শাস্তি!

(১)
ভয়ংকর একটা ভূতের গল্প লেখার উদ্দেশ্যে রাত তিনটায় ছাদে গেলেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আফজাল আহমেদ। ইচ্ছে ছিল চারিদিকে বড় বড় গাছ পরিবেষ্টিত বাড়িটির ছাদে, ভূতুড়ে পরিবেশে বসে একমনে হরর গল্প লিখবেন।
কিন্তু ছাদে গিয়ে তিনি পুরা ই হতভম্ব হয়ে গেলেন। দেখলেন, তার চিলেকোঠার নতুন ভাড়াটিয়া মজনু নামের ছেলেটি মাদুর পেতে, একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে, আসন করে বসে আছে। মেঝেতে অদ্ভুত কিছু আঁকিবুঁকি। তার চোখ দু’টো বন্ধ। একমনে বিড়বিড় করে কী যেন বলে যাচ্ছে। আফজাল আহমেদ তার একটু কাছে যেতেই চোখ খুলে তাকালো। তাকে দেখে একটু যেন ঘাবড়ে গেল মজনু। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে আফজাল আহমেদ বললেন,
—- এত রাতে ছাদে কী করো, মজনু?
মজনু ইতস্ততভাবে জবাব দিলো,
—- ইয়ে মানে, আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলাম?
আফজাল আহমেদ অবাক হয়ে বললেন,
—- মানে? তুমি না বলেছিলে তোমার স্ত্রী এক বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে?
মজনু বলল,
—- আমি আপনাকে মিথ্যে বলিনি চাচা। তবে এখন যে আমার মৃত স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলাম, সেটাও মিথ্যে না।
আফজাল আহমেদ রহস্যের গন্ধ পেলেন। ভূতের গল্প লিখতে ছাদে এসে এরকম ভূতুরে কান্ড দেখতে পাবেন, সেটা চিন্তা ই করেননি তিনি।
(২)
গত একমাস ধরে মজনু তার বাড়ির তিন তলার চিলেকোঠায় ভাড়াটিয়া হিসেবে আছে। ভবঘুরে টাইপের ছেলেটার মধ্যে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার আছে বলে আগেও মনে হয়েছিল তার। তাই বলে ছেলেটির এসব অদ্ভুত কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। তাই একটু হেসে বললেন,
— কই? দেখি! কোথায় তোমার মৃত স্ত্রী? আমাকেও একটু দেখাও। পরিচয় করিয়ে দাও আমার সাথে।
মজনু তার ডান দিকে আঙুল তুলে বলল,
—- এই তো চাচা, আমার স্ত্রী মোনা।
আফজাল সাহেব চোখের চশমাটা নেড়েচেড়ে আবার ভালো করে তাকালেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না।
এবার মজনু বলল,
—- চাচা, মোনা একটু লাজুক প্রকৃতির মেয়ে তো, তাই দেখা দিতে চাচ্ছে না। আর ও না চাইলে কারো পক্ষে ওকে দেখা সম্ভব না।
এবার আফজাল আহমেদ পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন, মজনুর এই মৃত স্ত্রীর সাথে কথা বলার ব্যাপারটা পুরাই ভাওতাবাজি। তাই তিনি হো হো করে হেসে ফেলে বললেন,
—- তুমি কি আমাকে বোকা বানাচ্ছো, মজনু? আবোল তাবোল এসব কী করছো, আর কী বলছো?
হঠাৎ মজনুর ডান পাশ থেকে শুকনো খসখসে মেয়েলি গলায় কে যেন কথা বলে উঠলো।
—- জি না চাচা, সে মিথ্যা বলছে না। এই তো আমি এখানে।
আফজাল আহমেদ লাফ দিয়ে এক পা পেছনে সরে গেলেন। তার গা শিরশির করে উঠলো। আফজাল আহমেদ ভূত-প্রেত নিয়ে প্রচুর গল্প লিখেছেন। তার লেখা বেশ কিছু ভূতের গল্প পাঠকমহলে প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার চোখের সামনে যেই ঘটনা ঘটছে, সেটা তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না।
(৩)
খসখসে কন্ঠের মেয়েটি যেন তার মনের কথাটি বুঝতে পেরেই ফিসফিস করে বলে উঠলো,
—- এখানে আমার অস্তিত্ব আপনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই তো? তাহলে একটা প্রমাণ দিয়ে দিচ্ছি আমার অস্তিত্বের। এবার আপনি মজনুর ডান দিকে তাকিয়ে দেখুন তো, চাচা।
আফজাল আহমেদ এবার মজনুর ডান দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। মোমবাতির আবছা আলোয় হঠাৎ করেই কালো রঙে ঢাকা একটা নারীর অবয়ব যেন ফুটে উঠলো সেখানে।
আবার সেই খসখসে কণ্ঠটি শোনা গেল।
—- শুনুন চাচা, আপনার প্রথম স্ত্রীর সাথেও কিন্তু আমার দেখা হয়েছিল ঘন্টা খানেক আগে। তিনি আমাকে বললেন, পাঁচ বছর আগে পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে আপনি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন গভীর খাদে। এটা করেছিলেন শুধুমাত্র আপনার প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য। অথচ আপনার সেই প্রেমিকা, অর্থাৎ আপনার বর্তমান স্ত্রী অনামিকা আহমেদ নাকি এবার আপনাকে ঠকিয়ে তার নতুন প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। সাথে করে নিয়ে গেছে আপনার টাকা-পয়সা আর গয়নাগাটি। অথচ আপনাকে বলে গেছে সে তার বাবার বাড়িতে যাচ্ছে। বিশ্বাস না হয় আপনার শ্বশুরবাড়িতে ফোন দিয়ে জেনে নিয়েন, আপনার বর্তমান স্ত্রী অনামিকা কি সত্যিই তাদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছে?
এবার বিস্ময়ের আরেকটি বিশাল ধাক্কা খেলেন আফজাল আহমেদ। তার প্রথম স্ত্রী আশা’কে তিনি নিজেই ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছেন, এই কথা তো অন্য কারো জানার কথা না।
আফজাল আহমেদ তখনই তার শ্বশুরকে ফোন দিলেন। প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেল। দ্বিতীয়বার রিং দিতেই তার শ্বশুর ফোন রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় বললেন, এতো রাতে ফোন দিলে যে! কোনো সমস্যা হয়নি তো বাবা? তুমি, অনামিকা- তোমরা ভালো আছো তো?
আফজাল আহমেদ বললেন,
— অনামিকা আপনাদের ওখানে যায়নি?
অনামিকার বাবা অবাক হয়ে বললেন,
— না তো!
তাহলে মজনু যা বলছে, তাতে মোটেই মিথ্যে নেই। এখানে নিশ্চয়ই মজনুর মৃত স্ত্রী মোনা এসেছে। আর তার সাথে আফজাল আহমেদের মৃত স্ত্রীর দেখা হয়েছিল।
তিনি আর কিছু ভাবতে পারলেন না। চোখের সামনে সব কিছু কেমন যেন দুলে উঠলো। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন তিনি।
পরিশিষ্টঃ এই ঘটনার পর থেকে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আফজাল আহমেদ নতুন কোনো গল্প কিংবা উপন্যাস কিছুই লিখতে পারেননি। কিছু লিখতে গেলেই তার মাথাটা কেমন যেন শূন্য হয়ে যেত। পরবর্তীতে আজীবন তিনি নিঃসঙ্গ থেকে গেছেন। হয়তো এটাই ছিল তার প্রথম স্ত্রী আশা’কে হত্যা করার শাস্তি!

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প