শুধু একবার সন্ধ্যায়

সন্ধ্যা নামলো। আমি আর নিতু চলে গেলাম শৈলদীঘির মাঠটার পিছে। মাঠের পাশেই জঙ্গল। সেখানে আছি আমরা দুজন। আর কেউ নেই।
আজ আমাদের এক বছরের সম্পর্ক পূর্ণতা পাবে।
আমি নিতুর কাঁধে হাত রাখি। ও হাতটা সরিয়ে দেয়। চোখ থেকে লজ্জা এখনো যায়নি ওর। ভীষণ লাজুক ও। অথবা ভীষণ সেকেলে। ওকে এই পর্যন্ত আনতে আমার সত্যিই খুব কষ্ট করতে হয়েছে।‌ আমার বন্ধুরা তাদের সম্পর্কের এই ধাপ পার করেছে অনেক আগেই। অনেকে সম্পর্কে যাবার মাত্র তিনমাসের মধ্যেই বিছানায় পেয়েছে তার বান্ধবীকে। অনেকের বান্ধবীই আবার নিজে প্রস্তাব দিয়েছে সম্পর্ক পাকা করবার। কিন্তু নিতুর ব্যাপারটা আলাদা। সে কেন যেন এসব ব্যাপারে আগ্রহী না। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, অনেক সময় প্রলুব্ধ করেছি। সে রাজি হয় না। এসবের বাইরে কি সম্পর্কের কোনো মজা আছে? ব্যাপারটা মসলা ছাড়া তরকারি খাবার মতো ব্যাপার।
তবুও আজ সে এসেছে। এসেছে আমার চাপেই‌। আমি বলেছি, এবার আমায় আমার ইচ্ছা পূরণ করতে না দিলে ওর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবো না। মেয়েটা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। প্রথমে না-ই করেছিলো সে, পরে দুসপ্তাহ কথা বলা বন্ধ করে রেখেছিলাম। শেষমেষ রাজি হয়েছে।
রাজি হবার পর আমি আরেক বিপদে পড়লাম। ওকে নিয়ে কোথায় যাবো? আমার বন্ধুরা সদরে হোটেল ভাড়া করে কাজটা করতে, আমার কাছে তো ওতো টাকা নেই। বাবা-মা খুব হিসেব করে টাকা দেন হাত খরচের জন্য। ঐ টাকায় হোটেলরুম ভাড়া করা সম্ভব না।‌ শেষে এই শৈলদীঘির মাঠটার কথা মনে পড়লো। সন্ধ্যার পর এখানে কেউ আসে না, অন্ধকার থাকে। কেউ এলেও আমাদের দেখতে পারবে না।
শীতকাল। কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে সূর্য ডুবতেই। সন্ধ্যার নীল আকাশ ছুঁয়ে অতিথি পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের বাসায়। আমি আর নিতু পাখিগুলো দেখি। নিতুর চোখে লজ্জা কাটে না।‌বাসায় বলেছে বান্ধবীর বাসায় যাবে জরুরি কাজে। তাড়াতাড়ি ওর ফিরতে হবে বাসায়।
হাতে সময় বেশি নেই। আমি আস্তে করে নিতুর দিকে আমার মুখটা বাড়িয়ে দেই।‌ও প্রথমে মুখ সরিয়ে নেয়। আমি ওর মুখটা দুহাতে ধরি। কিছুক্ষণ অপলকে দেখি দুজন দুজনকে। সন্ধ্যার ছায়া পড়ে ওর মুখটা আবছা হয়ে আসে। কিন্তু ওর চোখ দুটো চিকচিক করে জ্বলতে থাকে। ভেজা চোখ।
আমি ওর মুখে মুখ ডুবিয়ে দেই।
আমাদের প্রথম চুমু। ও আড়ষ্ট হয়ে থাকে। সাড়া দেয় না। আমি কিছুক্ষণ পর আমার মুখ সরিয়ে নেই। সে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হাতে সময় বেশি নেই।
আমি ওর সোয়েটারে হাত রাখি। উলের সোয়েটার। সামনে বোতাম। আমি এক এক করে বোতাম খুলতে থাকি। নিতু নিচে তাকিয়ে থাকে। বোতামগুলো খোলা হলে আমি সোয়েটার দুপাশে মেলে দেই। পাখির ডানার মতো। নিতু শিউরে ওঠে। হয়তো শীতে। নয়তো উত্তেজনায়।
সন্ধ্যার ছায়া ঘনীভূত হয়।
আমি নিতুর বুকে হাত রাখি। ও কেঁপে ওঠে। আমার হাত ধরে বলে, ‘না, প্লিজ না।’ আমি ওর বারণ শুনতে চাই না। শুনতে ইচ্ছে করে না। এতো অপেক্ষার পর এ সময়টা পেয়েছি। এটাকে কি হেলায় হারানো যায়?
আমি বলি, ‘নিতু শোনো।‌ তুমি আমাকে এভাবে বাধা দিচ্ছো কেন? আমরা যা করছি, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। দুটো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে পরস্পরকে ভালোবাসলে যা করে, আমরা তাই করছি। তোমার শরীর অপবিত্র হবে, এমন কোন কথা চিন্তাও করবে না। পবিত্র শরীর বলতে কিছু নাই। আমরা ক্ষুধা লাগলে খাবার খাই, খাবার খেলে শরীর অপবিত্র হয় না। তাহলে শরীরের চাহিদা মেটালে শরীর কেন অপবিত্র হবে?’
আমার কথায় নিতু চুপ করে থাকে। জানি ওর মনে একটা ঝড় চলছে।‌ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঝড়। আমার নাগরিক কথায় ওর মফস্বল মন প্রভাবিত হতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। এতোদিনের রীতিনীতি বাধা দিচ্ছে ওকে।
আমি আবার বলি, ‘এতো ভেবো না। প্রথম প্রথম একটু এমন লাগেই। প্রথম লজ্জাটুকু কেটে গেলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম লজ্জা, প্রথম ভয়ের মতো। ওটা কেটে গেলে বাঁধভাঙা জোয়ার আসবে। তখন দেখবে, নিজেকে সামলাতে পারবে না।’
নিতু আমার দিকে তাকায়। ওর মনের ঝড় বুঝি থেমেছে। আমি ওর চোখে একচিলতে আমন্ত্রণ দেখতে পাই। আমি ওর সোয়েটার সরিয়ে ফেলি। এরপর ওর কামিজে হাত দেই। নরম, মোলায়েম এমব্রয়ডারির কাজ করা সুতির কামিজ। হালকা হলুদ রঙ।
আমি কামিজটা ওর শরীর থেকে আলাদা করে ফেলি। ও কাঁপা হাতে আমায় সাহায্য করে।
দূর প্রান্তরে রাত নেমেছে। কুয়াশা ঘনিয়ে উঠেছে আরো। মাঠের ওপাশে থাকা স্কুলটা আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। বেগুনি আকাশে তারা ফুটে উঠেছে একটা দুটো।
আমি আকাশ দেখি। নিতুর দিকে আগাতে পারছি না। কি ব্যাপার? শত বছরের দ্বিধা কি আমাকেও গ্রাস করলো? আমি নিতুর দিকে তাকাই। ও দুহাতে ওর শরীর আঁকড়ে ধরে বসে আছে। ঠান্ডা লাগছে মনে হয় মেয়েটার।
আমার দিকে তাকিয়ে নিতু বলে, ‘চারিদিকটা কেমন একটু বেশি চুপচাপ না?’
চুপচাপ। হ্যাঁ, চুপচাপ। চুপচাপ বলেই তো ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। এখানে কেউ তো আসে না। সবার মনে এ জায়গাটা নিয়ে ভয়। এই মাঠের শেষপ্রান্ত থেকে পাশের সৃষ্টি, সুপারি গাছের বন, এই পুরো জায়গাটাই নাকি ভুতুড়ে। এইজন্য সবাই এ জায়গা এড়িয়ে চলে। অনেকে বলে, সন্ধ্যার পর এই জায়গাটা নাকি এই পৃথিবীর থাকে না। অন্য কোনো অজানা জগতের সাথে মিশে যায়।
আমি এসব বিশ্বাস করি না।
আমি আস্তে আস্তে নিতুর দিকে এগোই।‌ এর আগে আমার শরীরের পোষাকও সরিয়ে ফেলি। মাঠের ভেজা ঘাসে নিতুকে নিয়ে ঝুঁকে পড়ি। ওর মুখের স্পর্শ নিতে থাকি। ওর চোখের।‌ নাকের। গলার। ঘাড়ের।
সহসা নিতু বলে ওঠে , ‘এই, এই। একটা মানুষ।’
আমি চারপাশে তাকাই। কই? কেউ নেই। নিতু বলে, ‘সত্যি বলছি। মাঠের ওপাশে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম।’
আমি আবার নিতুর দিকে নজর দেই। ওর মুখে মুখ ডুবাই। মেয়েটা আমাকে আঁকড়ে ধরে কাঁপতে থাকে। এরপর, আমি আস্তে আস্তে নিচে নামি। নিতু একটু একটু কাঁপতে থাকে। হয়তো শীতে। নয়তো উত্তেজনায়।
হঠাৎ, ও কেমন কাঠ হয়ে যায়। আমি বলি, ‘কি হয়েছে?’
ও বলে, ‘ঐ গাছের উপর থেকে কে যেন আমাদের দেখছে।’
আমি বিরক্তিমুখে গাছের দিকে তাকাই। কই? এবারও কেউ নেই। আমি নিতুকে বলি, ‘তুমি এমন করছো কেন? প্লিজ, একটু স্বাভাবিক হও।’
নিতু বলে, ‘সত্যি বলছি। আমি একজনকে দেখেছি।’
আমি আমার কাজে মন দেই। অন্ধকার নেমেছে। মাঠের ওপাশের স্কুলবিল্ডিংটা এখন আর দেখাই যাচ্ছে না। আমরা মাঠের একপ্রান্তে, তার পাশেই বন।‌বনে অন্ধকার এসেছে অনেক আগেই। হাতে সময় বেশি নেই।
আমি নিতুর স্বাদ নিতে থাকি। ওর ঘ্রাণ নেই। আমার নাক, আমার মুখ ওর সারা শরীরে চষে বেড়ায়। আস্তে আস্তে নিতুর সত্তাও ডুবতে থাকে। ও সাড়া দিতে থাকে। আর আমি বুঝি, সময় চলে এসেছে। এখনই ওর মাঝে আমায় বিলীন হতে হবে…
আর তখনই নিতু চিৎকার করতে থাকে। চিৎকার করতে করতে ও বলে, ‘মানুষ, মানুষ, ওখানে অনেকগুলো মানুষ। ওই বনের গাছগুলোর আড়াল থেকে আমাদের দেখছে। অনেকে, অনেক দেখছে আমাদের।’
আমি বনের দিকে তাকাই। ওখানে কেউ নেই। আমি নিতুকে শান্ত করার চেষ্টা করি, ‘কেউ নেই, ওখানে কেউ নেই। লজ্জায় তোমার মনে এই মানুষের ছবি তৈরি করেছে। তুমি পাপ করলে মানুষ দেখবে, এই ভয়টাই তোমার মন বাস্তবের মতো করে তোমার সামনে দেখাচ্ছে। সত্যি বলছি, ওখানে কেউ নেই।’
কিন্তু নিতু থামছে না। আগের মতোই চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘মানুষ, মানুষ। আমি এখনো দেখছি। ওরা আস্তে আস্তে আগাচ্ছে আমাদের দিকে। আমরা পারবো না, ওদের থেকে বাঁচতে পারবো না। ওরা আমাদের মতো না। ওরা দেখতে একদম আমাদের মতো না।’
তারপর হঠাৎই নিতু হিস্টেরিয়া রোগিদের মতো কাঁপতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকে, ‘ওরা আসছে‌। ওরা আসছে। আমরা কেউ বাঁচবো না। কেউ না।’
নিতুর মুখটা ভয়ংকর হয়ে গেছে। ভয়ানকভাবে কাঁপছে ওর শরীর। ঝাঁকি খাচ্ছে। আর ওর চোখ! ভীষণ সুন্দর চোখদুটো আর ওরকম নেই। চোখ উল্টে গেছে। চোখে এখন কেবল রয়েছে মণি।
তারপর হঠাৎই, নিতু থেমে গেলো। এরপর হাসতে শুরু করলো। বিদঘুটে, অদ্ভুত হাসি। সে হাসিতে ওর আগের সেই কমনীয়তা নেই। কঠিন, কর্কশ সেই হাসি।‌ যেন এক পুরুষ মানুষ হাসছে।
আর তারপরই, সে অদ্ভুত, কর্কশভাবে পুরুষের গলায় বলে উঠলো, ‘ওরা আমাদের কাউকে বাঁচতে দিবে না।’
ওর চোখদুটো তখনো উল্টানো। সাদা চোখ।
আমি ওর থেকে একটু দূরে ছিলাম। ও আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। একটু আগে আমি যা করছিলাম, এখন সে আমার সাথেই তা করা শুরু করেছে। আমার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। আমি ওকে সরানোর চেষ্টা করলাম। ও সরলো না।আরো শক্ত করে চেপে ধরলো আমায়। ওর শরীরে তখন অনেক শক্তি। যেন আরো দশজন মানুষের শক্তি ভর করেছে ওর ওপর।
আমি শেষ চেষ্টা করি। ওকে শক্ত করে চেপে ধরি আমার পা দিয়ে।এরপর গড়াতে গড়াতে বনের দিকে আগাই। আমাদের সামনেই একটা গাছ। সৃষ্টি গাছ। সৃষ্টি গাছের সাথে ওর শরীরের বাড়ি খায়। আমি উঠে বসে ওর মাথা দুহাতে চেপে ধরি। এরপর সজোরে বাড়ি দিতে থাকি গাছের সাথে। ও পাগলের মতো হাসতে থাকে। হাসতে হাসতেই ওর মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। রক্ত, ঘিলু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওর শরীরটি নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ে গাছের পাশে।
আমি উঠে দৌড়াতে থাকি।
বাসায় পৌছে একদম শাওয়ারের নিচে ঢুকে যাই। নিজেকে ভেজাতে ভেজাতেই ভয়ে কাঁপতে থাকি আমি। কি হলো এটা? কি হলো? এর কি কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কখনো?
আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়ি। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বিছানার চাদরটা শরীরের ওপর টেনে দেই। ফ্যান বন্ধ করে দেই। আমার পায়ের দিকে জানালা। জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। জানালা লাগাতে হবে। নইলে ঠান্ডা লাগা কমবে না।
আর তখনই আমি দেখি, নিতু জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে। ওর মাথা ফেটে যাওয়ার আগে যেমন ছিলো, ঠিক তেমন। ভয়ংকর মুখ, মুখে অদ্ভুত হাসি। আমি বুঝতে পারি ওটা আমার স্বপ্ন না, জ্বরের ঘোরের কল্পনাও না। নিতু এসেছে, সত্যিই এসেছে। এসে দাঁড়িয়ে আছে জানালার ওপাশে, আমার বারান্দায়।
নিতু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। চোখের মণি নেই। চোখটা সাদা, ভীষণ সাদা।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প