শশী, ওর ছেলে সাদাত আর শশীর শালি স্বর্না গল্প করছিলো শশীর বাসার ড্রইং রুমে বসে। শশীর বউ শাম্মী একটা ট্রেতে চা আর গরম পকোড়া নিয়ে ঢুকল।
সাদাত টিভির ভলিউমটা একটু কমাও, আমরা খালামনির কাছ থেকে জ্বীন ধরার গল্পটা শুনবো।
স্বর্না একটু মুচকি হেসে নিলো শাম্মীর কথা শুনে। ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের অফিসার ও।
হ্যাঁ, স্বর্না শুরু করো। কিভাবে দীপের খুনিকে ধরলে?
হ্যাঁ ভাইয়া, আপনি যেদিন আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, যে আপনার বন্ধু দীপকে নাকি জ্বীনে মেরে ফেলেছে, আমার একটু খটকা লাগে। আর আমি ওই সময় ছিলামও খোকসাতে, কুমারখালির পাশের থানা। তাই ভাবলাম একটু স্পটে যেয়ে দেখি, আসলে ব্যাপারটা কি। পকোড়া চিবোতে চিবোতে স্বর্না বললো।
স্থানীয় থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের সাথে কথা বললাম। আর ভিক্টিম মানে দীপ ভাইয়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখলাম। লাঠি বা রড জাতীয় কিছু দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে তাকে। মুখ থেতলে দাঁত বের হয়ে এসেছে, বেশ ব্রুটালি মারা হয়েছে, আর খুনি মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পিটিয়েছে। স্থানীয় সবাই বলছে অবশ্য জ্বীনে মেরেছে, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, জ্বীন-ভূত কিছু না, ইটস এ ক্লিয়ার কেস অফ মার্ডার।
দীপ আমার স্কুলের বন্ধু। ওকে জ্বীনে মেরে ফেলেছে শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। তাই তোমাকে বলি, একটু খোঁজ নাও আসল ব্যাপারটা কি…আর জ্বীন-ভূত আমিও বিশ্বাস করি না। দীপ ওর মরার কিছুদিন আগে আমাকে ফোন করেছিল। একটা ব্যাপারে ভয় পেয়েছিল। শশী বলে।
আমি তোমার কাছ থেকে ওই ঘটনাটা শুনে বুঝতে পারি যে ওইদিনও দীপ ভাইয়ার উপর হামলা হয়েছিল। কেউ এসে পড়ায় বা অন্য কোন কারনে খুনি ওই দিন সফল হতে পারেনি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে স্বর্না বলে।
যাইহোক, পুলিশ দীপ ভাইয়ের কেসটাকে অতটা গুরুত্ব দেয় নি। কারণ এখন দেশের যে পরিস্থিতি, সবাই করোনা ভাইরাস নিয়ে ব্যাস্ত, তাই আমি নিজে উদ্যোগি হয়ে কেসটার তদন্ত শুরু করি। স্বর্না বলে চলে।
খুনের তদন্তে একটা কথা আছে, যে খুন হয় তার ব্যাপারে খোঁজ নাও, খুনির পরিচয় পেয়ে যেতে পারো। আমিও তাই করি। দীপ ভাইয়ের ব্যাপারে ভালো করে খোঁজ-খবর নিতে লাগলাম। জানলাম উনি ব্লগে লিখালিখি করতেন, ধর্ম বিরোধী, তাই প্রথমে ভাবলাম, এটা উগ্রপন্থী কোন সংস্থার কাজ হতে পারে। কিন্তু দীপ ভাইয়ের ফেসবুক হ্যাক করে তেমন কোন ক্লু বা প্রানে মেরে ফেলার হুমকি জাতীয় ম্যাসেজ পেলাম না। আর খুন হওয়ার প্যাটার্নটাও ডিফারেন্ট। ওই জাতীয় খুনে সাধারণত শার্প ওয়াপন দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে, আর এটা লাঠি বা রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা। তাই আমার সন্দেহ এবার অন্যদিকে গেল। খোঁজ নিতে লাগলাম দীপ ভাইয়ের খুনে সবচেয়ে বেশি লাভ হলো কার? খোঁজ নিয়ে জানলাম পোস্ট অফিসে দীপ ভাইয়ের বেশ ভালো একটা এমাউন্টের টাকা রাখা আছে, আর সেটার নমিনি কে জানো?
কে? শাম্মী প্রশ্ন করে।
খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, উনার স্ত্রী, ভাই, বোন কেউ না, বা কোন নিকট আত্নীয়ও না। নমিনি ছিল ওই খানকার মুদিখানার দোকানদার তালেব মোল্লার ছেলে, যার আবার একটা পায়ে একটু ডিফেক্ট আছে।
ওমা কেন? শাম্মী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
হুম কেন? চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে শাম্মী বলে। এটাই ছিল দীপ ভাই মার্ডার কেসের প্রথম ব্রেক থ্রু, খুনির পরিচয় পেতে যেটা আমাকে সাহায্য করে। এমন একজনকে তিনি নমিনি কেন বানাবেন?
খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ছেলেটা তালেব মোল্লার পালিত সন্তান। এক আত্নীয়ের কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন। আমি সেই আত্নীয়ের সাথে যোগাযোগ করি। জানতে পারি এক অজানা অধ্যায়!
দীপ ভাইয়ের বাসাতে একটা কাজের মেয়ে কাজ করতো, নাম ছিল সুফিয়া, মা আর একটা ছোট বোন ছাড়া সুফিয়ার আপন বলতে কেউ ছিল না। দীপ ভাইয়ের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক হয়, পেটে বাচ্চা আসে। সুফিয়াকে দীপ ভাইদের বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তারপর। সুফিয়ার মা, সুফিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন, ওই খানেই সুফিয়া একটা বাচ্চার জন্ম দেয়। আর বাচ্চা জন্ম দিতে যেয়ে সুফিয়া মারা যায়। সুফিয়ার মা বাচ্চাটাকে উনার প্রতিবেশীর কাছে দিয়ে সুফিয়ার ছোট বোনকে নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীতে সেই প্রতিবেশীর কাছ থেকে তালেব মোল্লা ছেলেটিকে নিয়ে আসেন। তাই, তালেব মোল্লার সেই ছেলেটি দীপ ভাইয়েরই সন্তান ছিল।
ওহ মাই গড। শশী বলে উঠে। কিন্তু এইখানে খুনি কে আর ওই ছেলেটার সাথে খুনির কি সম্পর্ক?
সেটা বলতেছি, একটু সবুর করো। স্বর্না মুচকি হাসে আবার।
ওইটা যে দীপ ভাইয়ের ছেলে, সেটা দীপ ভাইয়াও জানতে পেরেছিলেন, কিভাবে বলতে পারবো না। তবে সুফিয়াদের সেই প্রতিবেশীর বাসায় দীপ ভাই গিয়েছিলেন। আর ছেলেটিকে উনি খুব স্নেহ করতেন, এলাকার সবাই জানে সেকথা।
যাইহোক, আমি দীপ ভাই আর উনার ফ্যমিলির সবার মোবাইলের ফোন কলের রেকর্ড চেক করি। কারোর কাছে সন্দেহ করার মতো কিছু পাইনি, শুধু একজন ছাড়া।
কে সে? শাম্মী জিজ্ঞেস করে।
সীমা। দীপ ভাইয়ের স্ত্রী। প্রথম যেদিন দীপ ভাইয়ের উপর হামলা হয়, সেদিনও শেষ কলটা দীপকে সীমা করেছিল। আবার যেদিন খুন হন, সেদিনও দীপ ভাই শেষ কলটা করেন সিমাকে।
কিন্তু স্ত্রীতো স্বামী কে কল দিতেই পারে? শশীর প্রশ্ন।
দিতেই পারে, কিন্তু ওই কল দুইটার পরেই সীমা আরেকটি নম্বরে কথা বলে। যে নম্বটির লোকেশন দুইবারই ছিল খুনের স্পটে। আর সেই নম্বটি কার ছিল জানো?
কার?
দক্ষিন অঞ্চলের খুব ভয়ানক কন্টাক কিলার জাহাঙ্গীরের, সেই রকম মিশমিশে কালো চেহারা জাহাঙ্গীরের, যে কেউ দেখলে ভয় পাবে। আমি ইনফমারদের দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, জাহাঙ্গীর ওই সময় কুমারখালিতে ছিল । আর খুনের রাতে কুমারখালি বাস স্ট্যান্ডের কাছের জনতা ব্যাংকের সিসি টিভি ফুটেজে জাহাঙ্গীর ক্যাচ হয়। জাহাঙ্গীরকে পরবর্তীতে গ্রেফতার করি আমরা। সীমার কাছ থেকে টাকা নিয়েই যে ও দীপ ভাইয়াকে খুন করে, এটা ও স্বীকার করে। আর সীমার ব্যাংকের ট্রানজেকশন দেখেও আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারি। দীপ ভাইয়ার সাথে কথা বলে, সীমাই দীপ ভাইয়ের লোকেশন জাহাঙ্গীরকে জানিয়ে দেয়, প্রথম বার অসফল হলেও পরের বার ভুল করেনি জাহাঙ্গীর। সীমাকেও কাস্টোডিতে নেয়া হয়। সব কিছু স্বীকার করে, আর উপায়ও ছিল না স্বীকার না করে…জাহাঙ্গীর এর সাক্ষ্য , ফোন কল, ব্যাংকের ট্রানজেকশন…ওর বিরুদ্ধে অনেক প্রমানই ছিল।
কিন্তু সীমা দীপকে খুন করতে যাবে কেন? শশীর প্রশ্ন।
এটাই তো এই কেসের সবচেয়ে চমক জাগানিয়া অধ্যায়। স্বর্না বলে উঠে।
সুফিয়ার ছেলেটিকে প্রতিবেশীর কাছে দিয়ে সুফিয়ার মা ওর ছোট বোনকে নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পরবর্তীতে সুফিয়ার মাও মারা যান, ছোট বোনটি মানুষ হয় এতিমখানায়। লেখাপড়াতে ভালো ছিল অনেক, অনেক কষ্ট করে শেষ করে জবে ঢুকে। সুফিয়ার সেই ছোট বোনটি আর কেউ না দীপ ভাইয়ার স্ত্রী সীমা।
নিজের বোনকে চোখের সামনে মরতে দেখেছে। দীপ ভাইয়ের প্রতি রাগ ছোট বেলা থেকেই পুষে রেখেছিল। সোস্যাল মিডিয়ায় দীপ ভাইয়াকে খুঁজে পাওয়ার পর চিনতে পারে, আর ইচ্ছা করে তার সাথে রিলেশনে জড়ায়, বিয়ে করে। দীপ ভাইয়ের সেই পাপের শাস্তি আর বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ে। সবকিছু সীমা স্বীকার করেছে আমাদের জেরার মুখে। একটা পাপের শাস্তি হিসেবে আরেকটি পাপের জন্ম দেয় ও..
রুমের সবাই চুপ। নিরবতা ভাংগে শাম্মী।
এটা তো গল্প উপন্যাসকেও হার মানায় স্বর্না। কিন্তু মানতে হবে তোরও অনেক বুদ্ধি, তুই তদন্ত না করলে এই জ্বীনরূপী খুনি ধরা পড়তো না। শোন তোর জন্য আমি খুব ভালো একটা পাত্র দেখে রেখেছি। আর্মি অফিসার, তোর দুলাভাই এর বন্ধু।
তো সেই বন্ধুর আবার দীপ ভাইয়ের মতো কোন পাপ নাই তো, স্বর্না মুচকি হেসে বলে।
ওর কথায় তিনজনেই একসাথে হেসে উঠে।