বন্দী সূচনা_পর্ব

খবরদার রুপু, উপরের কোণার ঘরটায় যাবি না একদম।’ দাদাবাড়ি ঢুকলে মা সবার প্রথম এই সাবধান বাণী শুনিয়ে দিতেন। আমরা মানতাম না। ঠিক দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঐ ঘরের সামনে চলে যেতাম। তবে লাভ হতো না কোনো। ঘরের দরজায় এতো বড় তালা ঝোলানো থাকতো। ঐ তালার চাবি যে কার কাছে, কেউ জানতো না।
আমরা দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরের ভেতর উঁকিঝুঁকি দিতাম‌। ভেতরে কিছুই দেখা যেত না, কেবল অন্ধকার। মাঝেমাঝে আমরা কান পাততাম দরজায়, ভেতর থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যায় কিনা শোনার জন্য। কিছুই শুনতে পেতাম না।
আমার দাদাবাড়িটা ছিলো অনেকটা জমিদারি ধাঁচের, এতো এতো ঘর ছিলো বাড়িটায়। সবগুলো ঘর বাদে ঐ একটা ঘরই আমায় কেবল টানতো। কিন্তু, ওটার কথা জিজ্ঞেস করা নিষেধ ছিলো সবার। কখনো মা যদি দেখতেন, ঘরটার সামনে ঘুরঘুর করছি, তবে মার একটাও মাটিতে পড়তো না। এসব করে করে ঘরটার প্রতি কৌতুহল আমাদের বেড়ে গিয়েছিলো। অথচ সেই কৌতুহল দমনের কোনো উপায় ছিলো না।
এরপর, সময় অনেকখানি বয়ে গেল। শরিকদের রেষারেষিতে দাদাবাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। একসময় সে সমস্যা মিটলো। মা ততদিনে আর আমাদের মাঝে নেই, বাবাও অনেক রোগের ভারে শয্যাশায়ী। ছোট ভাইটা বিদেশে থিতু হয়েছে। পরিবারের একমাত্র কর্ণধার হিসেবে আমার উপরই দায়িত্ব পড়লো বাড়িটা দেখার।
অনেকদিন পর আবার দাদাবাড়ি এলাম। বাড়িটার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। মেরামত করার মতো অবস্থা বা সামর্থ্য, কোনোটাই আমার নেই। ঠিক করলাম, কিছুদিন থেকে বাড়ির মোটামুটি একটা তথ্য নিয়ে পরে ব্যবস্থা করতে হবে।‌‌‌‌‌‌ স্থানীয় এক লোককে ডেকে একটা রুম পরিস্কার করালাম। এরপর সে রুমেই থেকে বাড়ির মাপজোখ করতে থাকলাম।দুদিনেই হাঁপিয়ে গেলাম, এতো বড় বাড়ির মাপজোখ কয়েকদিনে করা সম্ভব না। শেষমেষ ঠিক করলাম, কিছুদিন পর আবার লোক নিয়ে আসবো।
যেদিন আমার এই বাড়িতে থাকার শেষরাত, সেইরাতে বিছানায় শুয়ে হঠাৎ মনে পড়লো সেই নিষিদ্ধ ঘরটার কথা। আরে, ঐ ঘরটা তো আমি এখন যেকোন সময় খুলে দেখতে পারি। কেউ তো নেই বাঁধা দেবার। আমি উপরে উঠে গেলাম। পায়ে পায়ে এগোলাম সেই ঘরটার কাছে‌। আহা, সেই ঘর। এ ঘরে ঢোকবার কতো ইচ্ছা ছিলো আমার। সব আজ পূরণ হবে। দরজার বাইরে মস্ত তালাটাকেও উত্তেজনায় আর মস্ত লাগছিলো না। একটা শাবল নিয়ে এসে চাড় দিয়ে ভেঙে ফেললাম, তালাটা পুরনো বলেই হয়তো ভাঙতে তেমন বেগ পেতে হলো‌ না। এরপর টর্চ জ্বালিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
কিন্তু এ কি? এ কি দেখছি আমি? ঘরটা একদম খালি। কিচ্ছু নেই ভেতরে। পুরো হতাশ হয়ে গেলাম। এ ঘরটাকে ঘিরে কতো কৌতুহল, কতো কল্পনা জমা হয়েছিলো ভেতরে, সব বালির বাঁধের মতো ভেঙে গেল। মন খারাপ করে ফিরে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরলাম।
তখনই এক জিনিস দেখে, ভয়ে জমে গেলাম একদম।
আমার মতো কে যেন দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আর ঘরের দরজা লেগে গেল আপনা-আপনি। আমি ডুবে গেলাম গাঢ় অন্ধকারে।
আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলবার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। দরজা শক্ত করে লাগানো।‌‌পালানোর সুযোগ নেই। ঘরে একটাও জানালা নেই। একদম কবরের মতো নিস্তব্ধ এক ঘর।
তার মানে, আমার মতো কেউ একজন আমার স্থান নিয়ে ঘুরে বেড়াবে বাইরের দুনিয়ায়। আর আমি পড়ে রইবো এখানে। কতোজনের সাথে এমন ঘটেছে? আমি কি প্রথমজন? এখানে কতোবছর থাকতে হবে? কেউ কি আসবে না আমাকে বাঁচাতে? এও কি সম্ভব?
আর তখনই, সেই নিকষ কালো অন্ধকার ঘরে, আমার মৃত মায়ের কণ্ঠ স্পষ্ট শুনলাম আমার কানের কাছে, ‘রুপু। তোকে আগেই মানা করেছিলাম।’

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প