মাছ_ধরার_গল্প

রানাদের গ্রামে গিয়ে একটা জিনিস বেশ খটকা লাগছে। এ গ্রামে কেউ মাছ খায় না। মুরগি, খাসি, গরু, ডিম, কচুর লতি, লাউয়ের বড়া সবই খেয়েছি এখানে, কিন্তু মাছ খাইনি এখনো। অথচ আমি জানতাম গ্রামবাংলার মানুষের মাছ খুব প্রিয়, মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটাতো এমনি এমনি আসেনি। একদিন থাকতে না পেরে রানাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে, তোদের গ্রামে এতো পুকুর-নদী, মাছ হয়না কোনোটায়?’
রানা বললো, ‘হবে না কেন, প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এখানে।’
‘তাহলে? তোরা মাছ খাস না কেন?’
‘গ্রামে মাছ নেয়া বারণ। মাছ নিলেই তেনারা পিছু নেন।’
আমি হেসে ফেললাম,’তেনারা মানে কি? ভূতেরা?’
‘তবে আর কি? তোর খুব মজা লাগছে শুনতে, তুই তো আর এখানের কেউ না। ওদের পাল্লায় যারা পড়েছে তারা জানে। দিন নেই রাত নেই, মাছ সাথে দেখেছে কি পিছু নিবে তোর।’
‘তারপর? মাছ না দিলে?’
‘আধ হাত কাদার মধ্যে গেড়ে রেখে দিবে। মাথা নিচে, পা উপরে করে। গত বছর ও বাসার মকবুল কাকুর নতুন জামাই শ্বশুরবাড়িতে আসছিলো মাছ নিয়ে, এসব কথা তো আর জানতো না। পরে ঐভাবে ওকে গেড়ে রেখে দিয়েছিলো, বাবা, সেই দৃশ্য কল্পনা করলে এখনো গায়ে কাটা দেয়।’ বলতে বলতে রানা সত্যি শিউরে উঠলো।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘ধুস, চাপা মারারও তো লিমিট থাকে।’
‘দেখ, তুই বিশ্বাস করবি না জানি, কিন্তু কথা সত্যি। এখানে থাকতে আর মাছের নাম নিস না। ঢাকায় গিয়ে যা ইচ্ছা যত ইচ্ছা মাছ খাস, আমি খাওয়াবো তোকে। এখন চুপ থাক।’
আমারও জেদ উঠে গেল। এতো চেষ্টা করেও তো ‘তেনাদের’ দেখা পাই নি, আজ দেখবো ‘তেনাদের’ কত দৌড়। রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে তখন সাথে আনা বরশি আর চার্জার লাইট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে খাওয়ার জন্য এক বোতল পানি।
রানাদের বাড়ি থেকে নদী কিছুটা দূরে। এর আগে কখনো মাছ ধরি নি নদীতে। নদীর কিনারে বসে ছিপে চার বেঁধে ছুড়ে দিয়ে বসে রইলাম। সাথে সাথে মাছ গেঁথে গেল। পকেটে করে নিয়ে আসা কাপড়ের ব্যাগে ভরলাম মাছটা। আবার বরশি ফেললাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাগ ভরে গেল। এই বড় বড় মাছ উঠেছে। আফসোস হচ্ছিলো আরো বড় ব্যাগ আনলাম না কেন। যাই হোক, যা আছে তা নিয়েই বাড়ির পথ ধরলাম।
হঠাৎ মনে হলো, পিছনে পায়ের শব্দ পাচ্ছি। পিছন ফিরে দেখলাম কেউ নই। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আবার পায়ের শব্দ। এবার পেছনে তাকিয়ে দেখি এক কালো মতো কি যেন, দেখে মনে হচ্ছে যেন ঘোমটা দেয়া কোনো মহিলা, আমার পিছন পিছন আসছে। আমি হাঁক দিলাম, ‘কে ওখানে? কি চাই?’ কিন্তু কোনো উত্তর এলো না।
আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দেখলাম জিনিসটা আমার পিছু পিছু আসছে। আমি দাঁড়ালাম, সেও দাঁড়ালো। আমি হাঁটা শুরু করতেই আবার হাঁটা শুরু করলো।
এবার একটু ভয় লাগলো। হাঁটার গতি বাড়ালাম। একটু পরই বুঝলাম, ওটা একা না। আমার আশেপাশে গাছপালা ঝোপঝাড়ের আড়ালে ওমন আরো কয়েকজন আমার পাশেপাশে হাঁটছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করলাম। সামনে তাকিয়ে হাঁটছি, এসময়ই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়লো।
আমার সামনের রাস্তায় বেশ বড় বড় কয়েকটা তালগাছ ছিলো। চেয়ে দেখি মানুষের মতো দেখতে কিছু, ঐ তালগাছগুলো বেয়ে বেয়ে টিকটিকির মতো নিচে নেমে আসছে, মাথা উপড়ে পা নিচের দিকে করে। আমার সাহস ওখানেই শেষ, মাছগুলো ওখানে ফেলেই দৌড়ে বাড়ি ফিরলাম।
ঘরে ঢুকেই দরজা জানালা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুমাতে পারলাম না। একটু পরপর কে যেন বন্ধ জানালায় বাড়ি দিতে লাগলো। জানালার বাহিরে হাসির শব্দ, হাততালির শব্দ। এমনকি টিনের চালেও জোরে জোরে শব্দ হতে লাগলো। সারারাতটুকু যে কিভাবে কাটালাম, সে কেবল আমি জানি।
পরদিন সকালে রানাকে গিয়ে বললাম, ‘আজকেই ঢাকা চলে যাবো। তুই বাসের টিকিটের ব্যবস্থা করে দে।’
রানা হাসতে হাসতে বললো, ‘কেন রে? হঠাৎ বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা হলো কেন? তেনারা কি ভয় দেখিয়েছিলো কালকে?’
ওর হাসি দেখে কেমন একটু সন্দেহ হলো, জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে তুইই কালকে রাতে ওসব করেছিস?’
রানা হাসতে হাসতে একদম শুয়ে পড়লো। কোনোরকম নিজেকে সামলে বললো, ‘ভাইরে ভাই, যে দৌড়টা দিলি। ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দিলে এতোক্ষণে ভাইরাল হয়ে যেতি।’
আমার প্রচন্ড রাগ লাগলো, আবার লজ্জাও লাগলো। কি গাধামিটা করলাম, কালকে রাতেই বোঝা উচিত ছিলো ব্যাপারটা। কিন্তু বন্ধু যে ওর গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এনে এভাবে বোকা বানাবে, তা তো ভাবতেও পারি নি একবারও।
রানার হাসি থামলে বলতে লাগলো, ‘স্যরি দোস্ত, আসলে তোর জেদ দেখে মনে হলো একটু মজা করি তোর সাথে। প্ল্যানটা আমারই ছিলো। তোর ব্যাগে বরশি ছিলো এটা আগেই দেখেছিলাম। কালকে যখন তোকে ভূতের গল্প বলে মাছ ধরতে বারণ করেছিলাম, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তুই রাতে ঠিক মাছ ধরতে যাবি, তোর কেমন জেদ তাতো জানি। আমার গ্রামের কিছু বন্ধুকে বলে রেখেছিলাম, তুই মাছ ধরে বাড়ি ফিরতেই গায়ে শাড়ি পেঁচিয়ে তোর পিছু নিয়েছিলাম সবাই। আর তোর জানালা আর টিনের চালের যতো শব্দ, সব আমার করা।’
আমি বললাম, ‘ কাজটা ভালো করিসনি। ভয়ে মরে গেলে?’
‘মরবি না। তোর কৈ মাছের প্রাণ।’
‘তোদের গ্রামে তো অ্যাথলেটেরও অভাব নেই দেখি। যেভাবে কালকে তালগাছ বেয়ে নামলো একেকজন।’
রানা একটু অবাক হয়ে বললো, ‘তালগাছ বেয়ে নামলো? কে?’
‘ কেন, তোরা যখন আমার পিছু নিয়েছিস, তখনই তো কয়েকজনকে দেখলাম তালগাছ বেয়ে নামতে। ওদের দেখেই তো ভয়ে দৌড় দিলাম।’
রানা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, এরপর বললো, ‘আসতো আমার সাথে, তাড়াতাড়ি…’
আমাকে নিয়ে রানা ওদের দু’বাড়ি পর এক বাড়ির উঠোনে গিয়ে চিৎকার করে ‘সুমন, সুমন’ বলে ডাকতে লাগলো।
এক মাঝবয়েসী মহিলা বেরিয়ে এলেন। রানা তাকে বললো, ‘কাকি, সুমন নাই বাসায়?’
‘নাতো বাবা, কাইলকা তোমার লগে রাইতে বাইরে যাওয়ার পর তো আর ফেরে নাই । আমি মনে করলাম, তোমার লগেই বুঝি আছে তোমাগো বাড়িতে।’
রানা আমাকে বললো, ‘সর্বনাশ। কালকে তোর ফেলে যাওয়া মাছগুলো তো সুমনের কাছেই ছিলো।’
আমরা সুমনকে খুঁজতে শুরু করলাম। বেশিক্ষণ খুঁজতে হলো না। ওদের বাড়ি থেকে একটু দূরে নদীর ধারে সুমনের লাশ পাওয়া গেল। মাথা নিচে পা উপরে করে,আধ হাত কাদায় গাড়া অবস্থায়।
এরপর থেকে কোনো গ্রামে গিয়েই আমি আর কখনো মাছ ধরি নি ।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প