পুকুরের_সেই_আতঙ্ক ৭ম পর্ব

রশিদ আর জালালুদ্দিন মাতবর ঘন অন্ধকারের মধ্যেও সাঁতরে এক জায়গায় পৌঁছালেন পানির মধ্যে। রশিদ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘হচ্ছেটা কী এসব?
মাতবরও হাপাচ্ছেন, ‘পিশাচটা ভ্রম সৃষ্টি করে তোমাকে হত্যার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাকে পিশাচ শক্তি এখানে নিয়ে এসেছে নাকি কোনো শুভ শক্তি তোমাকে বাঁচাতে ভ্রম সৃষ্টি করে আমাকে এখানে এনেছে বুঝতে পারছি না।’
‘মানে, ওস্তাদ!’
‘আমাকে এই পুকুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে ৬টি কিশোরী মেয়ের অবয়ব। ওরা আমাকে না নিয়ে এলে তোমাকে একা ওই শয়তান শক্তিটার সঙ্গে লড়াই করতে হতো। তাছাড়া পুকুরে হারিয়ে যাওয়া রক্ষা কবজ গুলোও ওরা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পানিতে যে ৬টি মেয়ে পিশাচটার সাথে ছিল ওদের চেহারা একই রকম হলেও এদেরকে ভিন্ন সত্তা মনে হলো! ওরা আমাদের সাহায্য করতে চায়!’
‘আমার গায়ে কোনো কবজ নেই! এখন আমরা কী করবো। পুকুর থেকে উঠে যাব? শয়তানটা মনে হচ্ছে পানির নিচেই আছে এখনো।’
অন্ধকারে রশিদ অনুভব করলো তার শরীরে কিছু বেঁধে দিচ্ছে বুড়ো তান্ত্রিক। স্পর্শ করে বুঝতে পারলো ওস্তাদ তার শরীরের কবজগুলো খুলে তাকে পরিয়ে দিচ্ছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘একি করছেন? আপনি বিপদে পড়বেন!’
‘আমরা একসঙ্গে থাকলে কোনো বিপদ নেই। এখানেই আমরা ভেসে থাকবো কিছুক্ষণ। দেখি শয়তানটার কী ফন্দি আছে! শুধু ওটাকে তোমার ভেতরে ভ্রম সৃষ্টি করতে দেবে না। ভ্রম সৃষ্টি হয় বিশ্বাস থেকে। এখন থেকে যা কিছু দেখবে সবই সন্দিহান হয়ে দেখবে। তবেই ওটা সম্মোহন করতে পারবে না। চিন্তাগুলোকে বিক্ষিপ্ত রাখবে। মন্ত্রগুলোর শক্তি ভুলে যেও না। ওগুলোর সামনে দুনিয়ার কোনো অশুভ শক্তির দাঁড়ানোর স্পর্ধা নেই এটা বিশ্বাস করবে।’
এমন সময়েই চাঁদের সামনে থেকে ভেসে চলে গেল মেঘ। জোৎস্নার আলোয় দৃষ্টিগোচর হয়ে আসতে লাগলো সবকিছু। পুকুরের সামনের দিকের পাড়ের দিকে তাকাতেই তাদের দুজনের শরীর ঝুরে একটা কাঁপুনি বয়ে গেল। ওখানে মাথাবিহীন ৬টি কিশোরী মেয়ে অন্ধের মতো দুটো হাত সামনে নিয়ে বাতাস হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে আসছে পুকুরের দিকে। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে না ওরা অশরীরী! কারণ ওদের ছায়া মাটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জোৎস্নার সোনালী প্রতিবিম্বও তাদের নগ্ন শরীরে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। ওদের শরীর এভাবে হেঁটে আসছে বিশ্বাস হচ্ছে না রশিদের। নিখোঁজ ৬টি মেয়ের মধ্যে ২টি মেয়ের লাশ গোরস্থানে দাফন করা হয়েছিল আর এই রাতে উদ্ধার হওয়া বাকি ৪টি লাশকে তো পুলিশ থানায়ই নিয়ে গেছে। জালালুদ্দিন মাতবর শক্ত করে চেপে ধরলেন রশিদের হাত। বললেন, ‘ওগুলো অশরীরী নয়! এগুলো ওই মেয়েগুলোর আসল শরীর! কিন্তু ওরা আবার এই অভিশপ্ত পুকুরে ফিরে আসছে কেন! ওরা মৃত, তারমানে ওদেরকে কোনো শক্তি আবার জীবিত করে এখানে পাঠিয়েছে।’
রশিদ আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের কী থামানো উচিত ওদের? হয়তো পিশাচটাই কোনো উদ্দেশ্যে আবার ওদেরকে ডেকে এনেছে এখানে।’
‘আমার মনে হয়…..’
থমকে গেল দুজনেই।মাথাবিহীন ৬টি শরীর প্রায় পুকুরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এমন সময়ই হঠাৎ তাদের চারপাশের পানি অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল। যেন তাদের ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে কিছু। উত্তেজনা অনুভব করলো দুই তান্ত্রিকই। উত্তেজিত হয়ে একে অপরের হাত ধরে এদিক,সেদিক মাথা ঘুরাতে লাগলো দুজনেই। একে একে ৬টি প্রাণহীন মাথা ভেসে উঠল তাদেরকে ঘিরে। কেবল মাথাই ওগুলো, সংযুক্ত শরীর নেই কোনো। চোখ মুদিত এই মাথাগুলোই ওই পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরগুলোর। রশিদ এবং জালালুদ্দিন মাতবর দুজনেই বিশ্বাস করতে চাইছেন এগুলো তাদের ভ্রম। কিন্তু অশুভ শক্তির কোনো আভাস তারা পাচ্ছেন না আর আশেপাশে এখন। পিশাচটা কী খেলা খেলছে তাদের সাথে!
জালালুদ্দিন মাতবর বললেন,’পিশাচটা মেয়েগুলোর মাথাও খায়নি দেখছি। শুধুই শরীর থেকে এগুলো আলাদা করে নিজের কাছে রেখেছিল। এখন আবার ভাসিয়ে দিয়েছে ওগুলো!’
পুকুরের পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো পানিতে মেয়েগুলোর শরীর। রশিদকে ইশারা করে উল্টো পাশের পাড়ে সাঁতরাতে লাগলো বুড়ো তান্ত্রিক। রশিদ বিভ্রান্ত ভাবে তাকে অনুসরণ করে পাড়ে উঠে এলো! কোনো কিছুই তাদের বাধা দিল না।
দুজনেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে পুকুরের দিকে তাকালেন। কিছুমাত্র অস্বাভাবিকতার চিহ্ন নেই আর ওখানে। একদম শান্ত একটা পুকুর মনে হচ্ছে ওটাকে। মেয়েগুলোর শরীর বা মাথা কোথায় গেল কিছুই বোঝা গেল না! ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করলেন তারা। এরপর ধীরে ধীরে হেটে পথ ধরলেন মেম্বার বাড়ির পথে।
সকাল গাঢ় হতেই তুলি আর নুপুরের কবর ফুঁড়ে উঠে যাওয়া আর পুলিশের ভ্যান থেকে ৪টি মেয়ের লাশ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা পুরো আফসারপুরে ছড়িয়ে পড়লো। আতঙ্কিত মানুষ আরও বেশি আতঙ্ক অনুভব করলো। রশিদ বা জালালুদ্দিন মাতবর তাদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিতে না চাওয়ায় রাতে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুমাত্র কাউকে বললো না। শুধু দুই তান্ত্রিকই জানে তারা ভেতরে ভেতরে কতটা দিশেহারা বোধ করছে।
দিনের বাকিটা সময় জালালুদ্দিন মাতবর ঘরের ভেতরেই বন্ধি হয়ে রইলেন। সাধনার সমস্ত উপকরণই তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো। তাই নিয়েই ধ্যানে বসে পড়েছেন তিনি। তন্ত্র-মন্ত্রের শব্দ, উৎকট গন্ধ আর ধুয়োয় ভরে আছে ঘরটা। রশিদ তান্ত্রিকতা কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে পুরোনো সেই শখ গোয়েন্দাগিরির দিকে এগিয়ে গেল। গ্রামে ঘুরে ঘুরে পুকুরে পিশাচটার শিকার ৬টি মেয়ে সম্পর্কেই খোঁজ খবর নিতে লাগলো। তার বিশ্বাস পিশাচটার ওই প্রাচীন পুকুরে উদয় হওয়ার পেছনে এই মেয়েগুলোরই হাত আছে। মেয়েগুলোর সমবয়সী অন্যান্য মেয়েদের বাড়িতে গিয়ে ওদের সম্পর্কে টুকটাক তথ্য নিতে লাগলেন। অবাক হওয়ার মতো বা নতুন কিছুই তারা বলল না।
শেষ বিকেলে গ্রামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে রশিদ জানতে পারে মেয়ে ৬টিকে নাকি গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরেরই একটি জঙ্গল থেকে বের হতে দেখেছিলেন তিনি। জঙ্গলটা তেমন গহীন নয়। জন্তু জানোয়ার বলতে শেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। আরও অনেক মানুষই ফল-ফুল, গাছের ডাল আনতে ওখানে যায় মাঝেমধ্যে। জঙ্গলটা দেখেছিল রশিদ। দূর থেকে ওটাকে গভীর কোনো জঙ্গলই মনে হয়েছিলো। ওখানে যে কেউ যেতে পারে অনুমান। করা যায় না। সে মেম্বার বাড়িতে ফিরে এলো। জালালুদ্দিন মাতবরকে জঙ্গলের কথাটি বলল।
বুড়ো তান্ত্রিক বললেন, বেশ কিছু শক্তির সন্ধ্যান তিনি পেয়েছেন ধ্যান ধরে। তাদের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করেছে প্রাচীন পুকুরটার পিশাচটা সম্পর্কে। ওরাও যা ইশারা করেছে পিশাচটার উৎপত্তি, শিকড় ওই জঙ্গলের ভেতরেই। ওই জঙ্গলে ঢুকে কিছু একটা করে নিজেদের মৃত্যু নিজেরাই ডেকে এনেছে মেয়েগুলো। রাত নামতে আর বেশি দেরি নেই। সন্ধ্যা নামার পরই পিশাচটার শক্তি বেড়ে যাবে। ওটা যে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে মেয়েগুলোর খণ্ডিত শরীর আবার পুকুরে এনেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কী উদ্দেশ্য! রশিদ জালালুদ্দিন মাতবরকে একবার বলেছিল দিনের বেলাতেই পুরো পুকুরটা তারা দুজন মিলে ভালো ভাবে তল্লাশি করবে। হয়তো মেয়েগুলোর শরীর এবং মাথা খুঁজে পাওয়া যাবে। ওগুলো তুলে আনলেই হয়তো ওটার শক্তি কমে যাবে। কিন্তু ওস্তাদ নিষেধ করেছে।
ওটার নিশ্চই ওগুলো লুকোনোর জন্য নিজস্ব কোনো জায়গা আছে। ওটাকে নরখাদকও মনে হচ্ছে না। এর আগেও অনেকে অনুসন্ধান করে মেয়েগুলোর শরীর পায়নি। একটা সময় পর আপনা-আপনিই ওগুলো ভেসে উঠছে।
জঙ্গলটা সম্পর্কে মেম্বার এবং বয়স্ক মানুষদের কাছে জিজ্ঞেস করে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করলো তারা। বয়োবৃদ্ধরা জন্মের পর থেকেই ওটাকে সাধারণ একটা জঙ্গল হিসেবে চেনে। আগে যদিও অনেক গাছ আর জন্তু জানোয়ার ছিল। এই গ্রামের মানুষদের তেমন একটা ওই জঙ্গলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে কিছু দস্যি ছেলে মেয়ে প্রায়ই সঙ্গী সাথী নিয়ে ওখানে যায়।
দুই তান্ত্রিকই সিদ্ধান্ত নিল জঙ্গলে ঢুকবে এখন তারা। সন্ধ্যা নেমে আসবে কিছুক্ষণ পরেই। টর্চ জোগাড় করে গ্রামের মানুষকে না জানিয়েই জঙ্গলে প্রবেশ করলো তারা দুজন। গা জুড়ে বাধা আছে রক্ষা কবজ। মনে প্রচণ্ড বিশ্বাস যে করেই হোক পিশাচটাকে ধ্বংস করতেই হবে তাদের। ওটা যে সুযোগ পেলে কতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তা তারা বুঝে ফেলেছে।
জঙ্গলটা আসলেই গহীন না। বাইরের দিকে ঘন হলেও যত ভেতরে এগোনো যায় তত উজাড় হয়ে গেছে গাছ-পালা। হাঁটার পথ আছে। দুজনেই শব্দহীন ভাবে জঙ্গলের ভেতরের দিকে এগিয়ে চললো। ……..

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প