১.মিতুটা এমনই ছিলো। বান্ধবী রুবাকে ভয় দেখাতে মাঝরাতে ওর রুমের বাইরে এসে জানালায় নক করতো ঠকঠক করে। তখন কেমন বিরক্তই না লাগতো রুবার। অথচ আজ খারাপ লাগছে। তিনদিন আগে মারা গেছে মিতু।
মাঝরাত। রুবা বাসায় একা। হঠাৎ, ঠকঠক শব্দ শুরু হলো ওর জানালায়।
মিতু নক করতো যেভাবে।
২. ধুপধাপ শব্দে ঘুম ভাঙলো তপুর। শব্দটা আসছে ওর ঘরে রাখা আলমারিটার ভেতর থেকে। যেন আলমারি ভেঙে কেউ বাইরে আসার চেষ্টা করছে। তপু ভয়ে অস্থির।
গতকাল রাতেই স্ত্রী মিরাকে খুন করে লাশটা আলমারির ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলো সে।
৩. তিনা লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। এরপর মোবাইল অন করে ম্যাসেজগুলো চেক করা শুরু করলো। আজ ওর জন্মদিন, একে একে সবার জন্মদিনের শুভেচ্ছাগুলো দেখে খুশিতে ভরে উঠলো মন। রিনুর ম্যাসেজটা ভালো মতো দেখতে পাশ ফিরলো সে। আর তখনই, উষ্ণ এক নিঃশ্বাসের স্পর্শ সে অনুভব করলো তার ঘাড়ের ওপর।
নিঃশ্বাসটা মানুষের।
তিনা আজ বাসায় একা।
৪. আমার রুম থেকে পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা দেখা যায়। প্রতিদিন মাঝরাতে সেই বাসার বাচ্চা ছেলেটির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার। বাচ্চাটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, খেলে, আবার মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে আমার জানালাটুকু ছোঁয়ার চেষ্টা করে। আমার খুব বিরক্ত লাগে। কেমন বাবা মা এরা, মাঝরাতে এমন একটা ছোট বাচ্চাকে বারান্দায় একা ছেড়ে দেয়?
আজ আর থাকতে না পেরে সে বাসার দারোয়ানের কাছে গিয়ে বললাম ব্যাপারটা। দারোয়ান অবাক হয়ে বললো, ‘কি বলেন স্যার? ওই ফ্ল্যাটটা তো আজ একমাস ধরে খালি পড়ে আছে। ফ্ল্যাটের সবাই গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেছেন।
ওই বাড়িতে কেউ নেই।’
৫. ‘এই বাসাটা খুব ভয়ংকর। কেউ যদি একটা রাত থাকতে পারেন এই বাসায়, তাহলে তাকে ভালো পুরস্কার দেয়া হবে।’
আমি হাত তুললাম, ‘আমি থাকবো।’
‘ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবেন এ বাসায়। এরপর আমরা এসে আপনার পুরস্কার দিয়ে যাবো।’
পরদিন সন্ধ্যায় আমার হাতে পুরস্কার দেওয়ার সময় সবাই জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাই, যে বাসাতে কেউ এক ঘন্টাও থাকতে পারে না, সে বাসায় পুরা একরাত থাকলেন কি করে?’
‘থাকলাম তো ভাই, কোনো সমস্যাই হয় নাই। আচ্ছা, এবার চলি।’
তাড়াতাড়ি পা চালালাম, এই এলাকা পার হতে হবে যতদ্রুত সম্ভব।
অন্তত বাসার ভেতরে যে আমার লাশটা পড়ে আছে, তা কেউ ধরতে পারার আগেই।
৬. মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম, জিতু ওর বিছানায় বসে বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে জাগতে দেখে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘দোস্ত, একটা কাঁথা দিবি, শীত করছে খুব।’
আমি কিছু না বলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লাম। সারারাত ভয়ে ঘুম এলো না আমার।
জিতু দুদিন আগে এক রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
৭. প্রতিদিন গভীর রাতে আপা আমার রুমে এসে আমাকে ঘুম থেকে জাগায়। এরপর আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে থাকে, ‘আমি তোকে খুন করবো, আমি তোকে খুন করবো।’
এরপর সে চুপচাপ তার নিজের রুমে চলে যায়। আমি ভয়ে মরে গেলেও একথা কাউকে বলতে পারি না। কারণ, কেউ বিশ্বাস করবে না।
জন্মের পর থেকেই আপা কথা বলতে পারে না।
৮. কবির ভাই বলতে লাগলেন, ‘বুঝলা, আমি মর্গের কেয়ারটেকার ছিলাম। সারারাত মর্গে আমাকে একা থাকা লাগতো। আমার কিন্তু খারাপ লাগতো না। রাত একটু বেশি হলেই ট্রের উপর বসাতাম লাশগুলোকে। এরপর গল্প করতাম ওদের সাথে। নানারকম গল্প, গোপন গল্প, সুখ-দুঃখের গল্প। ভয় লাগতো না আমার, কারণ জানতাম এদের প্রাণ নেই। উল্টো মনের গোপন কথাগুলো এদের বলে হালকা লাগতো আমার। জিন্দা মানুষকে গোপন কথা বললে তা ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে, মুর্দা মানুষের কাছে এই ভয় নাই।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন কেন?’
কবির ভাই ভয় পাওয়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সেই রাতে একটা লাশ আমার কথার জবাব দিয়েছিলো….’
৯. আমার একটা অভ্যাস ছিলো, মাঝরাতে না ঘুমিয়ে ঘরের অন্ধকার কোণটার দিকে তাকিয়ে থাকা। ওরকম অন্ধকারে তাকিয়ে অনেক কিছু ভাবতাম আমি, অতীতের কথা, ভবিষ্যতের কথা, আমার না পাওয়ার কষ্টগুলোর কথা। রিমির কথা।
কিন্তু, এখন আর ওভাবে অন্ধকারে তাকাই না।
কারণ, সে রাতে বুঝতে পেরেছিলাম, অন্ধকার কোণটা থেকেও কেউ একজন তাকিয়ে আছে আমার দিকে।