গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় মাটির ছোট্ট একটা ঘরে বাস করেন রহিম মিয়া। বয়স ত্রিশের কোঠায়, পেশায় দিনমজুর। মাটি কাটে, হালচাষ করে, যেখানে যা কাজ মেলে। সংসারে তার একমাত্র স্ত্রী জামিলা আর ছয় বছরের ছেলে সায়েম। অভাব যেন ছায়ার মতো লেগে থাকে তাদের ঘরে, কিন্তু মন ছিল পরিপূর্ণ ঈমানে ভরা।
রহিম মিয়ার একটা স্বপ্ন ছিল, জীবনে একবার হলেও কোরবানি দেবে। বড় কিছু না, শুধু একটা খাসি হলেও চলবে। তবে সেটা নিজের উপার্জনে কেনা, হালাল উপায়ে অর্জিত হোক, এইটাই তার শর্ত।
বছরের পর বছর যায়, কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হয় না। কোরবানির সময় এলে প্রতিবারই টাকাটা খরচ হয়ে যায় ছেলের চিকিৎসা, চাল-তেল, বা ঘরের দরকারি কোনো কিছুতে।
এবার ইদের এক মাস আগে থেকেই রহিম মিয়া একটু একটু করে টাকা জমাতে লাগল। কাঁচাবাজারে বাড়তি কাজ করল, মজুরিতে জমি চষল, এমনকি নিজের একটা পুরোনো মোটা গাছও বিক্রি করে দিল চুপচাপ।
অবশেষে, ঈদের ঠিক দশ দিন আগে সে কিনে আনল একটা ছোট্ট দেশি গরু। রঙ কালচে, চোখে আশ্চর্যরকম শান্ত চাহনি। সায়েম গরু দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল। জামিলা গরুর নাম রাখল, সবুর। কারণ গরুটি যেমন ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনি তার স্বামীও জীবনের প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাতে ধৈর্য ধরে টিকে আছে।
গ্রামে যারা গরু এনেছে, তাদেরটা সব বড় বড়, অনেক দামি। কেউ কেউ রহিম মিয়ার সবুরকে দেখে হাসাহাসি করল,
“এইটারে গরু কয়? খাসির চেয়েও ছোট মনে হয়!”
রহিম কিছু বলল না, মুখে শুধু হালকা হাসি।
ইদের দিন, নামাজ শেষে ফিরে এসে গরুর পাশে বসে চোখ মুছল সে। মাথা নিচু করে বলল,
“হে আল্লাহ, আপনি জানেন আমি কত কষ্ট করে এটা জোগাড় করেছি। এটা হয়তো আকারে ছোট, কিন্তু ইচ্ছায় তো বড়ই ছিল…”
সবুর কোরবানি হলো। মাংস বেশি হয়নি, তবু রহিম মিয়া তিনভাগ করল নিয়ম মেনে একভাগ দিল প্রতিবেশী বিধবা রহিমা বুড়িকে, একভাগ রাখল নিজেদের জন্য, আর একভাগ তুলে দিল মসজিদের সামনে বসে থাকা এক ভিক্ষুকের হাতে।
ইদের দিন বিকেলে মসজিদের ইমাম সাহেব খুতবার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন,
“আল্লাহ কোরবানির মাংস বা রক্ত চান না। তিনি চান তোমাদের নিয়ত, তোমাদের তাকওয়া।”
এই কথা শুনে রহিম মিয়া চুপচাপ মুচকি হাসল। পাশে বসে থাকা ছোট্ট সায়েম জিজ্ঞেস করল,
“আব্বা, সবুর কি জান্নাতে যাবে?”
রহিম মিয়া বলল,
“হ্যাঁ বাবা, সবুর তো খুব ধৈর্য ধরত। আর ধৈর্যওয়ালারা আল্লাহর খুব প্রিয়।”