজ টা করতে পারে না। ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যায়।
মেয়েটার প্রতি বড্ড মায়া হলো। তৎক্ষনাৎ ছুটি গেলাম লাশঘরে। সাতাশ নম্বর ড্রয়ারটা এক টানে খুলে ফেললাম। ড্রয়ার ফাঁকা, এ্যালেনোর নেই। শুধু পুতুল টা পড়ে আছে। পুতুলের সম্পূর্ণ শরীর রক্তাক্ত। উপর থেকে শরীরে কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়লো। কাঁপা কাঁপা শরীরে উপর দিকে তাকাতেই দেখলাম এ্যালেনোর ফ্যানের উপর বসে দোল খাচ্ছে আর বিকট স্বরে হাসছে আমার দিকে লক্ষ্য করে। হঠাৎ রক্তাক্ত পুতুল টা আমার মুখের উপর এসে ঝাপটে ধরলো! আমি ভয়ে আত্মচিৎকার করতে করতে লুটিয়ে পড়লাম ফ্লোরে।
এই ঘটনার পর থেকে আমার আর মর্গে যাওয়ার সাহস হয়ে উঠেনি। চাকরি টা ছেড়ে দিলাম। মাস দু’য়েক কেটে গেলো তবুও এ্যালেনোরের কথা ভোলা সম্ভব হচ্ছে না। খুব জানতে ইচ্ছা করে কি এমন ঘটেছিলো এ্যালেনোরের সাথে! আসল রহস্য টা কি!