পৌনঃপুনিক

আম্মু বললো, ‘দেখতো, তোর মামা-মামী আসার সময় হয়ে গেছে। উনারা আসছেন কিনা?’
আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের বাসা থেকে রাস্তার অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। শহরের শেষ মাথায় আমাদের বাসা, এরপরই বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। মানুষের আনাগোনা কম এই এলাকায়, রাস্তা প্রায় ফাঁকাই থাকে। তাই দোতলা বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে রাস্তার অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। দেখলাম মামা-মামী আসছেন। বিকেলের আলো প্রায় নিভে গেছে, সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। দূর থেকেই মামা-মামীর মুখখানা দেখা যাচ্ছে। দুজনেই ভীষণ হাসিখুশি।
আমি আম্মুকে গিয়ে জানালাম, ‘আম্মু, দু’জনেই আসছেন। কিন্তু দুজন প্রত্যেকবার আসার সময় আমার জন্য যে আইসক্রিমের বাটি নিয়ে আসেন, সেরকম কিছু তাদের হাতে দেখছি না। আমি কি তাদের বাসায় ঢুকতে দিবো?’
আম্মু বললো, ‘যা ফাজিল। উনারা আসলে দরজা খুলে দিস। আমি নামাজে দাঁড়ালাম।’
আমি বারান্দায় গেলাম। মামা-মামী বাড়ির নিচে, আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। সিঁড়িতে তাদের ওঠার শব্দ পাচ্ছি। তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। দরজায় কড়া নাড়লেন। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। কেউ নেই। দরজার ওপাশে পুরো ফাঁকা।
অবাক ব্যাপার। মামা-মামী কোথায় গেলেন?
আম্মু নামাজ সেরে এসে বললেন, ‘তোর মামা-মামী আসেন নাই? দরজায় নক করলো মনে হলো।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ মা, দরজায় তো তারাই নক করলো। কিন্তু দরজা খুলে দেখি কেউ নাই।’
‘আজব ব্যাপার তো। যা, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়া। দেখ উনারা কোথায় গেলো।’
আমি আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বাড়ির নিচে কেউ নাই। দূরেও কাউকে দেখছি না। মামা-মামী গেলেন কোথায়?
আমি বারান্দায় বসে আছি। দশ-পনের মিনিটের মতো সময় গেছে। সন্ধ্যার আলো তখনও নিভে যায়নি।‌ হঠাৎ দেখলাম, দূর থেকে মামা-মামী আসছেন। আগের মতোই হাসিহাসি মুখে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এখন যদি মামা-মামী আসেন, তাহলে একটু আগে কাদের দেখলাম?
মামা-মামী বাসার কাছে চলে এসেছেন। দুজনেই আমার দিকে তাকালেন। আগের মতোই হাসিখুশি মুখ।
তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। সিঁড়িতে তাদের পায়ের শব্দ পাচ্ছি। পায়ের শব্দ দরজার সামনে এসে থামলো। দরজায় আবার কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। আমি গিয়ে দরজা খুললাম। আমার সাথে এবার আম্মুও ছিলো। দরজা খুলেই আবার আমরা অবাক হয়ে গেলাম। দরজার ওপাশ একদম ফাঁকা। কেউ নেই দরজার ওপাশে।
আম্মু কেমন ভয় পাওয়া গলায় বললেন, ‘কি হচ্ছেরে বলতো এসব? কি হচ্ছে?’
আমি আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দূর থেকে মামা-মামীকে আসতে দেখা যাচ্ছে। দুজনের মুখই হাসিহাসি।
আম্মুর ফোন এসেছে। আব্বু ফোন দিচ্ছে। ফোন ধরেই আম্মু কান্নাকাটি শুরু করলো। কি হয়েছে, একদমই বলতে পারছেন না। বেশ কিছুক্ষণ পর আম্মু কান্না থামিয়ে কোনোরকম একটু শ্বাস নিতে নিতে বললো, ‘তোর মামা-মামী যে লঞ্চে আসছিলেন মুন্সিগঞ্জ থেকে, সেটা নাকি ডুবে গেছে। একজন লোকও বেঁচে নাই…’
আমি আম্মুর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কোনো এক গল্পে পড়েছিলাম, মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই কোনো কারণে মারা গেলে জাজমেন্ট ডে পর্যন্ত সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে থাকে। গল্পের এই কথাটা আমি কোনোদিন বিশ্বাস করি নাই।
সিঁড়িতে তখনো পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কারা যেন উঠে আসছেন সিঁড়ি বেয়ে। পায়ের শব্দ দরজার কাছে এসে থামলো। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আমি আর আম্মু প্রচন্ড ভয় আর আতংক নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
দরজার ওপাশে কে আছে? কে?

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প