মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আদনান মোরশেদ বিরক্ত চোখে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছেন।
লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ছোটখাটো মানুষ। ডিসেম্বর মাসের তীব্র শীতেও পাতলা একটা পাঞ্জাবী পড়ে আছে। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। সে বসে আছে সোফার এক কোণে, জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে।
ডাঃ আদনান ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘আপনার নাম যেন কি বললেন?’
‘স্যার, শফিক। শফিকুল ইসলাম।‘
‘আপনি আমার ঠিকানা জোগাড় করলেন কিভাবে?’
ভদ্রলোক কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, ‘মোতালেব সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছি, স্যার। উনি আপনার চেম্বারে সিরিয়াল রাখেন।‘
ডাঃ আদনান এবার সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। মোতালেবকে মাঝেমাঝে নানান কাজে তিনি বাসায় পাঠিয়েছেন। সে বাসার ঠিকানা জানে। তাই বলে যাকে তাকে তার বাসার ঠিকানা বলে দেবে? গাধা নাকি? মনে হচ্ছে মোতালেবকে আর বেশিদিন রাখা যাবে না। নতুন লোক খুঁজে পাওয়াও আরেক ঝক্কি। দেশটা গাধা দিয়ে ভর্তি।
বড় মগবাজারে ডাঃ আদনানের চেম্বার। এই দেশে মনোরোগের ডাক্তারদের তেমন পসার হয় না। সবাই শরীর নিয়ে সচেতন, কিন্তু মনোজগত নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মানুষ ভাবে পাগলের ডাক্তার। অবস্থা খুব সিরিয়াস না হলে কেউ তাদের কাছে যায় না। আজকাল যদিও বড়লোকদের কেউ কেউ এই ট্যাবু ভেঙ্গে বের হয়েছেন। ডাঃ আদনানের পসার মোটামুটি মানের। কোনদিনই রোগীর চাপ খুব বেশি থাকে না। শফিকুল ইসলাম লোকটা যে সিরিয়াল না পেয়ে তার বাসা পর্যন্ত চলে এসেছে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই।
আদনান সাহেব লোকটাকে বললেন, ‘আপনি চেম্বারে এলেই পারতেন। বাসায় এলেন কেন?’
লোকটা কিছু বললো না। একবার গলা খাঁকারি দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘আপনাকে কি আমি আগে কোথাও দেখেছি? চেনা চেনা লাগছে।’
লোকটা বলল, ‘গত সপ্তাহে আপনার চেম্বারে গিয়েছিলাম। আমার ছেলেকে নিয়ে।‘
‘আজকে এসেছেন কি ব্যাপারে? কেমন আছে আপনার ছেলে?’
‘আমার ছেলের নাম ফাহিম, স্যার। সে ভালো আছে।‘
‘কি সমস্যা যেন আপনার ছেলের?’
‘সে একা একা কথা বলে। তার কিছু কাল্পনিক বন্ধু-বান্ধব আছে।‘
‘ও আচ্ছা এইবার মনে পড়েছে। ছেলেটা সারাদিন কাজের মানুষের কাছে থাকে তাই না?’
‘জি স্যার। আমার ইন্সুরেন্স কোম্পানির চাকরি। সময় দিতে পারি না। নয়টা-পাঁচটা অফিস।‘
‘আপনার স্ত্রী?’
‘আমার স্ত্রী গত হয়েছেন ফাহিম জন্মের সময়।‘
‘আমি সরি। বলেছিলেন বোধহয়। মনে ছিল না।‘
লোকটা আবার চুপ করে গেল।
ডাঃ আদনান বললেন, ‘আপনার ছেলেকে নিয়ে কোন সমস্যা? ওকে আনলেন না কেন? কালকে আরেকবার আমার চেম্বারে নিয়ে আসুন।‘
শফিক সাহেব এবারে একটু নড়েচড়ে বসলেন। প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বললেন, ‘স্যার সমস্যাটা আমার। সেদিন লজ্জায় বলতে পারিনি।‘
যেকোনো কারণেই হোক ডাঃ আদানানের বিরক্তি কেটে যাচ্ছে। লোকটাকে ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার বলে মনে হচ্ছে। তিনি বাসায় কখনো রোগী দেখেন না। তার স্ত্রী তিন্নি ব্যাপারটা জানতে পারলে খুব রাগ করবে। তবুও মনে হল এই লোকটার জন্য একদিন নিয়মের ব্যাতিক্রম করা যায়। তাছাড়া তিন্নি আর তাদের মেয়ে মোহনা গেছে ধানমণ্ডিতে, তিন্নির বোনের বাসায়। গাড়ি নিয়ে গেছে। দশটার আগে ফেরার কথা না।
শফিক সাহেব একই ভঙ্গিতে বসে আছেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে আজকেও যথেষ্ট লজ্জা পাচ্ছেন। এই লজ্জা ভাঙ্গানো দরকার। ডাঃ আদনান বললেন, ‘কফি খাবেন শফিক সাহেব? ভালো কফি আছে।’
‘স্যার আমি কফি খাই না। তিতা লাগে।‘
‘চা?’
শফিক কিছু বলল না। আদনান সাহেব কাজের মেয়েটাকে ডেকে দুকাপ চা দিয়ে যেতে বললেন।
শফিক চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। মাঝেমাঝে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
ডাঃ আদনান চশমা খুলে পাশের টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, ‘দেখুন শফিক সাহেব, আমাদের শরীর যেমন মাঝেমাঝে অসুস্থ হয়, আমাদের মনও তেমনি মাঝেমাঝে অসুস্থ হতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে আমরা লজ্জা পাই না। মানসিক অসুস্থতা নিয়ে পাই। আপনার লজ্জা পাবার কোন কারণ নেই। আপনি আপনার সমস্যা খুলে বলুন। আমি যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করবো।‘
শফিক সাহেব বললেন, ‘কোন কোন শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও আমরা লজ্জা পাই, স্যার।‘
অকাট্য যুক্তি। তবে লোকটার লজ্জা অনেকটা কেটে গেছে বলে মনে হল।
তিনি চায়ের কাপ রেখে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, ‘আমার ছেলে ফাহিম ছোটবেলা থেকেই কিছুটা অন্যরকম। জন্মের সময় ছেলেটার মা মারা গেল। সৎ মায়ের ঘরে ছেলে আমার কষ্ট পাবে ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। মা ব্যাপারটা কি আমার ছেলে জানে না। কিন্তু আজব কথা হল, ব্যাপারটা নিয়ে ওর মধ্যে কোন কৌতূহল বা দুঃখ কোনটাই নেই। সে সারাদিন নিজের মনে খেলে। স্কুলে তার অল্প কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে। তার বন্ধুদের মায়েরা তাদেরকে স্কুলে দিয়ে আসে। কিন্তু আমার ছেলে কোনদিন আমাকে জিজ্ঞেস করে নি, বাবা, আমার মা কোথায়?’
‘আপনি কখনো তাকে তার মা’র কথা বলেন না?’
‘বলি। মাঝেসাঝেই বলি। সে আগ্রহ দেখায় না।‘
‘আপনার বাসায় আপনার স্ত্রীর কোন ছবি নেই?’
‘আছে, স্যার। বেডরুমে বড় বাঁধাই করা ছবি আছে।‘
‘কি যেন নাম বললেন আপনার ছেলের? ফাহিম?’
‘জি স্যার ফাহিম। আগামী বছর ক্লাস থ্রি তে উঠবে।‘
‘ফাহিমের সাথে আপনার সময় কাটানো হয়? মানে ধরুন রাতে ঘুমানোর আগে। বা ছুটির দিনে কোথাও ঘুরতে যাওয়া।’
‘আমি সারাদিন অফিসের কাজে বাইরে বাইরে থাকি, স্যার। বয়স্ক একজন কাজের মানুষ রাখা আছে। কিন্তু তার কাজ কেবলমাত্র দিনের বেলা ফাহিমকে দেখে রাখা। রান্না-বান্না আমি নিজেই করি। কাজের লোকের হাতের রান্না খেতে পারি না। চাকরি, সংসার সব একা সামলে ছেলেকে তেমন সময় দিতে পারি না। তবে মাঝেমাঝে ছুটির দিনে ঘুরতে নিয়ে যাই।‘
আদনান সাহেব লক্ষ্য করলেন, লোকটা নিজের সমস্যার কথা বলতে এসেছেন বলেও ছেলের কথাই বলে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘আপনার ছেলের যে সমস্যাটার কথা বলেছিলেন, সেটা কবে থেকে লক্ষ্য করলেন?’
‘ছোটবেলা থেকেই আমার সাথে ছেলেটার আচরণ খানিকটা অদ্ভুত ছিল। প্রথমে ব্যাপারটা আমি ধরতে পারি নি। যখন ধরতে পারলাম তখন আবার পাত্তা দেই নি। ভেবেছি ছোট মানুষ। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।‘
শফিক সাহেব খানিকটা বিরতি নিলেন। চায়ের কাপ উঠিয়ে কয়েকটা চুমুক দিলেন। এতক্ষণে চা ঠাণ্ডা হয়ে শরবত হয়ে যাওয়ার কথা। এতে অবশ্য তাকে বিচলিত মনে হল না।
‘কথা শেখার পর থেকেই খেয়াল করতাম ছেলেটা আমার নিজের মনে কথা বলে। একা একা থাকলে নিজের মনে হাসে। জিজ্ঞেস করলে কখনো কিছু বলতো না। চুপ করে থাকতো।
‘একদিন ছুটির দিনে আমরা চিড়িয়াখানা গেলাম। সারাদিন ঘুরলাম। খেলনার দোকান থেকে খেলনা কিনে দেয়া হল। বাসায় এসে খাওয়ার পর শুতে যাবো। ফাহিম এসে বলল, “বাবা, রাজু পরে গিয়ে পায়ে খুব ব্যাথা পেয়েছে। ওর পায়ে একটু ওষুধ লাগিয়ে দেবে? আমার খুব কান্না পাচ্ছে।“ আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম রাজু কে?
‘ফাহিম বলল রাজু তার বন্ধু। তার সাথে সারাদিন থাকে। তার সাথেই নাকি খায়, ঘুমায়।‘
ডাঃ আদনান বললেন, ‘আপনি তখন কি করলেন? রাজুর পায়ে ওষুধ লাগানোর অভিনয় করলেন?’
‘জি করতাম স্যার। কিন্তু ফাহিম বলল রাজু আমার কাছে আসবে না। তখন ফাহিমের হাতেই খানিকটা স্যাভলন ক্রিম দিতে হল। আমি জানি আমার এটা করা উচিৎ হয় নি। হয়তো তখনই বুঝিয়ে বলতে হতো। কিন্তু মা মরা বাচ্চা স্যার। একা থাকতে থাকতে একজন বন্ধু কল্পনা করে নিয়েছে। ব্যাপারটা ভেবেই কষ্টে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল।‘ বলতে বলতে সত্যিই লোকটার গলা ধরে এলো।
‘ব্যাপারটা কিন্তু তেমন অস্বাভাবিক কিছু না। অনেক বাচ্চাই এটা করে। সমবয়সী একজন বন্ধু কল্পনা করে নেয়।‘
‘জানি স্যার। আমিও তাই ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম বয়সের সাথে ঠিক হয়ে যাবে।‘
‘আপনার ছেলের বয়স এখন কতো? খুব বেশি নিশ্চয়ই না?’
‘আগামী বছর আটে পড়বে স্যার।‘
‘সে এখনো বেশ ছোট মানুষ। আমি চিন্তার কিছু দেখছি না। তাকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বললেই চলবে। ঠিক হয়ে যাবে।‘
শফিক সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘স্যার, আমার সমস্যার কথা এখনো শুরু করিনি।‘
‘জি আপনি বলতে থাকুন।‘ ডাঃ আদনান এই সময় লোকটির চোখ এড়িয়ে একবার ঘড়ি দেখে নিলেন। আটটা বেজে দশ। তিন্নিদের আসতে দেরি আছে।
শফিক সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘সেদিনের পর থেকে ফাহিম আমাকে রাজুর কথা বলতো। মাঝেমাঝেই বলতো। যে ছেলে কোনদিন নিজে থেকে তার মায়ের কথা জানতে চায় নি তার মুখে রাজুকে নিয়ে কতো গল্প।‘
এ সময় আদনান সাহেবের একটা ফোন এলো। লোকটার সামনে থেকে উঠে গিয়ে ফোন ধরতে হল। তিন্নি জানালো তাদের আসতে দেরি হবে। তারা খেয়ে আসবে। ফ্রিজে রাতের খাবার রাখা আছে। আদনান যেন গরম করে খেয়ে নেন।
ডাঃ আদনান ফিরে এসে দেখলেন লোকটা আবারো চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আজব লোক তো। তিনি বললেন, ‘শফিক সাহেব, আরেক কাপ চা দিতে বলি?’
‘না স্যার। বেশিক্ষন বসবো না। আপনার অনেক সময় নষ্ট করেছি।‘
‘খান আরেক কাপ। খেতে খেতে শেষটা শুনি।‘
‘না। আর খেলে রাতে ঘুম হবে না।‘
আদনান সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি বাকিটা বলুন। তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দিন। আপনার ছেলে যখন থেকে আপনাকে রাজুর কথা বলে আসছে তখন তার বয়স কতো? সেই সময় আপনি বা কাজের মানুষ ছাড়া সে কি বাইরের অন্য কারো সাথে মিশত?’
‘মিশত। ফাহিম তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। ক্লাসে তখন তার অনেক ক’জন বন্ধু-বান্ধব ছিল।‘
‘বন্ধুদের সাথে ওর সম্পর্ক কেমন বলতে পারেন?’
‘খুব স্বাভাবিক। আর দশটা বাচ্চার মতোই। আজকাল ওর বন্ধুর সংখ্যা আরো বেড়েছে।‘
‘ফাহিমের আচরণ কিন্তু আমার কাছে স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতোই মনে হচ্ছে।‘
‘একটা অস্বাভাবিকতা স্যার ছিল।‘
‘কিরকম?’
‘রাজু, মানে ওর কাল্পনিক বন্ধুর সাথে ও কখনো কারো সামনে কথা বলতো না। আমার সামনেও না।‘
আদনান সাহেব বললেন, ‘আপনি কি কখনো ওকে এই ব্যাপার নিয়ে শাসন করার চেষ্টা করেছেন?’
‘না স্যার। সে খুব অভিমানী ধরণের ছেলে। শাসন করতে গেলে আর কোনদিন এই ব্যাপারে হয়তো আমার সাথে কথাই বলতো না। ও যা বলতো, সব আমি মন দিয়ে শুনতাম। সায় দিতাম। মাঝেমাঝে এটা সেটা প্রশ্ন করতাম।‘
খুব মামুলি ব্যাপার মনে হচ্ছে। যদিও অভিজ্ঞতা থেকে আদনান সাহেব বুঝতে পারছেন এর মধ্যেই কোথাও লোকটার সমস্যার ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে। তিনি ধরতে পারছেন না।
শফিক সাহেব একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে বারান্দার খোলা দরজার দিকে তাকালেন। মনে হল দেখে নিলেন সেখানে কেউ আছে কিনা। ‘এর মাঝে একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা খুন হয়ে গেল।‘
‘মানুষ খুন হল?!’
‘জি স্যার। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া থেকে কথা কাটাকাটি। এই পর্যন্তই আমরা বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছিলাম। সেই রাতেই লোকটা নাকি স্ত্রীকে জবাই করে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেছিল। আমরা টেরও পাইনি। টের পেয়েছিলাম পরদিন সকালে। থানা পুলিশ হয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। পাশের ফ্ল্যাট হওয়ায় আমরা গলাকাটা লাশটাও দেখে ফেলেছিলাম। ড্রয়িং রুমেই পড়েছিলেন মহিলা। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন মাথাটা কয়েক ফুট দূরে।‘
‘আপনার ছেলেও কি লাশটা দেখেছিল?’
‘জি স্যার। কিছু করার ছিল না। দরজা খুললেই ওদের ড্রয়িং রুমটা দেখা যায়।‘
‘মাই গড! তারপর কি করলেন?’
‘আমি সাথেসাথে দরজা বন্ধ করে ফাহিমকে সরিয়ে নিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। পরের কয়েকটা দিন খুব খারাপ গেল। ভয়ে ছেলেটার জ্বর এসে গেল। আকাশ পাতাল জ্বর। আমি ভেবেছিলাম ছেলেটা আমার ট্রমাটাইজড হয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। ফাহিম আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠলো।‘
‘তবুও ওকে একবার একজন সাইকিয়াট্রিষ্ট দেখানো উচিৎ ছিল।’
‘দেখিয়েছিলাম স্যার। পপুলার হসপিটালে ডাঃ আলমকে দেখিয়েছিলাম। তিনি বললেন কোন ভয় নেই।‘
এই সময় শফিক সাহেব থেমে একবার চায়ের কাপ নিতে হাত বাড়িয়েও আর নিলেন না। নড়েচড়ে বসলেন। ‘আমার সমস্যাটার শুরু স্যার তখন থেকেই।‘
‘জ্বর থেকে ওঠার পরদিনই ফাহিমকে নিয়ে ডাঃ আলমের কাছে গিয়েছিলাম। হসপিটাল থেকে ফিরতে রাত হল। আমরা বাইরে খেয়ে নিলাম। বাসায় ফিরে গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার অভ্যাস রাতে একবার গোসল করা। নয়তো ঘুম আসে না।
‘এমন সময় ফাহিম এসে বলল, “বাবা, রাজুর খুব জ্বর। তবুও ও আমার সাথে শোবে না। বারান্দায় শুয়ে আছে।“ আমি বললাম, “তুমি বুঝিয়ে বল বাবা। বুঝিয়ে বললেই ও আসবে।“ ফাহিম বলল, “আসবে না। ও ভয় পাচ্ছে।“ আমি মনে মনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের ভয়?” ফাহিম সাথেসাথে বলল, “ও সেদিন রিতা খালামনিকে দেখে ফেলেছিল।“’
ডাঃ আদনান ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘রিতা খালামনি কে? পাশের ফ্ল্যাটের সেই মহিলা?’
‘জি। রিতা আপার সাথে ফাহিমের ভাব ছিল। মহিলা নিঃসন্তান ছিলেন বলেই কিনা জানি না, ফাহিমের প্রতি তার একটা সফট কর্নার ছিল হয়তো। খোঁজ খবর রাখতেন। মাঝেমধ্যেই এটা ওটা রান্না করে দিয়ে যেতেন। আপার হাতে তৈরি এক রকমের মিষ্টি ছিল ফাহিমের সবচেয়ে প্রিয় খাবার।‘
ডাঃ আদনান বললেন, ‘বুঝতে পারছি। তবে শিশুদের শোক সামলানোর ক্ষমতা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি হয়।‘
শফিক ডাঃ আদনানের কথা শুনলেন বলে মনে হল না। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, ‘আমার রাজুকে আনতে বারান্দায় যেতে হল।‘
এটুকু বলে ভদ্রলোক কেমন নিজের ভেতরে কুঁকড়ে গেলেন বলে মনে হল। ডাঃ আদনান কাজের মেয়েকে ডেকে আরো দু কাপ চা দিতে বললেন। চা এলো। শফিক সাহেব চা নিলেনও। দুয়েক চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ভাই কিছু মনে করবেন না। আজকে আমি উঠি?’
‘আরে উঠবেন কি? আপনার সমস্যাটার কথা বলে তারপর যেতে চাইলে যাবেন।‘
ভদ্রলোক মনে হল উদ্যম হারিয়ে ফেলেছেন। কিছুতেই থাকতে চাইছেন না।
ডাঃ আদনান শান্ত গলায় বললেন, ‘দেখুন শফিক সাহেব, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টা হেলা করার মতো না। তাছাড়া আপনার এতো ছোট একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চা, ঘর-সংসার সব আপনি একা হাতে সামলান। আপনার মানসিক সুস্থতা যে আপনার ফাহিমের জন্যও প্রয়োজন এটা বুঝতে পারছেন?’
এতে কাজ হল। শফিক সাহেবের অস্থিরতা খানিকটা কমে এলো। পকেট থেকে ফোন বের করে একবার সময় দেখে নিলেন। তারপর চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললেন, ‘সেদিন ছিল পূর্ণিমা। ফাহিমের রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দার পাশে বিশাল খোলা মাঠ। কয়েকটা নতুন বিল্ডিং উঠবে। দিনে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলে। রাতে মানুষ থাকে না। রাত বাড়লে জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাই ‘চাঁদের আলো’ ব্যাপারটা বোঝা যায়।‘
কিছুক্ষণ থেমে শফিক সাহেব আরেকবার বললেন, ‘সেদিন ছিল পূর্ণিমা। রাজুকে আনতে আমাকে ফাহিমের পেছন পেছন বারান্দায় যেতে হল।‘ বলতে বলতে একবার যেন শিউরে উঠলেন ভদ্রলোক।
ডাঃ আদনান কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছেন।
‘আমি দেখলাম বারান্দার এক কোণে অস্বাভাবিক রকম শুকনো একটা ছেলে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আমার কি হল জানি না, আমি ডাকলাম, রাজু? ছেলেটা নড়ে উঠে হালকা গলায় বলল, উঁ?’
ডাঃ আদনান এবার মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেন। শফিক থামতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি দেখলেন বারান্দায় একটা ছেলে শুয়ে আছে?’
‘জি স্যার দেখলাম।‘
‘কোত্থেকে এলো সেই ছেলে? খোলা দরজা দিয়ে কোন এক ফাঁকে কোন বাচ্চা কি ঢুকে পড়েছিল বাসায়?’
‘না স্যার। দরজা আমি ছাড়া আর কেউ খোলে না। ছেলেটা আশেপাশের কেউও না।‘
‘তাহলে কে?’
‘ছেলেটা রাজু, স্যার।‘
ডাঃ আদনান খানিকটা অবাক হলেন। এই লোক কি সত্যি সত্যি তার ছেলের কাল্পনিক বন্ধুকে দেখে নাকি? লোকটা তবে ডিল্যুশনাল? জীবনে বেশ কিছু ডিল্যুশনাল রোগী তিনি দেখেছেন। এই লোকটি তাহলে ব্যাতিক্রম, বলতেই হবে। ডিল্যুশন এর কোনরকম লক্ষণ এঁর মধ্যে নেই।
শফিক বলে চলেছেন, ‘আমি চাঁদের আবছা আলোয় ভালো করে ছেলেটাকে লক্ষ্য করলাম। লালচে কোঁকড়া চুল, বড় বড় চোখ, শরীরের চেয়ে মাথা অনেকখানি বড়। খারাপ স্বাস্থ্য ছাড়া অস্বাভাবিক আর কিছু চোখে পড়লো না। ছেলেটাকে চিনতেও পারলাম না। আশেপাশে কোথাও কোনদিন দেখিনি।
‘আমার ভয় পাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু কেন যেন তখন ভয়ের ব্যাপারটা টের পেলান না। ফাহিমকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই ছেলে কে?” ফাহিম জানালো, ওর নামই রাজু। ওর কথাই আমাকে এতদিন বলতো। ও লজ্জা পায় বলে কোনদিন আমার সামনে আসতো না। আমি যেন ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ফাহিমের বিছানায় একপাশে শুইয়ে দেই।‘
‘আপনি তখন কি করলেন? রাজুকে কোলে তুলে নিলেন?’
‘জি স্যার, নিলাম।‘
‘ছেলেটার ওজন টের পেলেন?’
শফিক সাহেব কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‘স্যার ছেলেটা আমার কল্পনা না। ছেলেটাকে আমি সত্যি সত্যিই দেখতে পেলাম। কোলেও নিলাম। জ্বরে ছেলেটার গা পুড়ে যাচ্ছিল। আমি ছেলেটার গায়ের উপরে একটা কাঁথাও দিয়ে দিলাম।‘
‘তারপর?’
‘নিজের রুমে ফিরে আসার পর পরই একটা ভয় আমাকে গ্রাস করলো। দৌড়ে গেলাম ফাহিমের রুমে। গিয়ে দেখলাম রাজু ছেলেটা আছে। ফাহিমের পাশেই শুয়ে আছে। ফাহিম ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি রাজুর মুখের দিকে তাকালাম। নিষ্পাপ বাচ্চা একটা মুখ। আমার ভয়টা কেটে গেল। কিন্তু সেদিন রাতে আর আমার ঘুম হল না। সারারাত এ ঘর ও ঘর পায়চারি করে কাটালাম।
‘সকাল হতেই আশেপাশে খোঁজ করবো ঠিক করলাম। ইন্টারনেট থেকে পুলিশের নাম্বার জোগাড় করে রাখলাম।
‘কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল পরদিন সকালে। মন্টুর মা, আমাদের কাজের মহিলা, তিনি যথারীতি পরদিন সকালে এলেন। আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করলেন। ফাহিমকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। ওকে খাইয়ে দিলেন। পুরোটা সময় ঘুমঘুম চোখে রাজু আশেপাশে ঘুরঘুর করলো। মন্টুর মা’র কোন ভাবান্তর হল না!’
খুবই ইন্টারেস্টিং কেস। লোকটাকে যতটা ব্যাতিক্রম ডাঃ আদনান ভেবেছিলেন এ তার চেয়েও এক কাঠি উপরে। রোগী নিজেই বুঝতে পারছেন যে তার ডিল্যুশন হচ্ছে। ডাঃ আদনান চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘আপনি তখন কি করলেন?’
‘একজন বুদ্ধিমান মানুষ হলে যা করতো স্যার। আমি বুঝতে পারছিলাম সমস্যা আমার। কাউকে বলতে গেলেই এক কথায় পাগল ভেবে বসবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি রাজুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দেখবো। হয়তো ভ্রম কেটে যাবে। ফাহিমকে স্কুলে ছেড়ে দিয়ে এলাম। লক্ষ্য করলাম রাজু ফাহিমের খাটের উপর গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। বের হওয়ার আগে ফাহিমের দিকে চেয়ে একবার হাসল, এটুকুই।‘
‘রাজুর সাথে আপনার প্রথম কথা হল কখন? মানে ভারবাল ইন্টার্যাকশন কতদিন পর হল?’
‘সেদিনই হল স্যার। আমি রাজুকে স্কুলে দিয়ে অফিসে গেলাম না। সোজা বাসায় চলে গেলাম। দেখলাম রাজু সেই আগের জায়গাতেই বসে আছে। কাজের মহিলা রান্না বান্নায় ব্যাস্ত। আমি সেই সুযোগে ফাহিমের রুমে গেলাম। রাজুকে কয়েকবার নাম ধরে ডাকলাম। ছেলেটা শুধু ঘুরে তাকাল, সাড়া শব্দ করলো না। জিজ্ঞাসা করলাম ওর বাসা কোথায়? বাবা মা’র নাম কি? ছেলেটা কিছুই বলল না। কোন ভাবান্তরও হল না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি ফাহিমের সাথে সবসময় থাকো? ফাহিমের কথা বলাতে ছেলেটা মৃদু হাসল। মাথা দুলিয়ে সায়ও দিলো। কিন্তু আর কোন কথা ওর কাছ থেকে বের করতে পারলাম না।‘
‘শফিক সাহেব। এই ঘটনা ঠিক কতদিন আগের?’
‘তা মাস তিনেক আগের কথা স্যার।‘
‘এরপর আর কতবার রাজুর সাথে আপনার দেখা হয়েছে? সে কি মাঝেমাঝেই আসতো?’
‘স্যার সেদিনের পর থেকে রাজুকে আমি প্রতিদিন দেখি। ছেলেটা ফাহিমের সাথে সাথে থাকে। খাওয়ার সময় ওর পাশে বসে থাকে। ঘুমানোর সময় একই খাটে পাশাপাশি ঘুমায়। আমি না থাকলে চিকন গলায় ফাহিমের সাথে কথাও বলে। আমি আড়াল থেকে শুনেছি।‘
‘কি কথা বলে?’
‘তেমন কিছু না স্যার। ছোট বাচ্চারা যেসব বলে।‘
শফিক সাহেব আবার চুপ করে গেলেন। তার সমস্যার কথা বোধহয় শেষ হয়েছে। রাত হয়েছে। ডাঃ আদনান ঘড়ি দেখলেন। দশটা বাজতে সাত মিনিট বাকি। আজকের মতো লোকটাকে বিদায় দিতে হবে। তবে এঁর দীর্ঘ চিকিৎসা দরকার।
ডাঃ আদনান বললেন, ‘শফিক সাহেব, আপনার যেটা হচ্ছে সেটাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে ডিল্যুশন। চাকরি, সংসার, বাচ্চা একা সামলাতে সামলাতে মানসিক চাপে পড়ে এটা হতে পারে। আবার এর পেছনে অন্য কোন কারণও থাকতে পারে।‘
আদনান সাহেবকে মাঝপথে প্রায় থামিয়ে দিয়ে শফিক বললেন, ‘কিন্তু স্যার, আমি যে শুধু রাজুকেই দেখি তা না। অনেক বাচ্চাদেরই ফাহিমের মতো কাল্পনিক বন্ধু আছে। কোন কোন বাচ্চার সাথে সেই বন্ধুরা খেলার মাঠেও চলে আসে। রাজুর সাথে আমি কথা বলতে পারিনি। কিন্তু অন্য কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি।‘
ডাঃ আদনান বুঝতে পারলেন রোগীর ডিল্যুশন খুব ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। ভালো রকম চিকিৎসা না হলে এটা আরো বাড়বে। বাড়তেই থাকবে। একসময় রোগী স্কিতজোফ্রেনিক হয়ে যাবেন।
‘শফিক সাহেব, একটা প্রশ্নের জবাব দিন। রাজু ছেলেটা কি সারাদিন আপনাদের বাসাতেই থাকে?’
‘জি স্যার থাকে।‘
‘সে খাওয়াদাওয়া কি করে?’
‘ছেলেটা আমাদের সাথে কোনদিন কিছু খায় নি।‘
‘জামা কাপড়? নিশ্চয়ই সে এক কাপড়ে তিনমাস ঘুরে বেড়াচ্ছে না?’
শফিক সাহেব এবারে কিছুটা আহত চোখে তাকালেন। বললেন, ‘স্যার, আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?’
‘মিঃ শফিক, কখনো কখনো ডিল্যুশনাল রোগীর ডিল্যুশন যুক্তি দিয়ে ভেঙ্গে দেয়া যায়। আমি সেই চেষ্টাই করছিলাম। ঠাট্টা করিনি। রাজু ছেলেটা ফিজিক্যাল কিছু টাচ করছে না, কোন ধরণের খাবার দাবার কঞ্জিউম করছে না। সমস্যাটা কোথায় আপনি কি ধরতে পারছেন?’
‘পারছি স্যার। কিন্তু…, এমন কি হতে পারে না যে বাচ্চাগুলো সত্যি সত্যিই আছে। ছোটরা দেখতে পায় কিন্তু আমরা পাই না? আমরা ভেবে নেই শিশুদের কল্পনা?‘
ডাঃ আদনান লক্ষ্য করলেন এবার কিছুটা ডিল্যুশনের সিম্পটম প্রকাশ পেয়ে গেল। রোগী ভেবে নিচ্ছে, হয়তো সে যা দেখছে তাই সত্যি। অন্য সবাই ভুলও হতে পারে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শফিক আবার বলল, ‘আমি বাচ্চাগুলোকে দেখতে পাই স্যার। ধরতে পারি, কথা বলতে পারি।‘
ডাঃ আদনান এবার সাহস দিয়ে বললেন, ‘বুঝতে পারছি শফিক সাহেব। আপনার অল্প কিছুদিন চিকিৎসা দরকার। ভয় বা চিন্তার কিছু নেই। আপনি কাল একবার আমার চেম্বারে চলে আসুন। বিকেল চারটায় আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করবো।‘
‘জি আচ্ছা স্যার আসবো। আজকে তাহলে উঠি?’
ডাঃ আদনান বললেন, ‘আপনাকে খেয়ে যেতে বলতাম। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন ঘরে কেউ নেই।‘
শফিক তাড়াতাড়ি বলল, ‘না না স্যার। অন্য কোন দিন।‘
আদনান সাহেব শফিককে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। লোকটা অল্প খুঁড়িয়ে হাঁটে। আগে চোখে পরে নি।
***********
রাত অনেক হয়েছে। তিন্নিদের আসার নাম নেই। আদনান সাহেব কয়েকবার ফোন দিলেন, কেউ ধরল না। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। কিনতে যাওয়া দরকার। ফ্রিজ থেকে খাবার নামিয়ে খেয়ে নিয়ে যাবেন কিনা ভাবলেন একবার। নাহ, আগেই যেতে হবে। খাওয়ার পর পরই একটা সিগারেট তার খেতে হয়।
পাতলা সুয়েটার গায়ে চাপিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখলেন তিন্নিরা উঠে আসছে। মোহনার হাতে গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাই। ঢাকা শহরে এতো রাতেও হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয়?
বাবাকে দেখে মেয়েটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ডাঃ আদনান চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘মা, তোমাকে না বলেছি হাওয়াই মিঠাই খাওয়া যাবে না?’
‘খাই না তো আব্বু। আজকে আম্মু জোর করে কিনে দিলো।‘
আদনান সাহেব হেসে উঠলেন। মেয়েটা তার বুদ্ধিমতি। তিন্নিরা উঠে গেল। তিনি রাস্তায় নেমে এলেন। কাছের মুদি দোকানটায় যেতেও কিছুক্ষণ হাঁটতে হয়। ভালো শীত পড়েছে। রাস্তায় কয়েক জায়গায় লাইট নষ্ট। অন্ধকারে এখানে সেখানে দুই একটা কুকুর হঠাৎ চমকে দিয়ে ঘেউঘেউ করে ডেকে উঠছে।
আদনান সাহেব সিগারেট কিনছেন। তখন পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠলো, ‘স্যার।‘
তিনি পেছন ফিরে দেখলেন দূরে শফিক দাঁড়িয়ে আছেন। বাম হাতে এক কাপ চা, ডান হাতে একটা সিগারেট। পাশের চা দোকানে অনেকগুলো লোক।
আদনান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি এখনো এখানে? বাসা কোথায় আপনার? আশেপাশেই নাকি?’
‘জি না। বাসা দক্ষিণ বনশ্রী।‘
‘সে তো অনেক দূর। এতো রাতে এখনো এখানে যে?’
লোকটা ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার একটা কথা আপনাকে বলে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু আবার যেতে সাহস হচ্ছিল না।‘
ডাঃ আদনান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কি এমন কথা যেটা বলার জন্য এই শীতের মধ্যে এতো রাত পর্যন্ত লোকটা দাঁড়িয়ে আছে? কালকে চেম্বারে এসে কি বলা যেত না?
‘স্যার, আপনার মেয়ের নাম কি মোহনা?’
এবার আদনান সাহেব একটু চমকালেন। ‘হা, কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন?’
‘তিতলির কাছে জেনেছি স্যার।‘
‘তিতলি কে?’
‘তিতলি স্যার খুব শান্ত মেয়ে। আজকে পুরো সন্ধ্যা আপনার পাশে চুপচাপ বসে আমাদের সব কথা শুনলো। আপনি যখন ফোন ধরতে উঠে গেলেন তখন কথা হল মেয়েটার সাথে।‘
সর্বনাশ! এই লোক বলে কি? এঁর তো ভয়ানক খারাপ অবস্থা মনে হচ্ছে।
লোকটার চা শেষ। সে বিল দিয়ে আর দাঁড়ালো না। বিদায় না নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলো। অদ্ভুত লোক।
ডাঃ আদনান চিন্তিত মুখে বাসায় ফেরত এলেন। আপাত দৃষ্টিতে সুস্থ একজন মানুষ যে ভেতরে ভেতরে এতোটা অসুস্থ হয়ে থাকতে পারে ভাবা যায় না। কাল্পনিক বন্ধুর ব্যাপারটা তার মেয়ের মধ্যেও আছে। কিন্তু এই সাধারণ ব্যাপারটাকে যে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় এটা ভাবতেই আশ্চর্য লাগছে।
শফিক লোকটা তার মেয়ের নাম জানলো কিভাবে সেটা এক রহস্য। নিশ্চয়ই এঁর কোন ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এখন করতে ইচ্ছে করছে না।
তিতলি নামটা কেন যেন আদনান সাহেবের মাথায় গেঁথে আছে। ‘তিতলি’, নামটা সুন্দর। কোথাও কি শুনেছেন? শুনে থাকতে পারেন। কোন রোগিণীর নাম হবে হয়তো।
রাতের খাওয়ার পর আদনান সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। তিন্নি মোহনার রুমের লাইট বন্ধ করে চলে আসছিলেন। মোহনা ভেতর থেকে বলল, ‘আম্মু, ঘুম পাড়ানি গানটা গাও না।‘
তিন্নি বলল, ‘আজকে না মামনি। অনেক টায়ার্ড লাগছে। আজকে ঘুমিয়ে যাও?’
মোহনা আদুরে গলায় বলল, ‘আম্মু প্লিইইইজ। গানটা না শুনলে তিতলির ঘুম আসবে না। আমাকেও ঘুমুতে দিবে না।‘
মেয়ের কথায় তিন্নি হেসে ফেললো। কিন্তু আদনান সাহেব সেটা খেয়াল করলেন না। তার হাত থেকে সিগারেট কার্পেটের উপর পরে গেল। তার মনে হল মোহনার ঘর থেকে তিন্নি বা মোহনা ছাড়াও আরেকটা গলার হাসি শোনা যাচ্ছে। চিকন এবং অপরিচিত গলার হাসি।