আমি আলিফ। আজ শেয়ার করব আমার এবং আমার ফ্যামিলির সাথে ঘটে যাওয়া বাসা কেন্দ্রিক একটি ঘটনা। চলুন শুরু করা যাক।
২০১৯ সালের শেষের দিকে আমারা সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা বাসা চেঞ্জ করব। খোজাখুজি করার পর ময়মনসিংহের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার এলাকায় একটি বাসা পাই। আম্মু-আব্বুর পছন্দ হয়, তাই বাসাটা ভাড়া নিয়ে নিই। ঘটনার সুবাদে বাসাটা কেমন ও বাসাটার বাহ্যিক পরিবেশ সম্পর্কে বলে নিই। হাফ বিল্ডিং বাসা, পাশাপাশি ২ টা রুম, মাঝাখানে ডাইনিং। বাহিরে বারান্দা বরাবর ছোট রাস্তার সাথে একটি পরিত্যক্ত জমি ছিল। বিভিন্ন রকমের গাছ-গাছালি যেমন: আম, কাঠাল, কচু, লতা-পাতা দিয়ে আচ্ছন্ন ছিল। রাতের বেলা বই দিনের বেলাতেও ঠান্ডা কিন্তু ছম ছমে পরিবেশ বিরাজমান থাকত। এইবার আসা যাক মূল ঘটনায়।
মালামাল আনার কাজ চলছিল। রুম ভাগাভাগি হয়ে গেল। প্রথম রুমটা আমি পেলাম যেটা রাস্তার সাথে, ২য় রুমটা আব্বু-আম্মু। আব্বু-আম্মুদের রুমে দরজার উপরে দেয়ালে সাদা বর্গাকার কাগজে লাল কালি দিয়ে বেশ কয়েকটি আরবি হরফে লেখা ছিল। তো বিষয়টাকে আমরা পজিটিভলি নিই। কারন এইটাতো খারাপ কিছু না। সেইটা আর খোলা হয়নি তাই। ঘটনা শুরু হয় বাসায় ওঠার প্রথম শুক্রবার দিনে। আমি আর আমার ছোট ভাই জুম্মার নামাজ পড়ে এসে খাওয়া-দাওয়া করে আম্মু আব্বুর রুমে শুয়েছিলাম। আমি ঘুম ঘুম ভাব, ছোট ভাই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ আমার পিঠে একরকম আলতো হাতের স্পর্শ পেলাম। মনে হল যেনো সে স্পর্শ টা একটা ক্রস সাইন আকল। ভাবলাম, ছোট ভাই যেহেতু পাশে, হয়ত তার আঙুল লেগেছে। তাই আর বিষয়টাকে পাত্তা দিই নি। কিন্তু ঠিক পরের শুক্রবার এও আমরা ২ জন একই ভাবে শুয়ে ছিলাম এবং যেটা ভাবছেন সেটাই, আমার ঠিক সেইম পজিশন এ ওই একই স্পর্শ একই ভাবে ক্রস সাইন আকল। এবার আর বুঝতে বাকি রইল না যে এইটা কোন স্বাভাবিক বিষয় না।
প্রায় ২-৩ মাস পার হয়ে গেল। সবাই নানু বাড়িতে ছিলাম। আম্মু-আব্বুরা সবাই মিলে গল্প করছিল। কি যেন একটা ডাকাডাকি নিয়ে কথা বলছিল। তবে বুঝতে পারছিলাম কোন ভৌতিক বিষয়ে কথা-বার্তা হচ্ছে। কৌতুহল বসত জিজ্ঞেস করায় তারা বিষয়টি এরিয়ে যায়।
এদিকে বাসায় আমার সাথে নতুন আরেকটা সমস্যা তৈরি হতে লাগল। বিষয়টি এমন যে, রাতে ঘুমানোর সময় বালিশে খস খস খস আওয়াজ হতো। যা কানে লাগায় প্রচন্ড বিরক্ত লাগত। রীতিমতো বালিশকে পেটাতাম, কাজের কাজ কিছুই হতো না। বালিশ চেইঞ্জ করেও লাভ হতো না।
হঠাৎ একদিন মধ্য রাতে আম্মু উঠে কান্না শুরু করে দিল। তারাতাড়ি কতে উঠে গেলাম। অনুধাবন করতে চেষ্টা করলাম, কারন টা কি। কারন টা হল, আম্মুকে প্রতি রাতে কেউ যেন একটু ডাক দিতো। শুধু মাত্র একটি ডাক। তাও কিভাবে, আমার আব্বু আম্মুকে যেভাবে ডাকে – ঠিক সেভাবে আব্বুর আওয়াজ এ। এই কারনে আম্মুর রাতে ঘুম হত না। প্রতি রাতে ভয় কাজ করত। এই হলো সে ডাকাডাকির কাহিনির নেপথ্যে ঘটনা। যা আমাদের ২ ভাই এর কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। তখন আমিও আমার সাথে ঘটে যাওয়া পুর্বের ঘটনা বলি।
সবাই মিলে এইবার নিশ্চিত এই বাসায় অস্বাভাবিক কিছু আছে। যেটা চায় না আমরা এই বাসায় থাকি। তবে বাসা পরিবর্তন করাও তখন সম্ভব ছিল না কারন ততদিনে করনার কারনে ২ মাস ধরে লকডাউন।
আমার খুবই কৌতুহল জাগত যে আসলে ডাকে কিভাবে। কারন আমি কোনদিন ডাক শুনিনি। এভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ে থাকছি। ঘুম না হওয়া, বাসায় কাজের চাপ এই সব কিছু মিলেয়ে আম্মু ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুখ আম্মুকে ছাড়তেই চায় না।
একদিন আমার রুমে বসে পড়ছিলাম, যেখানে থেকে ডাইনিং রুম দেখা যায়। হঠাৎ দেখতে পারলাম ছায়ার মত কিছু একটা এপাশ থেকে ওপাশে চোখের পলক ফেলার আগেই চলে গেল। পরে জানতে পারলাম, আব্বুও বিষয়টি অনেকবার খেয়াল করেছেন।
আবার একদিন ২য় রুমে আমি একাই বসে ফোন চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার আব্বু আমাকে যেভাবে ডাকে ঠিক সেইভাবে ডাক শুনতে পেলাম। মাত্র একটি ডাক।
এই করে করে ২১ সালের অর্ধেক। পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক নয়। শেষে বাসার মালিক স্বীকার করতে বাধ্য হোন যে, তার বাসায় অস্বাভাবিক কিছু আছে। আমদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে পূর্বের ভাড়াটিয়ারা কেন ওই কাগজে আরবি লেখা গুলো লিখেছিলেন।
তখন করোনা কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করল। লকডাউন ১ মাস করে ১ মাস পর পর দেওয়া হতে লাগল। ঠিক করা হল হুজুর আনা হবে। পাশের হাজি-বাড়ি মসজিদ থেকে একজন হুজুরকে আনা হল। তিনি আসলেন, দেখলেন, বললেন, হ্যাঁ,সমস্যা আছে। পানির বোতলে ঝাড়ফুঁক করলেন। সেই পানিটা পুরো বাসায় ছিটিয়ে দিলেন। বললেন, এটা কোন স্থায়ী সমাধানা না। ২-৩ দিন ভালো থাকতে পারবেন। বাসা বন্ধ করতে হবে। তার জন্য হুজুর বেশ ভালো পরিমাণের একটা হাদিয়া চাইলেন। এদিকে মালিক পুরোটা দিতে নারাজ। এজন্য সে সময় হুজুরকে বিদায় দেওয়া হয়। ভাবলাম করোনা যেহেতু স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, বাসাও চেঞ্জ করে ফেলা যাবে।
ঘটনা এইখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু নাহ। এখন সেই অশরীরির বড় কিছু একটা করা বাকি ছিল। যার ভিক্টিম ছিলাম আমি।
সকাল বেলা ৭ টার সময় প্রাইভেট। প্রতিদিনকার মতো সে রাতেও ১১ টার দিকে ঘুমিয়ে যাই আমি। এলার্ম তো আগেই দেওয়া ছিল। তো এলার্ম এর শব্দে ঘুম থেকে উঠি। বেসিন এ গিয়ে দাঁত মাজি, ভালো করে মুখ ধুই, ব্যাগ গোছাই, রেডি হই। চাবিটা হাতে নিয়ে শুধু বের হতে যাবো, ঠিক তখনি আব্বু ডাক দিয়ে বলে, “আলিফ, কই যাও?”
আমি বললাম, কেনো প্রাইভেট এ যাই।
এখন কিসের প্রাইভেট ? এখন তো ‘রাত ২ টা বাজে!
আব্বুর থেকে এটা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ইভেন, আমি পানি দিয়ে মুখ ধুয়েছি, বেসিন থেকে খোলা বারান্দা দেখা যায়, বোঝা যায় দিন না রাত। আমি কিছুই বুঝি নি; আমার কোন সেন্স কাজ করছিল না। তাহলে এলার্ম? চেক করে দেখি, এলার্ম তো ৭ টায়ই। রাত ২ টায় ছিল না।
এ ঘটনার পর আর সেই বাসায় থাকা সম্ভব হয়নি। মাস শেষে বাসা চেইঞ্জ করে ফেলি। আশেপাশের লোকজন এর থেকে শুনতে পেয়েছিলাম, পূর্বের ভারাটিয়াদের এক মেয়েকে নাকি ঠিক এইভাবে ভুলিয়ে ময়মনসিংহের স্বনামধন্য একটা স্কুলের পুকুরে নিয়ে গিয়েছিল।
এখন আমরা নতুন বাসায়। আলহামদুলিল্লাহ এখন কোন সমস্যা নেই। আম্মুও এখন বেশ সুস্থ। তো এই ছিল আমার ঘটনা। জানিনা কতটুকু গুছিয়ে লিখেতে পেরেছি। চেষ্টা করেছি। পাঠক আপনারা আপনাদের মতামত দিয়ে যাবেন। আল্লাহ হাফেজ।