দীর্ঘতম রাত (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

লিফটের ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে হলো কেউ একজন লিফটে আছে। স্পষ্ট নিঃশ্বাসের শব্দ শুনলাম। কিন্তু লিফটে ঢোকার সময় তো কাউকে দেখেছি মনে পড়ছে না। আমি মোবাইলের আলো জ্বালালাম, লিফট খালি, কেউ নেই। মনের উপর কি সাংঘাতিক চাপ পড়লে মানুষ এই রকম ভুল অনুভব করতে পারে ভেবে একটু শুকনো হাসি হাসলাম। লিফট থেকে বের হবো কিভাবে যখন ভাবছি তখন একটা ঝাঁকি দিয়ে লিফট চালু হয়ে গেল।
ব্যাকআপ পাওয়ার হিসাবে অটোমেটিক জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। লিফট করে নীচে নেমে এলাম। গেটে কেউ নেই। দারোয়ানও নেই। আমি লোহার তালা দেয়া গেটের ওই পাশে উঁকি দিলাম, সাজ্জাদকে দেখা গেল না কোথাও।
ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতে কয়েকমিনিট বাকি। চারিদিকে ভীষণ নিস্তদ্ধতায় শুধু জেনারেটরের সামান্য শব্দ শোনা যাচ্ছে। দামী জেনারেটর, সাইলেন্সার খুবই শক্তিশালী, শব্দ প্রায় হয়ই না। আমি কয়েকবার জোরে জোরে সাজ্জাদ সাজ্জাদ বলে ডাক দিলাম। সুনশান নীরবতা ভেঙ্গে গেল, আমার ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো। কিন্তু কেউ জবাব দিলো না। সাজ্জাদ আশে পাশে নেই। দারোয়ানকে কয়েকবার জোরে জোরে ডেকে ঘুম ভাঙাতে পারলাম না। ব্যাটা তার রুমের দরজা আটকে ঘুমাচ্ছে। মনে হলো জেগে আছে কিন্তু ইচ্ছে করে ডাকে সাড়া দিচ্ছে না।
আমি ওখান থেকে সরে এলাম। লিফটে চড়ে আবার নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে চললাম। দরজার সামনে আলো জ্বলছে, জেনারেটরের কানেকশনে লাইট জ্বলে এখানে। আমি কয়েকবার জোরে জোরে ডাকলাম, নীলা দরজা খোল। দরজায় শব্দ করলাম। কেউ দরজা খুলল না।
তারপর মনে হলো, নীলাকে বলেছিলাম আমি ফোন করে না বললে দরজা না খুলতে। দ্রুত মোবাইলে ফোন দিলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পর নীলার ভয়ার্ত গলা শোনা গেল, হ্যালো?
আমি বললাম, দরজা খোল নীলা। সাজ্জাদকে পেলাম না। দরজা খোল এখন।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। ওই পাশে নীলা আর টিনা দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে।
আমি হেসে বললাম, এতো ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয় নি। আমার মনে হচ্ছে সাজ্জাদ এসে ডাকাডাকি করে ফিরে গেছে। দারোয়ান ব্যাটা দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এখন আমাদের কিছু করার নেই। চল ঘরের ভিতর যাই।
নীলা একটা গোঙানির মতো আওয়াজ করল। ভয়ে টিনাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কি হয়েছে? এতো ভয় পাওয়ার কি হলো?
নীলা আর টিনা দুইজনই ঘরের ভিতর হাত দিয়ে দেখালো। আইপিএসের পাওয়ারে আমাদের ঘরের আলো জ্বলছে। অস্বাভাবিক কিছু দেখলাম না।
আমি ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। দুইজনই চাপা স্বরে চিৎকার করে উঠল।
লীনা বলল, তুমি একটু আগে আসো নি? এতক্ষণ নীচে ছিলে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, হ্যাঁ। নীচে ছিলাম। কেনো কি হয়েছে?
দুইজন ভীষন ভয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যা বলল তার অর্থ করলে দাঁড়ায় আমি নাকি নীচে নামিই নাই। তখন লীনা দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর পরই আবার নক করে বাসায় ঢুকে গেছি। তাদের কথায় বোঝা গেল আমার মতো কেউ একজন এখন বাসায়, বাথরুমে ঢুকেছে। সেখান থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে।
আমি একবার মা মেয়ের দিকে তাকালাম। তারা ভয়ে নীল হয়ে আছে। একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে। আমিও ভয় পেলাম প্রথমে। তারপর মাথা ঠান্ডা করলাম।
খুঁজে পেতে একটা লাঠি নিয়ে ঘরের ভিতর চললাম। মা মেয়ে আমার পিছু পিছু। লাঠি সামনে ধরে বাথরুমের দরজা খুললাম।
ফাঁকা বাথরুম। কেউ নেই সেখানে। সারা ফ্ল্যাট ঘুরে দেখলাম। খাটের তলা দেখলাম। কোথাও কেউ নেই।
আমি নীলা আর টিনাকে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। মা মেয়ের ভয় এখনও কাটেনি। শান্ত স্বরে বললাম, কেউ আসেনি। পুরাটাই তোমাদের মনের কল্পনা। একটা মাস হিস্টোরিয়ার মতো হয়েছে তোমাদের। আজ রাতের সবকিছু তোমাদের মনের উপর এতো চাপ পড়েছে যে দুইজনের একসঙ্গে হেলুসিনেশন হয়েছে।
আমার ব্যখ্যায় কাজ হলো কিনা বোঝা গেল না। তবে নীলা কথা বলল, সাজ্জাদ কোথায়? সাজ্জাদের খোঁজ কিভাবে পাবো ?
আমি বললাম, সাজ্জাদ ফিরে গেছে আমি শিওর। নিশ্চয়ই মোবাইল চার্জ দিয়ে যোগাযোগ করবে আমাদের সঙ্গে। এখন আমাদের উচিৎ শুয়ে পরা, অনেক রাত হয়েছে।
নীলা রাজি হচ্ছিল না। সে তার ভাইয়ের খবর না নিয়ে ঘুমাবে না। আমিও জেগে থাকলাম তার সাথে। মাঝে মাঝে সাজ্জাদের ফোনে কল করে দেখছি সেটা খুলেছে কি না।
অল্প কিছুক্ষণ পর ইন্টারকম ফোন বাজল। এতো জোরে বাজল যে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। নীলা দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরল। নীচ তলা থেকে রিনা ভাবি ফোন করেছে। নীলা কথা শেষ করে এসে বলল, রাহাত আংকেল নাকি বাসা থেকে বের হয়েছে তোমার চিৎকার শুনে। তুমি নাকি তাকে চিৎকার করে ডেকেছ।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কখন তাকে ডাকলাম?
আমি ইন্টার কমে রাহাত আংকেলের বাসায় ফোন দিতে যাচ্ছিলাম, এসময় আমাদের বাসার কলিং বেল বাজল।
আমি ডোর ভিউ দিয়ে তাকিয়ে দেখি, রাহাত ভাই দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলে দিলাম। রাহাত আংকেল বললেন, ভাই কে যেনো আপনার নাম ধরে ডাকছিল, কে এসেছে এতো রাতে?
আমি বললাম, আমার শ্যালক সাজ্জাদের আসার কথা ছিল। সম্ভবত সে নীচ থেকে ডাকাডাকি করে চলে গেছে।
রাহাত আংকেল বললেন, নাহ। আমি তো ছাদের দিক থেকে তার ডাক শুনলাম। সম্ভবত সে ছাদে উঠে গেছে। সেখানে গিয়ে দেখা দরকার।
রাহাত আংকেলের গলায় একটা কিছু ছিল। আমি বললাম, চলেন যাই। ছাদে গিয়ে দেখে আসি।
নীলা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে আমাকে টেনে ধরে বলল, এতো রাতে ছাদে যাবা?
আমি বললাম, আরে রাহাত আংকেল আছে সাথে। ভয় কি? তাছাড়া সত্যিই সাজ্জাদ ছাদে গেলো কিনা সে ব্যাপারটা দেখতে হবে।
নীলা ভয়ে ইতস্তত করতে লাগল। আমি পাত্তা না দিয়ে চলে এলাম।
লিফটে করে ছাদের চিলেকোঠায় এসে ছাদের গেট খুললাম। ছাদে পা দিয়েই বুঝলাম বড় কোন গড়বড় আছে এখানে।
আমাদের ছাদে অদ্ভুত একটা নীরাবতা। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সাজ্জাদ। আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু সাজ্জাদের পাশে কে বসে আছে? সাজ্জাদের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে রাহাত আংকেল । একটু আগেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এতো দ্রুত ছাদের মাঝ খানে কিভাবে গেলেন? দেখে মনে হলো রাহাত ভাই ওখানে আগে থেকেই ছিলেন, তাহলে আমার সঙ্গে এতক্ষণ কে ছিল?
আমি ভয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্ফুটে আর একবার ডাকলাম, সাজ্জাদ।
সাজ্জাদ একটা হাত উঁচু করে আমার দিকে তাক করল। বলল, বেঁচে গেলি। আমি আর একজনকে পেয়ে গেছি আজ।
আমি জ্ঞান হারালাম।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন কেউ আমার মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছিল। তাকিয়ে দেখি নীলা। আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। আমি উঠে বসলাম। নীলা রিনা ভাবি আর রাজন ভাই দাঁড়িয়ে আছে আমাকে ঘিরে। আমি বললাম, টিনা কই?
নীলা বলল, রিনা ভাবির বাসায় রেখে এসেছি।
আমি ছাদের দিকে তাকালাম সেখানে কেউ নেই।
বললাম, সাজ্জাদ?
নীলা বলল, সে গতকাল আসেই নি। ফোনের চার্জ চলে যাওয়ায় আসার চিন্তা বাদ দিয়ে বাসায় গেছে। সকালে ফোন করে জেনেছি।
—রাহাত আংকেল ?
রিনা ভাবি ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, রাহাত আংকেলকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে বের হয়েছিল , এরপর থেকে লাপাত্তা।
পরদিন দুপুরের দিকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতর রাহাত আংকেলকে পাওয়া গেল, মারা গেছেন। ডাক্তার বলল, হার্ট এটাক করেছে। কিন্তু আমরা সবাই দেখলাম রাহাত আংকেলের চোখে মুখে নগ্ন আতংক। কি দেখেছিলেন উনি? গেট বন্ধ ছিল, তাহলে এই বন জঙ্গলে এলেন কিভাবে?
আমরা সাজ্জাদের ডাক শুনলাম রাতে, কে ডেকেছিল? ছাদেই বা কে ছিল ওটা? আমার মতো কে আমাদের বাসায় ঢুকেছিল?
সে ভয়াবহ রাতের রহস্য আর ভাঙা হলো না৷ আমরা এক সপ্তাহের ভিতর বাসা ছেড়ে দিলাম।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প