বন্দী শেষপর্ব

আমি আসলে মেয়েটাই শহুরে। সারাজীবন শহরে বড় হয়েছি। শহরের এই ইট কাঠের বাড়ি দেখেছি, মুড়ির টিন দেখেছি, রিক্সার টুংটাং শুনেছি। গ্রামের দিকে যাওয়া হয় নাই কখনো। কখনো যাবোও না ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনটা যেমন কাটছে, তেমনি কেটে যাবে। শহরের বাইরে কোনোদিন পা পড়বে না আমার।
অথচ আমার শ্বশুরবাড়িটা গ্রামে পড়ে গেলো। কেমনে পড়লো, বলছি। মুড়ির টিনে জগন্নাথ থেকে মিরপুর আসা যাওয়া করি। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম, একটা ছেলে রোজ আমাকে দেখে। মানে আমার সাথে সেও জগন্নাথ থেকে মিরপুর যাওয়া আসা করে। ব্যাপারটা পাত্তা দেইনি, বা পাত্তা দিতে চাইনি। এই নব্বইয়ের দশকে দাঁড়িয়েও দুনিয়া বড়ই রক্ষণশীল। ছেলে মেয়ের কথা বলাটা গর্হিত কাজ। কোনোভাবে যদি বাসায় জানতে পারে, একটা অপরিচিত ছেলের সাথে বাসে কথাবার্তা বলেছি, পিটিয়ে আলুর ভর্তা বানিয়ে দেবে।
এর মধ্যেই বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব এলো। বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হলো সরাসরি আমার বড় ভাইয়ের কাছে। বড় ভাই ভীষণ রাগী মানুষ, তাকে যে নিজে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তার বুকের পাটা একদম মহাকাশের মতো বড়। বান্দাটাকে একবার দেখতে ইচ্ছা হলো। দেখি আমার সেই বাসের অনুসরণকারী।
ছেলেটাকে দেখতে কেমন জানি গোবেচারা লাগে। দেখলাম এ একদমই গোবেচারা না।‌ঠিকই বড় ভাইকে পটিয়ে ফেলেছে। আর বড় ভাইয়ের কথাই আমাদের পরিবারে শেষ কথা। তাই আমার বিয়েটা হয়ে গেলো। যেই গোবেচারা চেহারার চালাক ছেলেটার সাথে আমার বিয়ে হলো, তার নাম বাহার। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি।
ঝালকাঠি মানে দক্ষিণ বঙ্গের একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে হবে, দুই বছর আগেও যদি কেউ আমাকে বলতো, আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। অথচ আমার বিয়ে হলো সেখানেই। বিয়ের পর আমাদের সংসার শুরু হলো একটা বাড়িতে। মিরপুরের এক দোতলা বাড়ির দোতলায়, ছোট্ট ঘুপচি ঘরে। সংসারটা নিজের, বাবার একান্নবর্তী পরিবার থেকে এই একা নিজের সংসারে এসে পড়েছি। সত্যি বলতে, আমার খারাপ লাগছিলো না।
আমার প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাওয়া পড়ে বিয়ের দুমাস পর।‌সেসময়টায় কোরবানির ঈদ। বাহার বললো সেবার গ্রামে ঈদ করবে। তাই গ্রামে যাওয়া। বাবা মা পরিবারকে ছেড়ে এর আগে একটা ঈদও করিনি। কেমন যেন খারাপ লাগছিলো। তাও বাহারদের গ্রামের বাড়ি দেখতে পারবো, প্রথম একটা গ্রামে থাকতে পারবো, নতুন একটা অভিজ্ঞতা, এসব চিন্তায় মন খারাপ ব্যাপারটা উবে গেলো সাথে সাথেই।
লঞ্চে চেপে আমরা গ্রামে গিয়েছিলাম, আমার প্রথম লঞ্চ জার্নি। সেই অভিজ্ঞতা বলার ভাষা আর আমার নেই। আমার জীবনের যতোগুলো আনন্দের স্মৃতি আছে, তার মধ্যে একটা হলো লঞ্চে বসে নদীর ওপর পূর্ণিমা চাঁদ দেখা আর সকালে সূর্যোদয় দেখা। এই দুটো দৃশ্য আমি কখনো ভুলবো না।
বাহারদের গ্রামে আমি পৌঁছেছিলাম বিকেলে। পৌঁছাতেই একটা হুলস্থুল পড়ে গেলো। গ্রামে একটা শহুরে বউ এসেছে, এ যেন অন্যরকম এক উৎসবের ব্যাপার।আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম, সবার আলোচনার মধ্যমণি হয়ে গেছি। লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। শেষমেষ আমার ননদ আমাকে বাঁচালো। টান দিয়ে আমাকে নিয়ে চলে গেলো ভেতরের ঘরে।
রাতে দেখলাম আমাদের খাওয়া দাওয়ার জন্য বিরাট আয়োজন। গরুর গোশত, হাঁসের গোশত, বাড়ির বড় রাঁওয়া (এর মানে হলো মোরগ, আমি পরে বাহারের কাছ থেকে শুনেছিলাম)- এর তরকারি, শাকভাজি, ডালভাজি, এতো এতো ভর্তাভাজি, আর মাছ। কয়েক প্রকারের মাছ। বিভিন্ন সাইজের মাছ তরকারির ভেতর যেন কিলবিল করছে। আমি খুবই বিব্রত হয়ে গিয়েছিলাম। কথাটা কিভাবে বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। শেষে মা মানে আমার শাশুড়ির কানে ফিসফিস করে বললাম, ‘মা, আমি মাছ খাই না।’
মা শুনে যেন আকাশ থেকে নিচে পড়ে গেলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি বললে?’
‘মাছ খেতে পারি না। আমার গন্ধ লাগে। বমি আসে।’
মা শুনে থম মেরে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হা হা করে বিকট হাসি তুলে বললেন, ‘এ কি শুনি গো। নতুন বউ তো মাছ খায় না।’
বাড়ির সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। লজ্জায়, অপমানে আমার মনে হচ্ছিলো মাটির ভেতর সেঁধিয়ে যাই। কোনোরকমে মাথা নিচু করে মুখটা লুকোচ্ছিলাম। অবাক হওয়া মানুষগুলোর পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে প্রতিক্রিয়া এলো দ্রুত। এতো এতো মানুষের বিদ্রুপ মাখা হা হা হাসি সাইক্লোনের মতো আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার করে দিলো। আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো। অনেক কষ্টে কান্না আটকালাম। সেই রাতে আমি আর কোনো কিছু খেতে পারিনি।
শোবার ঘরে ঢুকে বাহারকে বললাম, ‘তুমি তো জানো আমি মাছ খেতে পারি না। তবু মাকে বলোনি কেন?’
‘ভুলে গেছিলাম।’ বলেই বাহার অন্যপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। আমার ঘুম আসছিলো না। সন্ধ্যাবেলার তাচ্ছিল্যের হাসিটা মনের ভেতর জ্বলছিলো দগদগে ঘায়ের মতো।
পরদিনটা কাটলো স্বাভাবিক ভাবেই। স্বাভাবিকভাবে বলতে, গ্রামের সবার সাথে পরিচিত হওয়া, এর ওর বাড়ি যাওয়া, দাদি নানিদের কাছ থেকে বকশিশ পাওয়া, এসব। এইসব স্মৃতি আমার কাছে আনন্দের স্মৃতি হয়ে থাকতো। কিন্তু থাকলো না। আমার মাছ না খেতে পারার ব্যর্থতা আমার জন্য কাল হয়ে গেলো। যার বাসাতেই গেলাম, সেই প্রচন্ড আনন্দ আর বিস্ময় নিয়ে বলতে লাগলো, ‘তুমি নাকি মাছ খাও না।’ মাছ না খাওয়াটা যেন প্রচন্ড বিস্ময়ের এক ব্যাপার। মানুষ মাত্রই মাছ খাবে। যে মাছ খেতে পারে না, সে ভীনগ্রহের কোনো জীব। সে কোনোভাবেই মানুষ হতে পারে না।
মাছ খেতে না পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি খোঁটা দিয়েছিলেন আমার শাশুড়িমা। ‘বউরে কতোকিছু খাওয়াবো ভাবছিলাম, এখন দেখি সে মাছই খাইতে পায় না’- কথাটা তিনি জনে জনে বলে বেড়াচ্ছিলেন। আমার সামনেই বলেছিলেন পঞ্চাশবার। আমার পিছনে কতোবার বলেছিলেন, আমি জানি না।
আমার প্রচন্ড জেদ চেপে গিয়েছিলো। ছোটবেলা থেকেই আমি অনেক জেদি। জেদের মাথায় বাড়ির কতো জিনিস যে ভেঙে ফেলেছি, তার হিসাব নাই। আমার বাবা মা ভাই সবাই আমাকে মানা করতেন। বলতেন, ‘এতো জেদ ভালো না।’ তবুও আমি জেদ কমাতে পারতাম না। এই বেশি জেদ থাকার ব্যাপারটা হয়তো মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। আমি হয়তো মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলাম। কে জানে। তখন তো আমাদের কথায় কথায় সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নেয়া হতো না। কেউ বদ্ধ উন্মাদ হলেই কেবল তার চিকিৎসা চলতো।
আমার তখন জেদ চেপে গেছিলো। আমি ঠিক করেছিলাম, মাছ খাবই এবং ঐ গ্রামে থেকেই মাছ খেয়ে যাবো। এতো মাছ খাবো যে আমাকে মাছ খাওয়াতে খাওয়াতে শ্বশুড়বাড়ির লোক ফতুর হয়ে যাবে। আমাকে নিয়ে আর টিটকারি দেবার সাহসই পাবে না তারা।
প্রথমে দুপুরে লুকিয়ে লুকিয়ে তরকারির বাটি থেকে একটা মাছ তুলে নিয়েছিলাম রান্নাঘরে। কেউ ছিলো না, কেউ টের পায়নি। নাক চেপে মাছের টুকরোয় একটা কামড় বসিয়েছিলাম। দু তিনবার কামড়ে গিলে ফেলেছিলাম মাছটা। মাছের স্বাদ নেবার সুযোগও হয়নি। গিলে ফেলার সাথে সাথে দু তিন সেকেন্ড কিছুই হলো না। মনে হলো, ভালোই তো, মাছ তো খেতে পারি। এরপরই আমার শরীরের ভেতর থেকে যেন মাছের একটা ভীষণ আঁশটে কুৎসিত গন্ধ এসে ধাক্কা মারলো আমার নাকে। আমি আর থাকতে পারলাম না। ছুটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে হরহর করে বমি করে দিলাম। এরপর এসে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো, খুব। আমার কষ্ট ভাগাভাগি করার জন্য কাউকে খুঁজছিলাম। কেউ আমার পাশে ছিলো না, কেউ না, বাহারও না। আমি কেবল নিজেই নিজের ভেতর গোমরাচ্ছিলাম।
বিকেলে ননদের সাথে ঘুরতে বের হলাম। ও আর আমি গিয়ে বসলাম পুকুরপাড়ে। বিকেলে সূর্যের রোদ পুকুরের গাছপালার ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছিলো পুকুরের পানিতে। সেই মায়াময় পরিবেশে সে আমাকে একটা গল্প শুনিয়েছিলো। মেছোভূতের গল্প।
ও বলছিলো, ‘জানো ভাবি, তোমার মতো মাছ খেতে না পারলে আমি বেঁচে যেতাম। মাছ খেতে এত্তো ভালো লাগে আমার, ছাড়তে পারি না।’
‘ বেঁচে যেতে কেন?’
‘তাইলে আর মেছোভূত পিছে পড়তো না। এই গ্রামে একটা মেছোভূত আছে। কেউ মাছ নিয়ে কোথাও গেলে বা মাছ খেতে বসলে সে তার পিছু নেয়।’
‘কি বলো?’
‘হ্যাঁ সত্যি। অনেকেই না ওটাকে দেখেছে। আমার দাদাও দেখেছেন।’
‘কি দেখেছেন?’
‘এইটা অনেকদিন আগের কথা। আমরা তখন ছোট। সেইসময় বান এলে আমাদের যে ধানক্ষেতগুলা আছে না, ঐগুলা নদীর পানিতে তলিয়ে যেত। আর নদীর মাছ এসে উঠতো ক্ষেতে। গ্রামের মানুষ তখন সারারাত ঐ মাছ ধরে বেড়াতো। দাদাও যেত। একরাতে সে এরকম মাছ ধরছে। তার সাথে আর যারা ছিলো, তারা চলে গেছে। দাদা আরো কয়েকটা মাছ ধরার আশায় বসে ছিলেন। রাত তখন গভীর, দাদা মাছ ধরা শেষ করে বাড়ির দিকে আসছেন। হঠাৎ তার মনে হলো, তার পিছনে হাঁটার শব্দ পাচ্ছেন। দাদা পেছনে ফিরে দেখলেন, তার পেছনে পঞ্চাশ হাতের মধ্যে কোনো লোকজন নাই। দাদা আবার হাঁটা শুরু করেছেন, আবার পায়ের আওয়াজ। দাদা এবার ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকালেন। তাকিয়ে দেখলেন, একটা বড় মানুষ তার দিকে দৌড়িয়ে আসছে, তার মুখ চাদরে ঢাকা। দাদা বুঝেই দৌড়াতে শুরু করলেন। দাদা কিন্তু দৌড়ে আমাদের উপজেলায় ফার্স্ট ছিলেন সবসময়, অথচ সেদিন ঐ লোকটা দাদার একদম কাছে চলে আসছিলো, প্রায় কানের কাছে এসে বলতে লাগলো ‘মাছ দে, মাছ দে।’ দাদা কোনোরকম দোয়া দরুদ পড়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছালেন, পৌঁছায়েই অজ্ঞান। দাদার জ্ঞান ফিরেছিলো তিনদিন পর। এই তিনদিন নাকি দাদা স্বপ্নে দেখতো, একজন তার সামনে বসে কাঁচা মাছ দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।’
আমার কেমন বমি পেলো গল্পটা শুনে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটুকুই শেষ?’
‘না। আরো আছে। দাদা যখন অসুস্থ, তখন দাদি একবার মাছ ভাজতে বসছিলেন রাতের বেলায়। হঠাৎ তিনি দেখেন বেড়ার ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদি ভয়ে চিৎকার দেয়ার আগেই দুটো হাত ঝট করে বেড়া ভেঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকে মাছ দুটো নিয়ে বের হয়ে যায়।’
গল্পগুলো শুনে আমার ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও আমি ভয় পেলাম না। আমার মায়া লাগলো মেছোভূতের জন্য। আহারে, তাদের কি পরিমান আকর্ষণ মাছের জন্য। এর দশ ভাগের একভাগ থাকলেও আজ এতো গঞ্জনা সইতে হতো না আমাকে।
রাতে আমাকে খুব খারাপভাবে অপমানিত হতে হলো।
আমার শাশুড়ির বোন এসেছিলো আমাকে দেখতে, মনে হয় পাশের গ্রামেই থাকেন। ছেলেদের খাওয়ার পর মেয়েরা সবাই খেতে বসেছি একসাথে। আমি বসেছি আমার খালা শাশুড়ির পাশেই। আমার শাশুড়ি হঠাৎ আমার পাতে একটা বড় মাছ তুলে দিলেন। মাছের নাম জানি না। ড্যাবড্যাবে চোখজোড়া আমার দিকে চেয়ে আছে‌। আর আছে আঁশটে গন্ধ। গন্ধে আমার পেল বমি। বমি আটকাতে পারলাম না। মুখটা কোনোরকমে ফিরিয়ে হরহর করে বমি করে ফেললাম।
খালা শাশুড়ি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ‘তোমাগো বিয়ের না মাত্র দুই মাস হইলো, এতো তাড়াতাড়ি…’
মা বলে উঠলেন, ‘আরে সেটা না আপা, ও মাছ খাইতে পারে না। ভুলে পাতে দিয়ে দিছি মা, মনে কিছু কইরো না।’ বলেই ফিক করে হেসে দিলেন, যেন হাসিটা অনেকক্ষণ চেপে ছিলেন।
খালা শুনে প্রথমে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলেন আমার দিকে মাছের মতো, পরে আছাড়ি বিছাড়ি করে আর্তনাদ করার মতো বলে চললেন, ‘ওরে মা লো মা, এ কি শুনি, কতো কিছু দেখতে হইবো জীবনে। মাছ দেইখা মাইনষে বমি করে কোনোদিন হুনছি বাপের জন্মে।’
এরপর দুই বোনের সে কি হাসি। হাসতে হাসতে দুজন খাবার প্লেটের সামনেই মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। আমি উঠে চলে আসলাম আমার ঘরে। দেখি বাহার শুয়ে ঘুম দিয়েছে। আমি বাহারকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বললাম, ‘চলো বাহার চলো, আমি কালকেই বাড়ি চলে যাবো। আর একটুও এই বাড়িতে থাকবো না।’
বাহার কোনোরকমে চোখ মেলে বললো, ‘খুব ক্লান্ত লাগছে গো, প্লিজ কালকে পর্যন্ত সময় দাও, কালকে ঘুম থেকে উঠে সব ঠিক করে দিবো।’ বলেই আবার দিলো ঘুম। আমার তখন যে কি ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো, আমি ঝরঝর করে কান্না করা শুরু করে দিলাম। আমার সেই কান্না মোছার জন্য কেউ ছিলো না।
রাত যখন নিঝুম, বাড়ির পাশের গাছের ওপর বাসা বাঁধা পাখিটাও যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি তখনও জেগে। আমার মনটা খুব জ্বলছিলো, অপমানে আর কষ্টে। আমি চুপচাপ বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম নিচে। উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। রান্নাঘরে মিটশেফের ওপর রাখা গামলায় আছে মাছের তরকারি। রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় ঘরটার ভেতরে অন্ধকার কিছুটা কেটেছে। আমি আস্তে আস্তে মিটশেফের দিকে এগিয়ে যাই। গামলাটা হাতে নেই‌। গামলার ভেতর মাছ। শত শত মাছ। কিলবিল করছে যেন। ড্যাবড্যাবে চোখ মেলে আমাকে দেখছে‌। তাদের গা থেকে আসা আঁশটে গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে গেছে। আমি একটা মাছ হাতে তুলে নেই। মুখের কাছে নিয়ে আসি। আস্তে আস্তে কামড় বসাতে যাই। মাছের গন্ধ, তার আঁশটে গন্ধ, তার নরম আঁশ-আঁশমাখা শরীর আমার মুখে বমি নিয়ে আসলেও আমি মাছটায় কামড় বসাতে যাই।
আর তখনই, ঘরটা অন্ধকার হয়ে যায়।
বেড়ার ফাঁক দিয়ে যে চাঁদের আলো আসছিলো, সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ মেলে তাকাই। সেই ফাঁকে এক জোড়া চোখ। ভয়ংকর লাল চোখ। চোখদুটো একদৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
আমার হাত থেকে মাছটা পড়ে যায়।
একটা ভীষণ কুৎসিত হাত বেড়া ভেঙ্গে মাছের দিকে আসতে থাকে। কে যেন ভীষণ কুৎসিত কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘আমাকে মাছ দিবি? আমাকে মাছ দিবি?’ হাতটা মাছের কাছে এসে থেমে যায়। কিছুক্ষণ স্থির থাকে হাতটা। তারপর, হঠাৎই, কোনো কিছু বোঝার আগেই, সেটা আমার হাতের দিকে ধেয়ে আসে। আমার হাতে মাছ ধরা ছিলো। মাছের আঁশটে গন্ধে আমার হাত ভরা। কুৎসিত হাতটা আমার হাত চেপে ধরে। ভেজা, ঠান্ডা, কুৎসিত, আঁশযুক্ত একটা হাত। আমি চিৎকার করে উঠি। আমার আর কিছু মনে নাই।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করি বিছানায়। আমার পাশে বাহার ঘুমোচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারলাম না আমি কোথায় আছি। আস্তে আস্তে গত রাতের কথা মনে পড়লো। গত রাতে রান্নাঘরে ছিলাম। এখানে কিভাবে এলাম বুঝতে পারছি না। হঠাৎই একটা গন্ধ নাকে আসলো। আঁশটে মাছের গন্ধ। গন্ধে পুরো ঘরটা ভরে আছে। আমি সোজা উঠে বসলাম। আমার হাতটা ভেজা। হাতে মাছের গন্ধ। কাঁচা মাছ।
আমার মুখটা ভেজা। মুখে হাত দিলাম। ঠোঁটে কি যেন লেগে আছে। আঁশটে। হাতটা চোখের সামনে ধরলাম। রক্ত। কালচে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। আঁশটে। মাছের গন্ধের মতো।
আমি হরহর করে বমি করে দিলাম। ঘরের বাইরে ছুটে গেলাম। পুকুরে নেমে ডুব দিয়ে আসলাম। কেউ দেখলো না।
পরের দুটো দিন আমার কেমন ঘোরের মধ্যে কাটলো। কিন্তু ঘোরের মধ্যে যে কাটছে, আমি বাদে আর কেউ বুঝতে পারেনি। সবার সাথেই উঠছি, বসছি, খাচ্ছি, গল্প করছি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন। স্বপ্নে যেমন সব স্মৃতি ভাসাভাসা থাকা, তেমন ভাসাভাসা। সেই দুইদিনের স্মৃতি আমার মনে স্বপ্নের মতোই আছে। কি হয়েছিলো দুদিন, ভালো মনেও নাই।
শুধু মনে আছে, একটা গল্প শুনেছিলাম সবার কাছে। গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। মেছোভূতকে নাকি দেখা গেছে গ্রামে। যেদিন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম, সেদিন রাতে বান ডেকেছিলো। অনেকেই গিয়েছিলো রাতে মাছ ধরতে। যারা মাছ ধরে বাড়ি ফিরছিলো, তাদের মধ্যে অনেকেরই নাকি পিছু নিয়েছিলো মেছোভূত। গাছের আড়ালে থেকে হি হি করে হাসতে হাসতে বলেছিলো, ‘মাছ কই নিয়া যাস। মাছ দে।’ অনেকেই নাকি দেখেছিলো মেছোভূতকে। তবে কারো বর্ণনাই একজনের সাথে আরেকজনটারটা মিলে নাই। শুধু একজন বলেছিলো, মেছোভূতটা দেখতে ছিলো মেয়ের মতো। তার মুখটা ছিলো খোলাচুলে ঢাকা। মুখটা সে দেখতে পায়নি। তবে মেয়েটা মুখ নামিয়ে একটা কাঁচা মাছ চিবাচ্ছিলো কচকচ করে। সেটা দেখে ভয়ে সে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলো আমার শাশুড়ি মা। রাতে তিনি উঠেছিলেন বাথরুমে যাবার জন্য। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলেন, তখন তিনি শুনতে পান কড়মড় করে কিছু চাবানোর আওয়াজ। প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো বেড়াল, রান্নাঘরে ঢুকে মাছ খাচ্ছে। বেড়াল তাড়ানোর জন্য যখনই রান্নাঘরে ঢুকতে যাবেন, তখনই শোনেন, কে যেন ভয়ংকর গলায় বলছে, ‘কিরে, মাছ খাবি না? আয়, মাছের সাথে তোর মাথাটাও চিবিয়ে খেয়ে ফেলি।’
মা ভয়ে পড়ি কি মরি করে বাসায় দৌড়ে গেলেন। আর এক মূহুর্তও বাসা থেকে বেড়োলেন না, সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত। সারারাত বাথরুম চেপেই বিছানায় শুয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। সকালে রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন, মাছের গামলা উল্টে সব মাছ নিচে পড়ে আছে‌। কিছু কিছু মাছ আধখাওয়া। তিনি বুঝতে পারলেন, মেছোভূত রাতে তার রান্নাঘরে ঢুকেছিলো। এগুলো মেছোভূতেরই কাজ। আমরা যে কয়দিন বাড়ি ছিলাম, তাকে আর মাছ রান্না করতে দেখিনি। ভয়ে সেই কয়দিন তিনি মাছের ধারেকাছেও যাননি।
কয়েকদিন পর আমরা ঢাকায় চলে আসি। আছ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথা, এখনও অনেক কিছুই আমার মনে আছে। এই ত্রিশ বছর পার করার পরও এখনও আমি মাছ খেতে পারি না। আমার মেয়েরা মাছ খায়, তাদের বাবা মাছ খায়। আমি বাসায় মাছ রান্না হলে শুধু ডিম ভাজি খেয়েই দিন পার করে দেই। মাছ খেতে না পারলেও একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমার সাথে ঘটে। মাছের কথা শুনলেই আমার মনে হয় একটা অদ্ভুত আঁশটে স্বাদের স্মৃতি আমি অনুভব করতে পারি। যেন কোন একসময় আমি মাছ খেয়েছিলাম, কাঁচা মাছ। কিন্তু কবে এমন খেয়েছিলাম মনে করতে পারি না। এছাড়াও মাঝেমাঝে ঘুমালে আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। দেখি গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, রাতের বেলায়। আমার নাকে মাছের গন্ধ লাগলেই পিছু নিচ্ছি সেই গন্ধের। গন্ধের মালিক, মানে মাছওয়ালার কাছাকাছি পৌঁছে গাছের আড়াল থেকে হি হি শব্দে বলছি, ‘এই, মাছ দিবি, মাছ‌।’ সে যখন মাছ ছেড়ে পড়িমড়ি করে দৌড়ে পালায়, তখনই আমি উঠে মাছটা ছোঁ মেরে নিয়ে কাঁচা চিবোতে থাকি। এ সময়টাই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমার গা গোলাতে থাকে। এমন স্বপ্ন যে আমি কেন দেখি, একদমই বুঝতে পারি না।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প