শহরের কোলাহল থেকে বহুদূরে, পুরনো এক জমিদার বাড়ির লাগোয়া বিশাল দিঘিটার ধারে ফটোগ্রাফার অর্পণ এসে দাঁড়িয়েছিল একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তার এবারের ছবির সিরিজটার বিষয় ছিল ‘অবক্ষয়ের সৌন্দর্য’—সময়ের আঘাতে জীর্ণ হয়ে যাওয়া স্থাপত্য আর তার বুকে জেগে থাকা প্রকৃতির ধীর, নিঃশব্দ জয়। স্থানীয়দের কাছে ‘শিকদার মঞ্জিল’ নামে পরিচিত এই পোড়ো বাড়িটা ছিল তার সেই সিরিজের নিখুঁত বিষয়।
অর্পণ যুক্তিবাদী ছেলে। ভূত বা অলৌকিক গল্প তার কাছে স্রেফ গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের মনগড়া কিচ্ছা। তাই যখন চায়ের দোকানের নিতাইদা তাকে বলেছিল, “অর্পণবাবু, দিনের বেলায় যান ভালো কথা, কিন্তু সন্ধ্যে নামার আগে ওদিক থেকে চলে আসবেন। ওই দিঘির জলে আর বাড়ির আনাচে-কানাচে শিকদার বাড়ির ছোট মেয়ের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। অনেকেই তার কান্নার শব্দ, নুপুরের আওয়াজ শুনেছে,” অর্পণ শুধু একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল।
প্রথম কয়েকদিন সব ঠিকই ছিল। অর্পণ তার ডিএসএলআর ক্যামেরায় একের পর এক অসাধারণ ছবি তুলছিল—ভাঙা খিলানের ফাঁক দিয়ে গলে আসা পড়ন্ত বিকেলের আলো, দেওয়ালের গা বেয়ে ওঠা বট-অশ্বত্থের ধিঙ্গি শিকড়, ধুলোমাখা নাচঘরের মেঝেতে জমে থাকা শুকনো পাতার স্তূপ। পরিবেশটা বিষণ্ণ, কিন্তু ভয়ের কিছু ছিল না।
সমস্যাটা শুরু হল চতুর্থ দিনে।
সেদিন অর্পণ দিঘির উল্টো পাড় থেকে ল্যান্ডস্কেপ শট নিচ্ছিল। লেন্সের ফোকাস অ্যাডজাস্ট করতে গিয়ে তার চোখ আটকে গেল দোতলার একটা ভাঙা জানলায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, শ্যাওলা-ধরা কার্নিশের ওপারে, অন্ধকারের ভেতর থেকে একজোড়া শিশুসুলভ উজ্জ্বল চোখ যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অর্পণ সাথে সাথেই ক্যামেরা নামিয়ে নিল। নাহ, কেউ নেই। সম্ভবত আলোর भ्रम বা তার ক্লান্ত চোখের বিভ্রম। সে নিজেকেই নিজে বোঝাল।
কিন্তু সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকেই একটা অস্বস্তি তাকে আঁকড়ে ধরল। রাতে এডিট করতে বসে সে জুম করে দেখল ছবিগুলো। নাহ, জানলায় কিচ্ছু নেই। শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার।
পরদিন সে আবার গেল শিকদার মঞ্জিলে, এবার আরও কাছ থেকে ছবি তোলার জন্য। ভাঙা সদর দরজাটা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তার নাকে লাগল। চারদিকে কবরের নিস্তব্ধতা। কিন্তু এই নিস্তব্ধতা জীবন্ত, যেন কিছু একটা কান পেতে আছে তার পদক্ষেপ শোনার জন্য।
একটা লম্বা করিডোর ধরে এগোতে গিয়ে অর্পণের পা আটকে গেল ঝুঁকে দেখল, ধুলোর মধ্যে অর্ধেক পুঁতে আছে একটা পুরনো, রুপোর নুপুর। কারুকার্য করা, কিন্তু কালচে হয়ে গেছে। অর্পণ সেটাকে তুলে রুমালে মুড়ে পকেটে রাখল। তার মনে হল, তার ‘অবক্ষয়ের সৌন্দর্য’ সিরিজের জন্য এটা একটা দারুণ বিষয় হতে পারে।
দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা ছিল ভয়ঙ্কর। অনেকগুলো ধাপ ভাঙা। সাবধানে পা ফেলে উপরে উঠে সে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরটা সম্ভবত কোনও শিশুর ছিল। দেওয়ালে রঙের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই, কিন্তু এক কোণে একটা ছোট কাঠের দোলনা এখনও দুলছে—খুব ধীরে, যেন অদৃশ্য কেউ একটু আগেই সেটাকে দুলিয়ে দিয়ে গেছে।
অর্পণের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। এবার আর এটাকে বিভ্রম বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বাতাস? কিন্তু এই বদ্ধ ঘরে এত বাতাস আসবে কোথা থেকে যে একটা ভারী কাঠের দোলনা দুলে উঠবে?
সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঘুরতেই, তার কানের পাশ দিয়ে একটা ফিসফিসানি শব্দ ভেসে গেল—”আমার নুপুর…”
গলার স্বরটা একটা ছোট মেয়ের, কিন্তু তার মধ্যে মিশে আছে বহু বছরের পুরনো এক গভীর আর্তি। অর্পণের হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে লাফিয়ে উঠল। সে প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। নামার সময় ভাঙা সিঁড়িতে পা মচকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কোনওমতে নিজেকে সামলে সে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এল বাড়িটা থেকে।
বাইরের আলোয় এসে তার ধাত ফিরল। পকেটে হাত দিয়ে সে অনুভব করল নুপুরটার শীতল স্পর্শ। তার মনে হল, এই জিনিসটাই যত নষ্টের গোড়া। এটাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আবার ওই বাড়িতে ঢোকার সাহস তার ছিল না।
সেদিন রাতে অর্পণ ঘুমাতে পারল না। বারবার তার মনে হতে লাগল, দোলনাটা এখনও দুলছে। আর সেই ফিসফিসে কণ্ঠস্বরটা তার কানের কাছে ক্রমাগত বলে চলেছে, “আমার নুপুর… ফিরিয়ে দাও…”
পরদিন সকালে সে সিদ্ধান্ত নিল, নুপুরটা দিঘির জলে ফেলে দিয়ে আসবে। ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই, বাইরে থেকেই কাজ সারবে।
কাঁটায় কাঁটায় দুপুর বারোটায় সে দিঘির পাড়ে পৌঁছল। চারদিকে গনগনে রোদ। এই ভর দুপুরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। অর্পণ পকেট থেকে নুপুরটা বের করে ছুঁড়ে ফেলতে যাবে, এমন সময় সে দিঘির স্থির জলে একটা প্রতিবিম্ব দেখল। তার নিজের প্রতিবিম্ব। কিন্তু কিছু একটা ঠিক নেই।
সে ভালো করে তাকাল। তার প্রতিবিম্বের পাশে, গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা আট-নয় বছরের মেয়ের ছায়া। পরনে পুরনো আমলের ফ্রক, পায়ে একপাটি নুপুর। মুখটা স্পষ্ট নয়, জলের ঢেউয়ে কেঁপে যাচ্ছে। কিন্তু তার শূন্য চোখদুটো যেন সরাসরি অর্পণের দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েটা ধীরে ধীরে তার হাতটা বাড়াচ্ছে অর্পণের দিকে, যেন তার পকেটে থাকা নুপুরটা চাইছে।
অর্পণের দম বন্ধ হয়ে এল। সে জলের দিকে তাকাতে পারছে না, আবার চোখ সরাতেও পারছে না। তার মনে হল, এই মেয়েটা শুধু ওই বাড়িতে বা দিঘির জলেই সীমাবদ্ধ নেই। সে এখন অর্পণের সঙ্গে জুড়ে গেছে, তার প্রতিবিম্বের একটা অংশ হয়ে গেছে।
হাত থেকে নুপুরটা খসে মাটিতে পড়ে গেল। একটা টুং শব্দ হল।
জলের প্রতিবিম্বে মেয়েটার মুখে এবার একটা ভয়ঙ্কর, বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল।
অর্পণ প্রাণপণে চিৎকার করে দৌড় শুরু করল। সে আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। সে জানে, তাকালেই দেখতে পাবে, তার প্রতিবিম্ব এখন আর একা নয়। সে জানে, এই স্মৃতি, এই ভয় এখন থেকে তার সারাজীবনের সঙ্গী। এখন সে যেখানেই যাবে, আয়নায় বা স্থির জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখার সময় প্রতিবার তার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাবে। কারণ সে জানে, তার পাশে সবসময় দাঁড়িয়ে থাকবে সেই অসম্পূর্ণ প্রতিবিম্ব, যার একপাটি নুপুর এখনও তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।