গাড়িটা যখন আমার শ্বশুরবাড়ির গেটের সামনে থামল তখন রাত একটা বাজে। সেই বিকাল চারটায় রওনা করেছিলাম। মাঝখানে একটা হোটেলে থেমেছিলাম দশ মিনিটের জন্য। আটটায় হোটেল থেকে আবার গাড়িতে উঠে আমি ঘুম দিয়েছি। কাটা কাটা ঘুম হয়েছে। মাঝখানে ভেঙেছে।
আমার বড় জা খোঁচা মেরে জাগিয়ে দিলেন- নতুন বৌ! আমরা পৌঁছে গেছি!
ঘুম ভেঙে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ঘুম পুরোপুরি চটে গেল! এ তো পুরো রাজপ্রাসাদ! এরা তো সত্যিই জমিদার দেখছি!
অনামিকা, আমার জায়ের মেয়ে বলল- চাচী কেমন লাগছে?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলেই ফেললাম – এটা তো সত্যি জমিদার বাড়ি!
ও খিলখিল করে হেসে বলে- তুমি কি মিথ্যা ভেবেছিলে? জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু আমরা এই গ্রামের জমিদার রয়েই গেছি!
লোহার বড় গেটটা খুলে দিলে ভেতরে আরও অনেক দূর গাড়ি দিয়ে যেতে হল।
অনামিকা সব দেখাচ্ছিল- এদিক দিয়ে বাগান। বাগান দিয়ে আরও সামনে হাঁটলে পুকুরঘাট। আরও কিছুদূর পর আরেকটা পুকুর। ওখানে মাছের চাষ হয়। তোমাকে সব আগামীকাল দেখাব।
আর একটু আগাতেই দেখি বাড়ির সিংহ দরজার সামনে প্রাচীনকালের সৌখিন বাবুদের বাড়ির মত দুইপাশে দুইটা শ্বেত পাথরের সিংহ! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি! আমাদের গাড়ির সাথে সাথে পেছনের আরো দুইটা গাড়িও পৌঁছে গেছে। সেই গাড়িতে আমার বর এবং ভাসুর আছেন। সাথে আরো কে কে যেন আছে। আমি জানি না। চিনিও না। আমি এখন পর্যন্ত আমার বরকেই দেখিনি। রাগ করেই দেখিনি। বাবার সাথে রাগ করে এই বিয়ে করেছি। সে অনেক লম্বা ইতিহাস।
গেটের সামনে গাড়ি থামলে আমাকে নামানো হল। সব জিনিসপত্র নামানো হচ্ছে। গেট খোলা দেখলাম। গেটের সামনে একজন মহিলাকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ইনি-ই বোধহয় আমার শ্বাশুড়ি।
আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভাবী বলল- সালাম করো নতুন বৌ। আমাদের মা।
কি ‘নতুন বৌ নতুন বৌ’ লাগিয়ে রেখেছে! মেজাজ খারাপ লাগছে!
শ্বাশুড়ি মা বললেন – আগেই নয়। সজীব আসুক।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কাউকে আমার পাশে তাড়াতাড়ি করে আসতে টের পেলাম। বুঝতে পারলাম আমার বরের নাম সজীব। সেই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভাবী ইশারা করলে শ্বাশুড়ি মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। নিজের হাত থেকে দুটো ভারী চুড়ি খুলে হাতে পরিয়ে দিলেন।
আমার মনে হচ্ছে আমি কোন প্রাচীন সিনেমার সেটে চলে এসেছি। অথবা কোন গল্পের বইয়ের পাতায় হারিয়ে গেছি!
– ভেতরে এসো তোমরা।
আমাদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসানো হল। এই বাড়ি দেখে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। এত বড় বাড়িতে মানুষ হারিয়ে যায় না? প্রাচীনকালের বাড়ির মত বড় ঝাড়বাতিও আছে। ওপরে ওঠার জন্য প্যাঁচানো সিঁড়ি। আর হ্যাঁ ড্রয়িংরুমের ওয়ালে পূর্বপুরুষদের ওয়েল পেইন্টিংও করা আছে। আগেরদিনের জলসা ঘরের মত ড্রয়িংরুমের মাটিতে বিছানা পাতা! অবশ্য সাথে আরামদায়ক সোফাও আছে। আগেকার এবং বর্তমানকালের সংমিশ্রণে এই বাড়ি সাজানো!
আশেপাশে অনেক মানুষজনকে দেখতে পাচ্ছি। এরা কারা কিছুই জানি না। অনামিকাকেও দেখতে পাচ্ছি না যে জিজ্ঞেস করব। আমার পাশের মানুষটিকে তো জিজ্ঞেস করবই না! সেও তো একবারও আমার সাথে কথা বলেনি। এমন সময় ফিসফিস শুনলাম। গিন্নীমা আসছেন, গিন্নীমা আসছেন!
আমার পাশের মানুষটি এই প্রথম আমাকে বলল- উঠে দাঁড়াও। গিন্নীমা আসছেন।
গিন্নী-মা কে এবং কেন তিনি আসলে আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে সেটা জানার জন্য তার দিকে তাকালাম। এই প্রথমবার।
তাকিয়ে আমার মনটা বিষাদে ভরে গেল! এরকম বুড়ো একটা লোকের সাথে বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিল? এমন কি দায়বদ্ধতা ছিল আমার বাবার? এর সাথেই বিয়ে দিতে হল? এর বয়স কম করে হলেও ফোরটি প্লাস! লোকটার বড় বড় গোঁফ আছে। আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। দেখতে খুবই বিশ্রী লাগছে। তাকে দেখে আমার কোন কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ঘুচে গেল!
এমন সময় হঠাৎই দেখলাম সে এগিয়ে গেল। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে আমি গিন্নী-মা কে দেখতে পেলাম। গিন্নী-মা কে দেখে আমি প্রচন্ডরকম অবাক হলাম! কম বয়সে উনি যে সবার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মত সুন্দরী ছিলেন সেটা একটা ছোট বাচ্চাও বলে দিতে পারে! এবং এখনো বয়স অনুযায়ী তিনি তার সৌন্দর্য ধরে রেখেছেন। একেবারে দুধে-আলতা গায়ের রঙ যে আসলেই আছে গিন্নী-মা কে না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না! তিনি এখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চামড়া বয়সের ভাড়ে কুঁচকেছে কিন্তু সেটা তার সৌন্দর্য মলিন করতে পারেনি! একটা সরিষা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছেন। হাত, কান, গলা খালি নেই। গয়না দিয়ে ঢাকা। এত সুন্দর কেউ সত্যিই হতে পারে!
আমার পাশের মানুষটি গিন্নী-মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল বুঝতে পারলাম। এই বাসার রীতি মনে হয় বর-কণের একত্রে সালাম করা।
আমার শ্বাশুড়ি মাকে দেখলাম আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করছেন সামনে যেতে।
গিন্নী-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সজীব সাহেবের সাথে একসাথে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। গিন্নী-মা সালাম নিলেন।
এরপর আমার থুতনি উঁচু করে ধরে বললেন – বাবার চেহারার সাথে মিল আছে। দেখতে সুন্দর হয়েছ।
আমি কি উত্তর দেব বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
গিন্নী-মার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই বাড়ির কর্তৃত্ব তার হাতে।
উনি এবার জিজ্ঞেস করলেন- মুখে হাসি নেই কেন? নতুন বউয়ের মুখ থাকবে হাসি হাসি!
মনে মনে বললাম- হাসি মাই ফুট! মতের বিরুদ্ধে একটা বুড়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে! আবার হাসি!
শ্বাশুড়ি মা বললেন – অনেকক্ষণ জার্নি করে এসেছে তো তাই মনে হয়। মা ওরা তাহলে ঘরে যাক?
এতক্ষণে পরিষ্কার হল। এই গিন্নীমা হলেন সজীব সাহেবদের দাদী। দাদীকে মানুষ গিন্নীমা বলে জন্মে শুনিনি! এ কি সিনেমার প্লটে আমার বিয়ে হয়ে গেল!
গিন্নীমা বললেন – যাবে তো তার আগে একটু মিষ্টিমুখ করুক। আর নতুন বৌয়ের মুখ থেকে তো একটা শব্দও শুনলাম না। কিছু বল নতুন বৌ!
কি আজব রে বাবা! কি বলব?
ভাবী বলল- নিজের নামটা বল।
কিন্তু আমি সেটা না বলে বললাম- আসসালামু আলাইকুম। আপনি কেমন আছেন গিন্নীমা?
আমার প্রশ্ন শুনে তার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে!
– তোমার বুদ্ধি আছে নতুন বৌ! বস। মিষ্টি এসেছে?
– জ্বি মা এসেছে।
গিন্নীমা বলার সাথে সাথেই যে আশেপাশে ছুটোছুটি করে মানুষজন মিষ্টি নিয়ে এল সেটাও দেখলাম।
গিন্নীমা আমাকে মিষ্টি দিলেন। মিষ্টি আমার দু’চোখের বিষ।
কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।
বিরস মুখে রসযুক্ত মিষ্টি এক কামড় নিলাম।
এরপর দেখলাম আমার শ্বাশুড়িমাও আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে এলেন।
তিনি হঠাৎই আমাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন- মিষ্টি খেতে ভাল লাগে না বুঝি?
আমি মাথা নাড়লাম।
– একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও মা। অল্প করে খাও। নতুন বৌ কে মিষ্টি খাওয়ানো এই বাড়ির নিয়ম।
এরপর ভাইয়া আর ভাবীর মিষ্টি খাওয়ানোর পালা শেষ হলে যখন ভাবলাম এইবার শান্তি তখনই গিন্নীমা সজীব সাহেবকে ডাকলেন।
-নতুন বৌকে মিষ্টি খাওয়াও।
সজীব সাহেব মিষ্টি খাওয়ানোর সময় তার মুখের দিকে আরেকবার তাকালাম! আমার চোখ ফেটে কান্না আসতে লাগল! আমি এটা কাকে বিয়ে করে কোথায় চলে এলাম। একটা মানুষ নেই মন খুলে কথা বলার! আমি মনে হয় দম আটকেই মরে যাব! বাবা আমার বৌভাতে এলে আমি চলে যাব এবং আর আসব না। এরা এই গ্রামের জমিদার হতে পারে কিন্তু আমার জীবনের নয়। বাবা এবার আবার আমাকে প্রেশার দিলে আমি পালিয়ে যাব! তুষারকে বললে সে তক্ষুনি আমাকে নিয়ে কাজী অফিস যাবে! তার আগে অবশ্য একে ডিভোর্স দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে!
এসব ভাবতে ভাবতে অন্যদিকে তাকিয়ে মিষ্টি নিলাম। এই বুড়ো দাদুর দিকে তাকিয়ে অসহ্যবোধ করার কোন মানে হয় না। আমি শুধুমাত্র বৌভাত পর্যন্ত ওয়েট করব! ব্যাস!
গিন্নীমা এবার এগিয়ে এসে নিজের একগাদা গহনার মধ্যে থেকে একটা লম্বা চেন খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিলেন।
– তুমি আসবে বলে আজ এই চেনটা পরেছি। সজীবের বউয়ের জন্য রেখেছিলাম।
– থ্যাঙ্কিউ।
বলে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল ভুল করে ফেলেছি।
আমার শ্বাশুড়ি তাড়াতাড়ি বললেন – আমি সব বলে দেব মা। নতুন তো তাই জানে না। শিখে যাবে।
ভাবীও বললেন – হ্যাঁ সেটাই।
গিন্নীমা এবার ভাবীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – তোমার কন্যা কোথায়?
ভাবী মাটির দিকে তাকিয়ে বলে- ঘরে চলে গেছে। টায়ার্ড ছিল তো..
– ছোট মানুষ। এত অল্পে টায়ার্ড কেন হবে? নতুন চাচী এসেছে তাকে বলবে সবসময় চাচীর সাথে সাথে থাকতে!
– জ্বি আচ্ছা!
গিন্নীমাকে সবাই কেন এত ভয় পায় আমি একটু একটু বুঝতে পারছি। এত বলিষ্ঠ তার ব্যক্তিত্ব! প্রতিটা কথায় আদেশের সুর!
তবে এই ধরনের মানুষ আমার পছন্দ নয়। আদর করে কথা বললেই শুনতে মিষ্টি লাগে যেমন আমার শ্বাশুড়িমা। ভদ্র মহিলাটি আসার পর থেকেই মনে গেঁথে গেছেন!
– ওকে ঘরে নিয়ে যাও। শিহাব আর সজীব তোমরা দুইজন আমার ঘরে এসো। বৌভাতের বিষয়ে আলোচনা আছে। নতুন বৌ কে ঘরে পৌঁছে বৌমা তুমিও এসো। আর আপনি যেয়ে আপনার কন্যাকে বলেন।
একে একে সবাইকে আদেশ দিয়ে গিন্নীমা প্রস্থান করলেন। গিন্নীমা যেতেই ভাইয়া ভাবীর মুখের দিকে তাকালেন। ভাবীকে কেমন ছাইরঙা হয়ে যেতে দেখলাম!
– এসো মা!
আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম। এত টায়ার্ড লাগছে। এতক্ষণ সবকিছু নিয়ে প্রচন্ড উত্তেজিত ছিলাম বলে কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হাত-পা ভেঙে পড়ে থাকি! আমার বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হয়েছে তার মানে এই নয় যে কোন সাজসজ্জা ছিল না! ভারী শাড়ি, গয়না পরে একেবারে সঙ সেজে আছি! সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় গেলাম। সারি সারি ঘর! এরমধ্যেই কোন ঘরের দরজা খুলে আমাকে তারা ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে ঢুকে আরাম লাগল। এসি দিয়ে ঘরটা ঠান্ডা করে রাখা হয়েছে। তবে পুরো ঘর ফুল দিয়ে সাজানো। ফুলের গন্ধে ম’ ম’ করছে!
আমি শ্বাশুড়িকে বললাম – আমার ব্যাগটা আন্টি!
শ্বাশুড়িমা অবাক হয়ে বললেন – আন্টি? আমাকে মা বলতে কি খুব কষ্ট হবে?
ও হ্যাঁ! উনি তো আমার শ্বাশুড়ি! উনাকে তো ‘মা’ সম্বোধন করতে হবে। এটা মনে হতেই আবার বিতৃষ্ণা জন্মে গেল! ইশশ! ওই লোকটা!
আমি বললাম – না অসুবিধা হবে না। মাথায় ছিল না!
আমার উত্তর শুনে ভাবী আর মা দুইজনেই হেসে দিলেন!
– তোমার স্যুটকেস পাঠিয়ে দিচ্ছি মা। তুমি চেঞ্জ করে রেস্ট নাও। সকালে আবার উঠতে হবে।
মনে মনে বললাম- সকালে দশটার আগে আমি উঠছি না।
ওনারা চলে গেলেন। আমি গিয়ে ওয়াশরুমে উঁকি দিয়ে এলাম। বাথরুমটা আধুনিক কায়দার দেখে ভাল লাগল!
একজন দরজা নক করল। গেট খুলে দেখি একটা মেয়ে আর অনামিকা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির হাতে আমার স্যুটকেস।
মেয়েটি ব্যাগটা ভেতরে রেখে বলে- আমার নাম রানু বৌমনি। দরকার লাগলে বইলেন।
অনামিকা ঢুকে বলে- চাচী তুমি চেঞ্জ করে নাও। আমি ওয়েট করি।
‘চাচী’ ডাকটা শুনেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল! তবুও কিছু বললাম না।
আমি এই ভারী শাড়ি বদলে একটা সুতির সালোয়ার কামিজ পরে নিলাম। গয়নাগাটি আর চুল খুলতে অনামিকা সাহায্য করল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে অনামিকা?
অনামিকা বিরক্তির সুরে বলে- ঘরে ঢুকে গিয়েছিলাম। আমি পারতোপক্ষে গিন্নীমার সামনে পড়ি না! আজব এক মহিলা। সারাক্ষণ ক্যাটরম্যাটর ধূর, কিন্তু এতেও আমার দোষ হয়েছে! মাকে তো কি আবোলতাবোল বলেছে!
আমি পুরোপুরি ফ্রেশ হয়ে গেলে অনামিকা হাই তুলে বলে- চাচী তুমি তাহলে ঘুমিয়ে পর। আগামীকাল তোমাকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাব। রাতে কিছু দরকার লাগলে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে রানু বলে ডাকলেই ও আসবে। ওর ঘুম খুব পাতলা। বাসার সহকারীরা নিচে আলাদা থাকলেও শুধুমাত্র রানুরই ওপরে থাকার পারমিশন আছে। আর চাচা তো আসবেই। একা একা বের হয়ে এদিক সেদিক যেও না। রাতে রুমের বাইরে যেতে হলে চাচাকে বলো।
আমি অসহ্য হয়ে গেলাম ওই লোকটার কথা মনে হয়ে।
জিজ্ঞেস করলাম- কেন? একা বের হলে কি হবে?
– এই বাড়িতে সব জায়গায় একা একা যাওয়া যায় না। যাই হোক রাতে আর এসব বলতে চাই না। আগামীকাল সব বুঝিয়ে বলব!
অনামিকা চলে গেলে আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে রইলাম! এ কি আজব কথা! রাতে এইকথা বলবে না মানে কি? ভূতপ্রেতের ব্যাপার? এই যুগেও এসব কেউ বিশ্বাস করে! হাউ ফানি!
আমি এবার শুয়ে পড়লাম। এখন খুব কষ্ট হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে। বাবার ওপর অভিমান হচ্ছে। এমন একটা লোকের সাথে, এমন একটা অদ্ভুত বাসায় বাবা আমাকে বিয়ে দিলেন। গিন্নীমাকে আমি কিছুতেই ভাল ভাবতে পারছি না! ভাবী ভাল হলেও আমার এত আন্তরিক লাগেনি! কি জানি! এটাই হয়তো আন্তরিকতা উনার! কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি জানি না। হঠাৎই নিজের পাশে একটা খচরমচর টের পেলাম।
তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসে দেখি আমার পাশে সজীব সাহেব!
আমি ভয় পেয়ে কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম- আ..আপনি এখানে কি ক.. করছেন?
সজীব সাহেবের উত্তর শুনে একটু অবাকই হলাম!
সে নরম গলায় বলল – ভয় পেও না রূপরেখা। তোমার হাতটা আমার বালিশের ওপর ছিল। বালিশটা টানতে গিয়ে তোমার ঘুমটা ভেঙে গেছে!
আমি কিছু না বলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম। আমি এখনো ভয় পাচ্ছি!
সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- আরেকটু ওইপাশে যাবে? আমি তোমার মত তালপাতার সেপাই নই তো! এটুক জায়গায় হবে না!- বলে সে হেসে ওঠে!
আমি এবার সন্দেহ এবং দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি এখানে শোবেন?
– কেন? তুমি এই পাশে ঘুমাতে চাইছ?
– আরে না! আপনি আ..আমার পাশে ঘুমাবেন?
লোকটা এবার সব বুঝে ফেলার ভঙ্গিতে বলে- রূপরেখা এতক্ষণ জার্নি করে এসেছি, তার ওপর এতক্ষণ গিন্নীমা বৌভাতের আয়োজনের আলোচনা করছিলেন, আমি অনেক টায়ার্ড! এসব নাটকীয়তা এখন ভাল লাগছে না।
আমি হা করে তার কথা শুনলাম।
এরপর আবার তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলাম- এ..এর..ম..মানে কি?
– মানে তুমিও ঘুমাও আর আমিও ঘুমাই।
– এখানে? একসাথে?
সে এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে- মাটিতে শোবার জন্য কোন অ্যারেঞ্জমেন্ট করা নেই। আর এত রাতে একা তুমি অন্য কোন রুমে শুতেও পারবে না। তুমি কোন ঘরই চেনো না। আর এই বাড়িতে নিষিদ্ধ কিছু ঘর আছে। যেসব ঘরে যাওয়া বারণ। কাজেই আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া তোমার আর কোন উপায় নেই।
বলে সে সত্যি সত্যি শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিল! আমিও বুঝতে পারলাম আসলেই এছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। আমি তো এই বাড়ির কিছুই চিনি না। সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হয়েছি। মাটিতে শুতে পারব কিন্তু তোশক তো লাগবে। একটা চাদর তো লাগবে।
আমি মিনমিন করে বললাম- আমাকে একটা চাদর দিলে আমি মাটিতে ঘুমাতে পারতাম।
-স্যরি! তোমাকে আমি কোন চাদর দিতে পারছি না। তার কারণ আমি জানি না চাদর কোথায়। এখন দয়া করে ঘুমাও। আর নিতান্তই বিশ্বাস করতে না পারলে জেগে থাক।
আমি সংশয়ে ভুগছি। যদিও লোকটাকে ডেঞ্জারাস লাগছে না। তবুও নিজের সেফটির জন্য সরতে সরতে বিছানার একপ্রান্তে চলে গেলাম। ভাগ্যিস খাটটা বেশ বড়।
সজীব সাহেব অন্যপাশ ফিরে শুয়ে আবার হঠাৎ এদিকে ফিরলেন।
আমাকে দেখে ফিক করে হেসে বলে- তুমি তো বিছানা ধরে ঝুলে আছ! পড়ে যাবে তো!
আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল! একে তো কোন হেল্প করছে না আবার বড় বড় কথা!
আমি অন্যদিকে তাকালাম!
– যেটা বলতে চেয়েছিলাম। বাবা মানে তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। তোমাকে নাকি তারা ফোনে পাচ্ছেন না। তাই আমাকে করেছিলেন। আমি বলেছি তুমি ঘুমিয়ে গেছ। সকালে কথা বলে নিও!
আমি চুপ করে মোবাইলটা চেক করলাম। অনেকগুলো মিসডকল উঠে আছে। মা-বাবার নম্বর থেকে। কেন এখন ফোন করছে এতবার? এই বুড়ো দাদুর সাথে বিয়ে দিয়েছে কেন তাহলে?
সজীব সাহেব বলল- ও হ্যাঁ! আরেকটা কথা রাতে যদি কোন ধরনের শব্দ শোন একা একা একেবারেই বের হবে না কিন্তু! ভয় পেলে আমাকে ডাক দিও কিন্তু বের হয়ো না।
এই বলে উনি টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে, কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
আর আমি ভাবনার জগতে চলে গেলাম! ঘুমটা চটে গেছে! ভয়ও পাচ্ছি। আচ্ছা সবাই কেন রাতে বের হয়ো না, শব্দ শুনতে পারো এসব বলছে? এটা কি কোন ভূতের বাড়ি? এটাকে তো এখন ভূতের সিনেমার শুটিং স্পট মনে হচ্ছে! এভাবে সবাই মিলে ভয় কেন দেখাচ্ছে?
একটুপরেই আমি সজীব সাহেবের নাক ডাকার আওয়াজ পেলাম। কোনদিন কারো নাক ডাকার শব্দ আমার এত ভাল লাগেনি আজ যতটা লাগল। তার মানে লোকটার আসলেই কোন বদ মতলব নেই। নাকি অভিনয় করছে? আমি উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম। নিয়মিত নিশ্বাস পরছে। নাহ! লোকটা ভালই মনে হয়! তাহলে আমি এবার একটু ঘুমের ট্রাই করি। আমি আমাদের মাঝখানে দুইটা বড় কোলবালিশ রেখে শুলাম। চোখটা মাত্র লেগেছে আর হঠাৎই আমি একটা শব্দ পেলাম। লাফিয়ে খাটে বসলাম। সজীব সাহেব নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। তাহলে শব্দ আসছে বাইরে থেকে। আবার কেমন ঝমঝম করে শব্দ হল! এটা কি নূপুরের শব্দ? এত রাতে নূপুর পরে কে হাঁটছে? আবার এমন নয় যে শব্দটা কন্টিনিউয়াস হচ্ছে! হয়ে থেমে যাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ হচ্ছে! সজীব সাহেব আর অনামিকার সতর্কবার্তা মনে হয়ে আমার গা ছমছম করে উঠল!