জীবনের_গল্প পর্ব০১

যেদিন নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম বয়ফ্রেন্ড এর সাথে পালিয়ে যাবো বলে। সেদিন আমার বয়ফ্রেন্ড শূন্য হাতে বাসা থেকে বের হয়েছিল। সেদিন আমি কিছু বলতে পারিনি। শুধু নীরবে কিছুক্ষণ তাঁর দিকে এক বুক মায়াভরা মমতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। “তারপর বলেছিলাম চিন্তা করো না কিছু না কিছু হয়ে যাবে। আমি যা পেরেছি এনেছি,কয়েকমাস চলতে পারবো।” কারণ আমি জানতাম ওর পরিবার সম্পর্কে, ওর অার্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। তাই হয়তো বাসা থেকে খালি হাতে বের হয়েছে।
আমি যখন বাবার বালিশের নিচ থেকে আলমারির চাবিটা নিলাম তখন বাবা আর মা ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুমন্ত অবস্থায় তাদেরকে অনেক নিষ্পাপ দেখাচ্ছিল। এমনিতেও তারা আমার কাছে নিষ্পাপ। আমি জানতাম আলমারিতে টাকা আছে। কালকে বাবা বেতন পেয়েছেন। বাবা সাধারণত দুই তিনমাস পর পর বেতন উঠান। আলমারি খুলে যখন টাকাগুলো হাতে নিলাম তখন খুব খারাপ লাগছিলো আমার। যে বাবা মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন,বিশটি বছর ধরে ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন। কখনো কষ্ট পেতে দেয়নি। সেই বাবা মা নামক বট গাছ গুলোকে ছেড়ে যাচ্ছি। কিন্তু যাকে ভালোবাসি তাকে ছাড়াও থাকতে পারবো না। বাবা কখনো আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবেন না সেটা আমি জানি। প্রতিটা বাবাই চায় মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে। আমার বাবাও তার ব্যতিক্রম নয়। আমি চলে যাওয়ার পর কি হবে? হয়তো দুএকদিন বাবা মা কাঁদবে,ছোট ভাইটা তো আমাকে ছাড়া কোনোদিন ঘুমাতো না। ও কি আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারবে? হয়তো আস্তে আস্তে শিখে যাবে। ভুলে যাবে তাঁর একটা বোন ছিলো,যে তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
বাসা থেকে চলে আসার সময় একটা চিঠি লিখতে খুব ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু শতো চেষ্টা করেও কোনো কিছু লিখতে পারলাম না। শুধু ছোট্ট করে একটা কাগজে দুইটা লাইন লিখলাম।
“যদি পারো আমাকে ক্ষমা করো দিও। ভুলে যেও তোমাদের একটা মেয়ে ছিলো। খুব বাজে একটা মেয়ে ছিলো,শুধু নিজের কথায় ভেবেছে সবসময়,নিজের সুখটাকেই বড় করে দেখেছে। যে নিজের ভালোবাসার জন্য নিজের আপনজনদের কে ছেড়ে চলে গিয়েছে। খারাপ মেয়ে মনে করে আমার জন্য তোমাদের চোখের পবিত্র জল মাটিতে ফেলো না। আজ থেকে ভেবে নিও সাদিয়া নামের মেয়েটি মারা গেছে। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না। ভালো থেকো তোমরা।
ভোর পাঁচটার সময় সাদাফকে দেখলাম একটা গাছের নিচে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানতাম ও আমার আগে এসে অপেক্ষা করবে। রিলেশন থাকা অবস্থায় যতোবার আমি ওর সাথে দেখা করেছি ততোবারই সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কোনো কোনোদিন এক দুই ঘন্টাও আমার দেরি হয়েছে। কিন্তু কোনোদিন সে আমার ওপর একটু রাগ কিংবা অভিমান করেনি। মুখ ফুটে কখনো বলেও নি আজ এতো দেরি হলো কেনো?
যদি আমি বলতাম,
“আমি তোমাকে অনেক অপেক্ষা করাই,আমার জন্য তোমাকে এই ডিম সিদ্ধ হওয়ার মতো গরমের মধ্যেও মিনিটের পর মিনিট ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তোমার খারাপ লাগে না? আমার ওপর রাগ হয় না? প্রতিদিন আমিই দেরি করে আসি। তুমি কখনো দেরি করো না। এটা নিয়ে তোমার কোনো অভিযোগ নেই কেনো?”
তখন সে আমার হাতে হাতে রেখে পৃৃথিবীর বিশুদ্ধতম ভালোবাসাটা নিয়ে বলতো,
“জানো আমার কাছে আমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় মুহূর্তটা কোনটা? আনন্দময় সময় কোনটা?
আমি যখন তোমার জন্য অপেক্ষা করি সেই সময়টাকে আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান মনে হয়, অনেক দামি মনে হয়। কারণ আমি এমন একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা করি যে আমাকে তাঁর নিজের জীবনের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসে। আমি জানি এক দুই ঘন্টা আমি রোদের মধ্যে পুড়ে গেলেও কিছুক্ষণ পর তুমি এসে তোমার শাড়ির আচল দিয়ে পৃথিবী সমতুল্য ভালোবাসা নিয়ে আমার ক্লান্তি দূর করবে।
এখন বলো আমি কি আমার জান পাখিটার জন্য একটু সময় অপেক্ষা করবো না?”
তখন আমি কিছু বলতাম না। কোনো কিছু না বলে শুধু সাদাফের বুকে মুখ লুকাতাম। সুখের কান্না করতাম। তখন সাদাফ আমাকে শক্ত করে তাঁর বুকে জড়িয়ে নিতো। তখন আমার মনে হতো এই মানুষটার বুকেই বুঝি আমার সমস্ত সুখ নিহিত। আমিও সাদাফকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরতাম।
সাদাফ তখন বলতো, এই কি করছো? ছাড়ো। সবাই দেখছে তো।
আমি তখন তাকে ছাড়তাম না। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।
একটু দেরি হয়ে গেলো। তুমি কখন এসেছো?
– চারটার সময়।
– তোমার ফোন কয়েকটা দিন বন্ধ ছিলো। অনেক ট্রাই করেছি। কিন্তু তোমাকে পাইনি। ভেবেছিলাম হয়তো তুমি আমার সাথে যেতে ভয় পাচ্ছো।
– একটু সমস্যা ছিলো। ভয় পাবো কেনো? আমি তোমার সাথে মৃত্যুর দুয়ারেও যেতে পারি।
– সেটা আমি জানি। এখন বলো কি সমস্যা হয়েছিলো। বাসার সবাই ভালো আছে তো?
– তেমন কোনো সমস্যা না। চলো সামনে বসার মতো একটা জায়গা আছে। ওখানে বসি। বাস আসতে ছয়টা বাজবে, আরো ত্রিশ মিনিটের মতো।
সাদাফের কথা মতো সামনের বেঞ্চিটাতে বসলাম। ছয়টার কিছুক্ষণ আগেই বাস চলে আসলো।
সাদাফের অনার্স শেষ হয়েছে। ঢাকায় গিয়ে ছোট্ট একটা চাকরি করবে,আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে। এই অাশাতেই অনিশ্চিত জীবনে পাড়ি জমিয়েছি আমরা।
ঢাকায় গিয়ে বাসা খুঁজতে অনেক ঝামেলা হলো আমাদের। কম টাকায় বাসা পাওয়া খুব টাফ। তবুও সাদাফের একটা বন্ধু ছিলো যার সাহায্যে আমরা অনেক কমেই একটা বাসা পেয়ে যাই। সাদাফের বন্ধু আমাদের অনেক হেল্প করেছিলো যেটা কোনোদিন ভুলবো না আমি।
সকালে সাদাফ বেরিয়ে যেতো চাকরি খোঁজার জন্য। আর আমি বাসায় টুকটাক সংসারটা গুছানোর চেষ্টা করতাম। যদিও আমরা বিয়ে করিনি। তবুও আমরা এক ফ্লাটে থাকতাম। আমার অনুমতি ছাড়া সাদাফ আমাকে ছুঁয়েও দেখবে না সেটা আমি জানতাম। সেই বিশ্বাসেই তো নিজের আপন মানুষগুলো ছেড়ে তাঁর সাথে চলে এসেছি। আমি জানি সাদাফ আমার বিশ্বাসে কোনোদিন একটু আঁচড় পড়তে দিবে না। আমিই মাঝে মাঝে অনেক আবেগী হয়ে যেতাম,সাদাফকে জড়িয়ে ধরে নোংরা ভালোবাসায় হারিয়ে যেতে চাইতাম। কিন্তু সাদাফ কখনো আমার দুর্বলতার সুযোগ নেয় নি। সাদাফকে আমি অতো কাছে পেয়ে,নিবিড় করে পেয়ে,স্বাধীনভাবে পেয়ে আমার চিত্ত চঞ্চল হয়ে যেতো। শিরার মধ্যে দিয়ে উত্তেজনার বন্যা বয়ে যেতো,ন্যায় অন্যায়ের সূক্ষ্ম বিচার বুদ্ধিও কখনো কখনো হারিয়ে যেতো। কিন্তু তবুও শান্ত স্নিগ্ধ ভালোবাসার ছোঁয়ায় ও আমাকে সংযত রেখেছে। ওর এই জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি ওকে শ্রদ্ধা করতাম।
যে বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকি সেখানে একটা মেয়ে থাকতো। তাঁর নাম জাহানারা। বাড়িওয়ালার মেয়ে। তাঁর সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। যখন একা একা থাকি তখন সে সময় পেলেই আমার সাথে গল্প করে। আমি তাকে আমার ভালোবাসার কথা বলি,সাদাফের কথা বলি। সে মুগ্ধ হয়ে আমাদের ভালোবাসার কথা শুনে।
কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম টাকা শেষের দিকে। যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম ভেবেছিলাম দুই তিনমাস অনায়াসে চলে যাবে। কিন্তু যখন দেখলাম টাকা প্রায় শেষের দিকে তখন চিন্তার বাজ এসে নামলো মাথার ওপর। সাদাফেরও চাকরি হচ্ছে না। টাকাও শেষের দিকে। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম অনার্সে ভর্তি হবো। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না।
রাতে যখন সাদাফকে বললাম,ঘরে আর মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আছে। তখন সাদাফের সুন্দর মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে গেলো। সেও তো কম চেষ্টা করছে না একটা চাকরির জন্য কিন্তু হচ্ছে না। সাদাফ কিছু বলল না। “শুধু বলল চিন্তা করো না আমি তো আছি।”
দশদিন পর যখন টাকা একেবারেই শেষ তখন সাদাফ আমাকে একা ফেলে চলে আসলো। সাদাফের লেখা চিঠিটা যখন দেখলাম তখনও আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। যে ছেলেটা আমাকে এতো ভালোবাসতো সেই ছেলেটাই আমাকে চরম বিপদের মুখে ফেলে এভাবে চলে যাবে এটা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি আমি।
কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি। যে মানুষটাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে নিজের পরিবারের মানুষগুলো ছেড়ে চলে আসলাম সেই মানুষটাই আমাকে ধোকা দিলো। একটা মেয়ে হয়ে এই অপরিচিত অজানা অচেনা শহরে কি করবো আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। সাদাফের চিঠিটা যখন বার বার পড়ছিলাম তখন দুচোখ বেয়ে শুধু বৃষ্টির ফোটার মতো টপ টপ করে পানি বেয়ে পড়ছিলো।
নিজেই নিজের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।
কেনো এমন করলো সাদাফ আমার সাথে?

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প