ফ্রান্সের লিওন শহরে বাস করতো অ্যালেনোর নামের এক অষ্টাদশী মেয়ে। অ্যালেনোর সাধারণত বড় হয় এক বৃদ্ধার কাছে। অ্যালেনোরের জন্মের পূর্বেই তার বাবা মি. অলিভারের মৃত্যু হয়। অ্যালেনোরের জন্মের তিন-চার বছরের মধ্যে তার মা সোফিয়া হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেই সময় থেকেই গ্রেন্ডমা তার দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন। গ্রেন্ডমা প্রচুর সম্পদের মালিক হলেও, এক পর্যায়ে এসে তিনি তার সম্পদ রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। অতঃপর অ্যালেনোরকে নিয়ে লিওন শহরে বসবাস শুরু করেন।
কিছুদিনের মধ্যে অ্যালেনোরের গ্র্যান্ডমার ব্লাড ক্লটিং হয়ে যায়, যার কারণে তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে এসে অনাহারে তাদের বহু দিন কেটে যায়। একদিন হঠাৎ করে কিছু সমাজসেবক আর সমাজসেবিকা বৃদ্ধার কাছে আসেন। তারা অ্যালেনোরের সকল দায়িত্ব বহন করার লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বৃদ্ধার চিকিৎসার দায়িত্বও নেন। বৃদ্ধাকে তারা দু’এক মাসের চিকিৎসার খরচ দিয়ে যান। অ্যালেনোরকে সাথে নিয়ে যায় এবং তার প্রিয় পুতুল লিসাকেও, যার মধ্যে অ্যালেনোর তার মা কে অনুভব করতো। পুতুলটা তার মায়ের’ই দেওয়া। মাকে ছোটবেলায় হারানোর ফলে মায়ের মুখটা অ্যালেনোরের এখন ঠিক স্পষ্ট মনে নেই।
অ্যালেনোর হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। নিস্তব্ধ হয়ে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রইলো পুতুলের দিকে।
**
নীরবতা ভঙ্গ করে মর্গের নাইট ওয়াচম্যান অ্যাডিসন অ্যালেনোরকে জিজ্ঞাসা করলো,
– “তারপর কি হলো অ্যালেনোর? কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তোমাকে?”
– “সমাজসেবক-সেবিকারা ছিলো মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রতারক। অসহায় ছেলে-মেয়েদের দিয়ে নিকৃষ্ট কাজ করিয়ে, এক পর্যায়ে তাদের হত্যা করে দেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নিয়ে বিক্রি করে প্রচুর মুদ্রা অর্জন করে থাকে।”
– “তোমাকে কিভাবে..?”
অ্যালেনোরের রক্ত ভেজা চোখ থেকে হঠাৎ অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। নাইট ওয়াচম্যানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
– “রাত দুইটা বেজে আঠারো মিনিট। বিদঘুটে অন্ধকার রুমে শুয়ে ছিলাম। একজন উদ্ভট লোক এসে হাত-পা, মুখ বেঁধে আমাকে নিয়ে যায় পুরোনো জিনিসপত্রে ঘেরা একটা স্টোর রুমে। রুমটা বেশ ভয়ংকর ছিলো! প্রায় ডজন খানেক কঙ্কাল ঝুলিয়ে রাখা ছিলো দেয়ালে। দেয়ালগুলো রক্তে মাখা আর কিছু পেইন্টিং করা অদ্ভুত রকমের। দেয়াল থেকে যেনো কারো করুণ চিৎকার ভেসে আসছিলো, কেউ যেনো আমায় বারবার বলছিলো ‘পালিয়ে যাও’। পুরো রুম পর্যবেক্ষণ করার জন্য সামনের দিকে এগোতেই হঠাৎ একজন লোক এসে আমার গলার ঠিক মাঝখানে অস্ত্রাঘাত করে। গলা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ে সম্পূর্ণ জামা ভিজে যায়। তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে জ্ঞানশূন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ি ফ্লোরে। কতজন লোক অস্ত্রের সাহায্যে আমার দেহ থেকে কিডনি, চোখ উঠিয়ে এবং আঙ্গুলগুলো কেটে নেয়। রক্তে রঞ্জিত হয় আমার পুরো বডি। সারা দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, যেনো কেউ বডি চিহ্নিত করতে না পারে! কিন্তু আমার গলায় থাকা লকেটটা তাদের চোখে পড়েনি, যেখানে খোদাই করে ইটালিক অক্ষরে আমার নাম লেখা ছিলো। পরদিন সকালে আমাকে দিয়ে যায় এই মর্গে।”
অ্যালেনোর চিৎকার করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে৷ তার আত্মচিৎকারে মর্গের লাশগুলো যেনো জীবিত হয়ে ড্রয়ার থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে! চারপাশের ড্রয়ার থেকে ভেসে আসতে থাকে করুণ স্বর!
অ্যাডিসনের চোখের পানিতে পোশাক ভিজে একাকার। দু’পায়ের মাঝখানে মাথা গুঁজে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে।
– “কি নৃশংস হত্যাকাণ্ড! একবারও তাদের পাষাণ হৃদয়ে মমতার উদ্ভব ঘটেনি? তাদের শাস্তি দেওয়ার কি কোনো উপায় নেই?”
– “অবশ্যই আছে! তাদের পাপের আস্তানার ঠিকানা আমার জানা। সেই ঠিকানা পুলিশের কাছে দিলেই তাদের সব অপকর্ম ধরা পড়বে।”
অ্যাডিসনের মধ্যে হঠাৎ এক প্রবল উৎসাহ জাগ্রত হলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো যে, এই অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে সে থামবে না।
পরদিনই অ্যালেনোরের কথা অনুযায়ী মুখোশধারী সমাজকর্মীদের ঠিকানা পৌঁছে দেওয়া হয় পুলিশ স্টেশনে। সব ডিটেইলস জানার পর অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করা হয়। অ্যালেনোরের প্রেতাত্মা অবশেষে মুক্তি পায়। এরপর থেকে মর্গে আর কোনো প্রকার অদ্ভুত ঘটনা ঘটেনি।
নাইট ওয়াচম্যান অ্যাডিসনের মনে সবসময় অ্যালেনোরের মৃত্যুর রহস্য জানার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিলো। মাঝরাতে একদিন তার ঘুম ভেঙে যায়, দুঃস্বপ্ন দেখে! স্বপ্নে তাকে অ্যালেনোর ডাকছে। কিছু একটা বলতে চায়। রক্তাক্ত অ্যালেনোর আর তার পুতুল লিসা তাকে আহ্বান করছে বারংবার। সে মনের তৃষ্ণা মেটাতে, মৃত্যুর রহস্য জানতে চলে যায় মর্গে। মর্গেই অ্যালেনোর তার মৃত্যুর রহস্য বলে অ্যাডিসনকে। অবশেষে অ্যাডিসনের সাহায্যেই অ্যালেনোরের আত্মা মুক্তি পায়। শাস্তি হয় কিছু নিকৃষ্ট অপরাধীদের।