অভিশপ্ত দোলনা(প্রথম পর্ব)

স্যার,এই দোলনায় যত মানুষ বসেছে একদিন আগে হোক আর পরে হোক সবাই আত্মহত্যা করে অথবা তার বীভৎস লাশ পাওয়া যায় ।কিন্তু আপনি এখনো বেঁচে আছেন কিভাবে?
রিতুকে নিয়ে এই পার্কে বেড়াতে আসছিলাম গত ৭দিন আগে।রিতুর কাছে ভালো লাগায় আবারো এসেছি।কিন্তু গার্ডের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
-আপনি সেদিন আমাকে বলেন নাই কেন?
-স্যার, ওই দেখেন লেখা আছে দোলনায় বসা নিষেধ।আপনি কি লেখাটা পড়েন নাই?
এবার আমার চোখে লেখাটাই আটকে গেলো।রিতুকে দেখাতেই সে ভয়ে কেঁদে ফেললো।গার্ড আমাকে আবারো সাবধান করে দিয়ে বললো,
-স্যার সাবধানে থাকবেন!
আপা,স্যারকে দেখে রাখবেন!কখন কি করে বসবে সে নিজেও জানেনা।
আমি আরেকটু বিস্তারিত শুনতে যাবো।কিন্তু তার আগেই তার বড় কারো ডাকে সে চলে গেল।
রিতু আমাকে ধরে বললো,
-এখানে আর এক মূহুর্তও না।চলো, বাড়িতে চলো।
গার্ডের কথার সাথে আমার এক সপ্তাহের এক্সপেরিয়েন্স মেলানোর চেষ্টা করলাম।হ্যাঁ, এই এক সপ্তাহে আমার সাথে অনেক কিছুই হয়েছে।যেটাকে বলা হয় প্যারানরমাল একটিভিটি।আমি ঘুমের মাঝে স্বপ্নে শুধু দোলনাটার ছবিই দেখেছি।কিন্তু শুধু দোলনা দেখিনি।দোলনাতে একটা নারী বসে থাকে।
রিতু আমাকে ধরে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিলে আমার সম্ভিত ফিরে আসে।আমি কল্পনায় ডুবে গিয়েছিলাম।
আমাকে জোর করে ধরে রিতু চলে আসলো।
সারাপথ আমার মাথায় গার্ডের কথা বাজতে থাকলো।কেন ওই দোলনাতে বসলে মানুষ মারা যায়?বা তাকে হত্যা করা হয়?যদি সত্যিই মারা যায় তাহলে আমি বেঁচে আছি কেন?
রিতু মেয়েটাও কেমন!গার্ডের থেকে ওই কথা শুনে কান্না শুরু করেছে তো থামার নাম নেই।আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে কাছে বসিয়ে বললাম,
-আমার কিছুই হবে না!তুমি টেনশন করো না।হলে এই কদিনে হয়ে যেত!
-তুমি এই কয়েকদিন যে এবনরমাল আচরণ করেছো তাতে আমার মনে এখন প্রশ্ন জাগছে৷ ওই দোলনায় বসার কারণেই এমন হচ্ছে কিনা!
-আমি আবার কি আচরণ করলাম!ঘুম থেকে উঠে কত মানুষ হাঁটাহাঁটি করে।আমার এমন হয়েছে তাই তুমি রাগ করছো?
-এই সাতদিনেই তোমার সাথে এমন হয়েছে!
রিতুকে রেখে আমি পাশের রুমে গিয়ে দরজা আটকিয়ে দিলাম।দরজার ওপাশে কিছুক্ষণ লাথিগুতো দিয়ে দরজা খুলতে বলে রিতু চুপ হয়ে গেল।।
প্রতিরাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি পার্কের ওই দোলনাটাই বসে আছি।আমার সাথে একটা মেয়ে বসা।মেয়েটার সাথে আমি অনেক গল্প করছি কিন্তু মেয়েটাকে চিনতে পারছি না।স্বপ্নটা একদিন দেখলে স্বাভাবিক বলে মনে হতো। কিন্তু প্রতিদিন একই স্বপ্ন কেন?
সিদ্ধান্ত নিলাম সমস্যাটার সমাধান আমাকে করতে হবে।
রাতে ঘুমানোর সময় দেখি জানালা খোলা।জানালা আটকাতে গিয়ে দেখি একটা বাচ্চা ছেলে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
-ভয় পান না আমাকে দেখে?
-তুমি কে?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে বাচ্চাটা দৌঁড় দিল।হঠাৎ আমার মনে হলো আমি তো ৭ তলার উপরে, তাহলে এখানে বাচ্চা কিভাবে আসবে।কি হচ্ছে এসব?
আমি অনেক সাহস নিয়ে জানালা দিয়ে নীচে তাকালাম।নীচের ফ্লোরের আলোতেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।তাহলে এটা কি আমার হ্যালুসিনেসন?
জানালা আটকিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।প্রচণ্ড টেনশন আর শরীরের উপর চাপ থাকায় খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম।কিন্তু ঘুম ভাঙলো সেই আগের স্বপ্ন দেখে।কিন্তু আজ মেয়েটা আমার সাথে কথা বলছে সেটা বুঝতে পেরেছি,মেয়েটা আমাকে বলছে,
-আমার সাথে প্রতিনিয়ত দেখা করবা!আমি তোমাকে প্রতিদিন চাই।
বলেই একটা হাসি দিয়ে দিল আর সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙে গেল।
বিছানা হাতরে দেখি রিতু বিছানায় নেই।বাথরুমে গেচগে ভেবে আমিও বাথরুমে গেলাম।দেখি রিতু বাথরুমের আয়নাতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কার সাথে যেন কথা বলছে।আমি রিতু বলে তাকে অনেকবার ডাক দিলেও সে আমার দিকে তাকাচ্ছিল না।আমি দৌঁড়ে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিলে সে আমার গায়ের উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।রিতুর মুখে পানি ছিটিয়ে তাকে বিছানায় এনে শোয়াই দিই।
পরেরদিন সকালে গার্ডের সাথে দেখা করার জন্য পার্কে যাই।যথারীতি দোলনার পাশেই গার্ডকে দেখতে পাই।একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে।আমাকে দেখেই চোখ বড়বড় করে সালাম দিলো।আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম,
-চাচা,আপনি এভাবে তাকাচ্ছেন কেন আমার দিকে?মনে হচ্ছে ভুত দেখছেন?
-এই দোলনায় ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে যেই বসেছে, আমি তারই খোঁজ নিয়েছি দুদিন পরে।হয় কেউ অকারণে আত্মহত্যা করেছে,আর না হয় তার লাশ পাওয়া গিয়েছে।
-আপনি বুঝলেন কিভাবে? এখানে বসলে মানুষ মারা যায়?
-প্রথম যখন এই দোলনা এখানে রাখা হয়,তার পরের দিন একজন আসে বসছিলো।সে মারা যায় একদিন পরেই।তার বউ এসে বলেছিলো সে নাকি খালি দোলনার কথা বলতো।সেখান থেকেই ধারণা পেয়ে ভুল করে বসা লোকদের পিছু নিতাম।
অগোছালোভাবেই গার্ড আমাকে কথাগুলো বললো।গার্ডের কথাশুনে মনে হলো এই দোলনার পিছনে নিশ্চয়ই একটা কাহিনী আছে।কিন্তু কি সেই কাহিনী?
গার্ডকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম।পিছন থেকে আমাকে সাবধানে থাকতে বললো।
অফিস থেকে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেল।রাত আটটার পরেই আমাদের এলাকায় আর ভ্যান বা রিক্সা পাওয়া যায় না।তাই আমি কানে হেডফোন গুজে নিরিবিলি হাঁটছি।হঠাৎ আমার পিঠে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠলাম।পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি একটা মেয়ে।আমি কান থেকে হেডফোন খুলে মেয়েটাকে বললাম,
-কোনো সমস্যা?
-আমাকে একটু এগিয়ে দেয়া যাবে?
-আপনাকে আমি চিনি না,আপনাকে এগিয়ে দিতে যাবো কেন?
-অপরিচিত একটা মেয়ে একলা যেতে পারছে না বলেই কিন্তু আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছে!
-তা ঠিক,তবে চলুন!আপনার সাথে ছিনতাইকারী গ্যাঙের মিল নেই তো?
-মেয়েটা একটা লাজুক হাসি দিয়ে বললো,
না।
পাশাপাশি কিছুসময় হাঁটার পর মেয়েটার পায়ের দিকে আমার নজর যায়।জিনিসটা ভালো করে খেয়াল করার পরে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়।শিট,মেয়েটার পা উলটো দিকে এবং মেয়েটা মাটি থেকে মিনিমাম আধা হাত শুন্যে ভেসে যাচ্ছে।ওটা দেখার পর মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই মেয়েটা একটা বীভৎস হাসি দেয়।যেই হাসিটার সাথে আমার স্বপ্নে দেখা মেয়েটার মিল আছে।
কান থেকে হেডফোন খুলে আয়তুল কুরসী পড়তে পড়তে আমি দৌঁড় দিই।আমার সমস্ত শক্তি আমার পায়ে কনভার্ট করে আমি দৌঁড়াতে থাকি।পিছনে ফেরার সাহস আর হয়নাই। কিন্তু কিছুসময় পরেই একটা কান্নার আওয়াজ আমার কানে আসে।মনে হচ্ছিলো কেউ ঘরের বাইরে যাবে কিন্তু অন্যকেউ আটকিয়ে রাখলে যেভাবে মানুষ কান্না করে সেভাবে।
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বাড়ির সামনে এসে দরজায় নক করতেই রিতু এসে দরজা খুলে দেয়।অল্প সময়ের মধ্যে দরজা খুললেও ভয়ের কারণে রিতুকে বলি,
-এত সময় লাগে দরজা খুলতে?
রিতু আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে বলে,
-তুমি?
-হ্যাঁ, আমি। দরজা থেকে সরে যাও।আমি ভয় পেয়েছি!
-তুমি এখানে আসলে কিভাবে?একটু আগেই না তুমি ঘরে ঢুকে বাথরুমে শাওয়ার নিতে গেলে?
-মানে?
-মানে তুমি তো কিছু সময় আগেই বাড়িতে এসেছো।আমার সাথে কথা বললে না,রাগে গজগজ করতে করতে বাথরুমে গেলে!
-রিতু তোমার মাথা ঠিক আছে?আমি মাত্রই আসলাম।
রিতু ভয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
-আমি আর রুমে যাচ্ছিনা।
আমি অভয় দিয়ে তাকে রুমে নিয়ে গেলাম।সমস্ত রুম,বাথরুম,রান্নাঘর চেক করেও অন্যকারো উপস্থিতি পেলাম না।
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে রিতুকে ঘুমিয়ে যেতে বললাম।কিন্তু বেচারীর মনে একটা ভয়,গার্ডের কথামতো আমি যদি নিজের কিছু করে ফেলি।তাই সে আমাকে একা থাকতে দিবে না।
বাধ্য হয়ে বিছানায় তার সাথে বসে থাকলাম।রিতু ঘুমিয়ে গেলে ল্যাপটপটা অন করে ইভানা পার্কের বিস্তারিত কিছু তথ্য জানার৷ জন্য গুগলে ঢুকলাম।কিছুসময় ঘাটাঘাটি করার পর দোলনার ছবি পেলাম।হ্যাঁ এটা সেই দোলনা।দোলনাটা এসেছে কোথা থেকে বা কেন এখানে সেটা জানার জন্য ঢুকতে যাবো, তখনি দোলনা দুললে যেই শব্দ হয় সেই শব্দ আমার কানে আসলো।জানালার ওপাশ থেকে শব্দটা আসছে।আমি বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে যেতেই দেখি,একটা দোলনা আমার জানালা সোজা দুলছে।আর দোলনায় বসে আছে সেই মেয়েটা। যার সাথে আমার আজ রাতে দেখা হয়েছিলো।
আমার চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটা অদ্ভুত একটা হাসি দিলো।যেই হাসি আমার কানে বারবার বাজছিলো।
রিতুকে ডেকে দেখালে মেয়েটা ভয় পাবে।সেজন্য আমি তাকে ডাকলাম না।মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করার জন্য মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আবার জানালাতে তাকাতেই দেখি কোনোকিছু জানালার বাইরে নেই।তাহলে এত সময় আমি কি দেখলাম?এটা কি ভ্রম ছিলো?

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প