নতুন বাসা

দুইহাজার স্কয়ার ফিটের এতবড় সুন্দর বাসাটার ভাড়া মাত্র আঠারো হাজার টাকা, আশ্চর্য বিশ হাজার টাকাও তো হতে পারতো তাই না। অথচ ভালো সিকিউরিটি সিস্টেম, মেইন রোডের কাছে, যাতায়াতের যাবতীয় সুবিধাসহ এত কম কেউ রাখে আজব তো। একটু খটকা লাগলেও বাসা চেঞ্জের সময় অনন্যা আর শুভ্র এমনই তাড়াহুড়ায় ছিল যে এত চিন্তা মাথায়ই আনে নাই। শুভ্রর এক জুনিয়র বাসাটা ঠিক করে দেন। জীবনের প্রথম অনন্যা আর শুভ্র দম্পতি ভাড়াটিয়া হতে চললো কেননা তাদের আগের বাসা ডেভেলপারকে দিয়ে আবার নতুন করে করা হচ্ছে।
বাড়িওয়ালা আঙ্কেল আন্টি দোতলায় থাকেন। খুবই ভদ্র অমায়িক, এমনকি তাদের ছেলেমেয়ে নাতি নাতনীদেরও শুভ্র আর অনন্যার ছেলে মেয়ে শুভেচ্ছা আর অভ্রর সাথে ভালোই খাতির হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু বাসাটা জানি কেমন !!!!! ওদের ফ্লোরে আর কেউ নাই। অথচ অন্য ফ্লোরে ঠিকই দুই ফ্ল্যাটে মানুষজন থাকে। আচ্ছা যাই হোক মানুষ যত কম ঝামেলাও তত কম। কিন্তু আশেপাশের সবাই ওদের এত দেখলেই খোঁজ খবর নেয় কেনো কেমন যাচ্ছে নতুন বাসায় ??? কোনো সমস্যা কিনা ???!!! কেমন খুঁটায় খুঁটায় জিজ্ঞাসা করে আজব ব্যাপার। কি জানি এক সমস্যায় ঐ ফ্লোরের আরেক ফ্ল্যাটেও কেউ থাকতে পারে না।
এক বছর হতে চলল। না চাইলেও বেশ কিছু জিনিস ওরা চারজনই খুব ফিল করে। কিছু একটা ব্যাপার তো আছেই। এই যেমন এই নিয়ে দুইটা বুয়া চেঞ্জ করে এখন তিন নম্বরটা চলছে। কেনো ??? আসলে এরিয়া চেঞ্জ হলে এক এরিয়ার বুয়া আরেক এরিয়ায় কাজ করতে চায় না তাই আগের বাসার বুয়া রাখতে পারে নাই। এখানে একটা বুয়া পেলো। মেয়ে শুভেচ্ছার বয়স আট বছর। এমনিতে খুবই লক্ষী ভদ্র। এই তো সেদিন ডিম ভাজি খাবার জন্য খুব বায়না ধরছিল, আশেপাশে কেউ নাই, বুয়া রাগ হয়ে ওকে গরম ইস্তিরির সেক দিবে ভয় দেখায়। মেয়ের চোখের সামনেই কে জানি বুয়ার চুলের মুঠি ধরে বুয়াকে মাটির উপর ভাসায় রাখে। বুয়া তো ভয়ে আর কাজই করবে না। মেয়েও যেই ভয়টা পেলো।
দ্বিতীয় বুয়া অনন্যার অগোচরে ব্যাগের চেন খুলে সব টাকা সরায় ফেলে। আরে চুরি করবি ভালো কথা কর, ব্যাগে অন্তত একশটা টাকা রাখ, একটা মেয়ে মানুষ রাস্তায় বের হয়ে ব্যাগ পুরা টাকা শূন্য পেলে এই রিক্সাওয়ালা বাস ওয়ালার কেমন বাজে ব্যবহারটা পাবে চিন্তা করেছিস হ্যা ???!!!! ওমা হাওয়া থেকে কে এসে বুয়াকে লাগাতার চড় মারতেই থাকে তো মারতেই থাকে। এভাবে কি বুয়া টিকবে ???!!!
এরপর একদিন বাপ ছেলে ছিল বাসায় একলা। শুভ্র তো ফোনে ব্যস্ত। অভ্রর বয়স সাড়ে চার বছর। ফ্লোরে বসে বসে রেসিং কার নিয়ে খেলছিল। ঐযে বাসা চেঞ্জের সময় শোকেসের গ্লাসটা মেবি লুজ হয়, কেউ দেখেও নাই ঠিক করা হয় নাই। শোকেজ থেকে গ্লাসটা খুলে একদম অভ্রর মাথা বরাবর ঝুলে আছে। যেন কেউ ধরে আছে। যেন কেউ ওকে খেলতে দিচ্ছে। থাক ও খেলুক বিরক্ত না করি। ফোনে কথা বলতে বলতে শুভ্রর চোখ গেলো ছেলের দিকে। হতভম্ব শুভ্র দৌঁড়ায় গিয়ে যেই না ছেলেকে সরালো গ্লাসটা ধাম করে পড়ে একদম চুরমার হয়ে ভেঙে গেলো। যেন ওরই অপেক্ষায় ছিল কখন সে ছেলেকে সরায়।
এই মাসের ভাড়া দিতে গিয়ে স্বামী স্ত্রী দুইজনই বাড়িওয়ালা আঙ্কেলকে ধরলেন। আশেপাশেও খোঁজ নিয়েছে তারা। আর লুকানোর কিচ্ছু নাই। দুই বছর আগে এই বাসায় এক লোক সুইসাইড করে। তারপর থেকে যেই এই বাসায় থাকতে এসেছে অশরীরী উপস্থিতি টের পেয়েছে। গত দুই বছরে যত ভাড়াটিয়া ছিল, সবসময় নাকি তাদের ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে ঝগড়া লেগেই থাকতো কেননা সুইসাইড করা সেই লোকটাও পারিবারিক জীবনে ভীষণ অশান্তির মধ্যেই ছিল। সব খোঁজ খবর স্বামী স্ত্রী নিয়েই এইবার আসে। দেখি এইবার আঙ্কেল কি বলেন।
বাড়িওয়ালা স্বীকার করলেন, তাদের শোনা সব কথাই ঠিক। এসব কারণেই তিনি ভাড়া অনেক কম নেন। কিন্তু গত দুই বছরে কোনো ভাড়াটিয়া তিনমাসের বেশি টিকতে পারে নাই। আচ্ছা দাঁড়াও তোমাদের ভদ্রলোকের ছবি আর এনআইডি কার্ডের কপিটা দেখাই। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল বললেন, এই হচ্ছেন আমার সেই ভাড়াটিয়া ভদ্রলোক ইহান। উনি তখন ভাড়া দিতেন চল্লিশ হাজার টাকা। আর তোমরা দাও মাত্র আঠারো হাজার। ভালোই ইনকাম ছিল ভদ্রলোকের। খুবই ভদ্র ভাড়াটিয়া ছিলেন। মাসের শুরুতেই ভাড়া পরিশোধ করতেন। কেনো জানি বউয়ের সাথে একদম বনিবনা হতো না। প্রায়ই ঝগড়া চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পেতাম। বাচ্চাকে স্কুলে নেওয়ার নাম করে মহিলা বাচ্চাসহ আরেকজনের কাছে চলে যায়। লোকটা লজ্জায় অপমানে নিজের জীবন নিয়ে নেয়। ডেড বডি রিসিভ করতে পর্যন্ত স্ত্রী আসে নাই। মা ভাই এসেছিল।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না অনন্যা। এত বছর পর আবার এভাবে ইহানকে দেখবে এটা সে কল্পনাতেও ভাবে নাই। ইহান !!!!! অনন্যার জীবনের প্রথম প্রেমিক। ওর প্রাক্তন। যার ভালোবাসা রিজিকে থাকলেও একসাথে সংসার করাটা রিজিকে ছিল না।
তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তো অনন্যা। কালচারাল প্রোগ্রামে সিনিয়র মিরাজের কাজিন ইহানের সাথে ওর পরিচয় হয়। ইহান খুব ভালো গান গায়। প্রোগ্রামে মিরাজ তাই তার কাজিন ইহানকে নিয়ে আসে। আসলে মিরাজ ছিল ওদের ইউনিভার্সিটির জাতীয় ক্রাশ তাই ওর বান্ধবী তমা সন্দেহ করতো এসব ইহানের সাথে প্রেম টেম অনন্যার টাইম পাস মাত্র, নিশ্চয় ওর আসল টার্গেট মিরাজ, এভাবে আস্তে আস্তে বান্ধবী তমার সাথেও অনন্যার দূরত্ব তৈরি হয়। ভালোই যাচ্ছিল অনন্যা আর ইহানের সম্পর্ক কিন্তু আস্তে আস্তে অনন্যা টের পেল ইহান আরো অন্যমেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়িত। অনন্যার মাস্টার্স শেষ করতে করতে ইহানও তখন অনেক ভালো চাকরি করে ভালো রোজগার করে কিন্তু সে অনন্যাকে বিয়ে করতে পুরোপুরি অস্বীকৃতি জানায়। তার কথা সে নাকি জীবনেও অনন্যাকে বিয়ে করতে প্রতিশ্রুতি দেয় নাই। আর মাস্টার্স পাশ অনন্যা তো বেকার। আজকাল কোনো মেয়ে বেকার থাকে নাকি ???!!! কি এমন চাকরির পরীক্ষা দেয় যে সবার হয় ওরই হয় না ???!!! বউ এমন হতে হবে যে তার নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারবে।
অবাক কান্ড কি, চাকরি অনন্যারও হয়, অনেক পরে, ইহানের বিয়ের পরে। ফেসবুকে অনন্যা দেখলো ইহান বেছে বেছে নিজের গ্রামের মেয়েকেই বিয়ে করেছিল, সেই মেয়ে আবার স্টুডেন্ট, কই ওর স্ত্রী তো রোজগার করে না তাহলে ???!!! অনন্যার চাকরিও হলো, নিজের খরচ নিজের চালানোর যোগ্যতাও হলো, শুধু যার জন্য এতকিছু সেই ইহানকে পাওয়া আর হলো না। দুনিয়ার নিয়ম একমাত্র ওর জন্যই প্রযোজ্য। যেই ইহান প্রেম করতে ভয় পেতো না অথচ বিয়ে করতে দায়িত্ব নিতে ভয় পেতো, একসময় সে সন্তানের বাবাও হয়ে গেলো। অনন্যা ইউনিভার্সিটির রিউনিওন পার্টিতে পর্যন্ত যাওয়া বন্ধ করে দিলো কেননা ঐখানে যদি কালচারাল প্রোগ্রামে ইহান গান গাইতে আসে বউ বাচ্চা নিয়ে তখন সেই মিরাজ তমারা না আবার ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে।
কয়েকবছর পর অনন্যার বিয়ে হয় শুভ্রর সাথে। ওদের কোল আলো করে মেয়ে শুভেচ্ছা আর ছেলে অভ্র আসে। আসলে জীবনে শুভ্র আসার পর ঐভাবে ইহানের কথা ওর মনেও আসে নাই, এই অফিস, ছেলেমেয়ের স্কুল, সংসার, বাসা পাল্টানো সব মিলায় ও সেই অতীত কবেই ভুলেই গিয়েছিল।
বাসায় এসে অনন্যার ভয়ংকর রকম খারাপ লাগছে। কিছু কিছু খারাপ লাগা আছে পাশে থাকা জীবনসঙ্গীকেও বলা যায় না। শুভ্র তো জানে না সে উল্টা আরো বউকে আশ্বাস দিচ্ছে দেখো কি সুন্দর উপকারী ভূত পেলাম, আমাদের ছেলেমেয়েকে কি সুন্দর দেখে রাখছে ইহান সাহেব নামের ভূতটা। আজকাল তো এরকম উপকারী মানুষই পাওয়া যায় না ভাবা যায় !!!!
দেড় বছর পর আবারো তারা বাসা বদল করছে। এবার বাসা নিচ্ছে অনন্যার অফিসের কাছাকাছি। এসব কথা কি আর গোপন থাকে। শুভ্রর মা বাবা এই বাসার প্রাক্তন ভাড়াটিয়ার কথা জেনে গেছেন, কোনোভাবে এত ছোট ছোট নাতি নাতনিসহ ছেলে আর বউকে এই বাসায় রাখবেন না। তাদের জোরাজোরিতে আবারো বাসা বদল। বাসা পাল্টানো আরেক ঝামেলা। দুইদিন তো শুভ্র অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসছিল। আজকে ছেলেমেয়ের স্কুল, অনন্যা একলাই কাজ গুছায় রাখছে। ড্রেসিং টেবিলটা গুছাচ্ছিল, নিচে ডেট এক্সপায়ার হওয়া লিপস্টিক পড়ে আছে। আয়নায় সুন্দর করে লেখা উঠলো,
“অনু, এখনো রাগ আমার উপর ???”
ইহান আদর করে মাঝে মাঝে তাকে অনু ডাকতো।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প