সতিত্বের_কালো_দাগ (শেষ পর্ব)

ঘড়ির কাঁটা সকাল ৮টা ছুঁইছুঁই।আবির অফিস যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছে, আর মিথিলা এক কাপ চা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ মিথিলা বলল,
তুমি আমাকে না ভালোবাসলে কি হতো?
আবির তাকিয়ে বলল,তোমার মতো একটা মেয়ে যদি আমাকে না ভালোবাসত, তখন আমার জীবনটা আসলেই অপূর্ণ থাকত।মিথিলা মুচকি হেসে বলল—কথা দিয়ে তো আর সংসার চলে না!আবির তার কপালে চুমু দিয়ে বলল তুমি শুধু পাশে থেকো, বাকিটা আমি সামলে নেব।
আজ মিথিলার প্রথম কন্টেন্ট লেখার কাজ।জেরিনের মাধ্যমে একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে, নারী মানে কষ্ট নয়, শক্তি,নামে একটি কলাম লিখে পাঠায়।সেই কলামে মিথিলা নিজের নাম দেয়নি, কিন্তু নিজের জীবনভিত্তিক গল্পই লিখেছে—একজন মেয়ের নিঃশব্দ যুদ্ধ, পরিবারের বঞ্চনা, ধর্ষণের ঘৃণ্য ক্ষত, জোর করে বিয়ে, গর্ভপাত…তবু হেরে না গিয়ে নিজের পরিচয়ে বাঁচার শপথ।ম্যাগাজিনে প্রকাশ হতেই লেখাটি ভাইরাল হয়।
সেদিন রাতে মিথিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল।
হঠাৎ পেছনে আবির এসে দাঁড়াল, হাতে একটা ছোট্ট বাক্স।মিথিলা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল—এটা কী? খুলে দেখো।
বাক্সের ভেতরে একটা সাদা ছোট্ট পেনড্রাইভ, আর তার ভেতরে আবির তার জন্য নিজের বানানো একটা ছোট্ট ভিডিও রেখেছে।ভিডিওতে ছিল—মিথিলার হাসির ছবি, ঘর গোছানোর মুহূর্ত, রান্নার সময়, ঘুমন্ত মুখ… আর ব্যাকগ্রাউন্ডে আবিরের গলায় কণ্ঠস্বর—তুমি আমার সাহস, আমার শান্তি, আমার সমস্ত পৃথিবী। আমি তোমাকে প্রতিদিন একটু একটু করে আরও বেশি ভালোবাসি।
মিথিলার চোখে পানি চলে এলো।সে ফিসফিস করে বললো,তুমি এতটা ভালো কেন?আবির হেসে বলল—কারণ, আমার স্ত্রীটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা।
রাতে রান্নাঘরে দুইজনে একসাথে ভাত রান্না করছে।
মিথিলা পেঁয়াজ কাটছে, আবির ভাত ধুচ্ছে।হঠাৎ মিথিলা বলে উঠল,তুমি যদি আমায় না পেতে, অন্য কাউকে বিয়ে করতে, তাহলে কি করতে?আবির বলল—তখন আমি ঠিক এমন একটা মেয়েকে কল্পনা করতাম, যার চোখে যুদ্ধ থাকে, কিন্তু বুকভরা ভালোবাসা… যেমন তুমি।
মিথিলা হেসে ফেলল।সেই হাসি ছিল অভিমান ভুলে যাওয়ার, ভালোবাসার এক নতুন মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো।
রাতে মিথিলা তার ইমেইলে দেখে, তার লেখা নিয়ে ম্যাগাজিনের সম্পাদকের কাছ থেকে বার্তা এসেছে—
আপনার লেখাটি দারুণ নাড়া দিয়েছে। আমরা চাই আপনি প্রতি সপ্তাহে লিখুন। সম্মানী পাঠানো হবে নিয়মিত।
মিথিলা এবার শুধু ভালোবাসার স্ত্রী নয়—নিজের নামে দাঁড়ানো একজন লেখিকা হয়ে উঠছে।আর পাশে আছে, ঠিক ছায়ার মতো, তার জীবনের ভালোবাসা—আবির রহমান।
পাঠকপ্রিয় লেখিকা — এটা এখন মিথিলার নামের সাথে জুড়ে যাচ্ছে।নারী মানে কষ্ট নয়, শক্তি” শিরোনামে তার ধারাবাহিক লেখা প্রতি সপ্তাহেই ভাইরাল হচ্ছে।
নারী নিপীড়ন, পিতৃতন্ত্র, সমাজের চাপ—এই সব বিষয় নিয়ে তার লেখাগুলো হাজার হাজার নারীকে সাহস দিচ্ছে।
কিন্তু যেখানে আলো, সেখানে ছায়া ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
একদিন রাতে মিথিলা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে, তার লেখা পোস্টের কমেন্টে একটা পরিচিত নাম—এই মেয়েটা তো ধর্ষণের ভিকটিম! এখন নাকি শিক্ষিকা সাজছে?
সব নাটক! নিজে দোষী, আর এখন সমাজসেবিকা!
কমেন্টের নিচে একের পর এক অপমান, ট্রল, ঘৃণা ছড়ানো শুরু হয়।মিথিলা চোখ কাঁপছিল। হাত কাঁপছিল। কিন্তু সে চুপ ছিল।আবির দেখে সব।সে এসে ফোনটা তার হাত থেকে নিয়ে সাইলেন্ট করে রাখে।
মিথিলা বলল—তুমি বিশ্বাস করো তো, আমি দোষী না?
আবির তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল—তুমি আমার জীবন। তোমার গায়ে একটা আঁচড়ও যদি পড়ে, সেটা আমার শরীরেও লাগে।
পরদিন সকালে আবির নিজেই একটা স্ট্যাটাস দেয়—
আমার স্ত্রী, মিথিলা রহমান, একজন সত্যিকারের যোদ্ধা। যারা তার অতীতকে টেনে এনে অপমান করতে চায়, তারা আসলে নিজের অপূর্ণতা ঢাকতে চায়। আমি গর্বিত, কারণ আমি একজন সাহসিনীর স্বামী। আমার ভালোবাসা তার অতীতকে নয়, তার সত্যতা ও সাহসকে গ্রহণ করেছে।
এই লেখাটা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়।
অনেকেই এখন মিথিলা পাশে এসে দাঁড়ায়। অনেক মেয়েই ইনবক্সে লিখে—আপুর মতো সাহস আমাদের অনুপ্রেরণা।
সেদিন রাতে মিথিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। আবির পেছনে এসে কোমরে হাত রেখে বলল—তুমি জানো, আমি তোমাকে কবে থেকে ভালোবাসি?কবে?
যেদিন তুমি ভাঙা গলায় বলেছিলে, তোমার পাশে থাকলে আমি হয়তো আবার বিশ্বাস করতে শিখব। আমি তখনই ঠিক করেছিলাম—তোমাকে কোনোদিন আর একা হতে দেব না।
মিথিলা হেসে বলল—তুমি যদি না থাকতে, আমি হয়তো আবার হারিয়ে যেতাম।আবির তার কানে ফিসফিস করে বলল—তুমি এখন শুধু আমার স্ত্রী নও, তুমি এই সময়ের মুখ—একজন সত্যিকারের লেখিকা, সাহসিনী, আমার জীবনের গর্ব।
রাতে শোবার আগে আবির বলল—চলো, এবার আমরা একটা নতুন স্বপ্ন দেখি।কী স্বপ্ন?তুমি শুধু অনলাইন না, তুমি একদিন নিজের নামে একটা নারী সহায়তা কেন্দ্র খুলবে। যেখানে এমন মেয়েরা আসবে, যারা হার মানতে চায় না।
মিথিলা চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল—আমি পারব?
তুমি সব পারো, মিথিলা। তুমি তো যুদ্ধ করে এসেছো। এখন অন্যদের জিততে শেখাও।
মিথিলা লেখা এখন শুধু অনলাইনেই সীমাবদ্ধ না।
দু’টি পত্রিকা থেকে সে লিখতে শুরু করেছে নিয়মিত কলাম।অনেক ছোট সংস্থা তাকে স্পিকার হিসেবে ডাকে, সাহসী নারীদের প্রতীক হিসেবে।আলোর পথে — মিথিলা নিজের একটি ছোট হেল্পলাইন শুরু হয়েছে, যেখানে নির্যাতিত মেয়েরা এসে কথা বলে, সাহায্য পায়।
আবির প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে মিথিলার মুখ দেখে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে।তুমি দেখো, একদিন তুমি বই লিখবে। একটা শক্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘আমি হেরেও জিতেছি।
মিথিলা হেসে বলল—তুমি পাশে আছো বলেই পারছি।
এক সন্ধ্যায় মিথিলা একটা চায়ের দোকানে বসে ছিল জেরিন আর আরও কিছু নারীর সাথে।হঠাৎ দূর থেকে কেউ তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।মাথা নিচু করে থাকা লোকটার চোখে ছিল ভয়ানক চেনা এক দৃষ্টি।
রিয়াজ।তার প্রাক্তন স্বামী।
সে এগিয়ে এসে ধীরে বলল—বেশ চলছো তো, অভিনেত্রী সাজছো সমাজে? বাচ্চা নষ্ট করে এখন নারীর অধিকার শেখাচ্ছো?সবার সামনে শব্দগুলো ছুরি হয়ে গেঁথে গেল।
মিথিলা বলল না কিছু। ঠান্ডা গলায় শুধু বলল—তুমি এখানে কী করো?
রিয়াজ হেসে বলল—তোমার মতো মেয়েদের নিয়েই তো সমাজ ঘুরে—আগে আমার বউ ছিলে, এখন হিরোইন!
আবির জানতে পারে, কিন্তু…রাতে মিথিলা সব কিছু বলে আবিরকে।আবির প্রথমে কিছু বলল না, শুধু খুব ধীরে বলল—তুমি ঠিক আছো?হ্যাঁ। ভেঙে পড়িনি।তোমার পাশে আমি আছি, সবসময়। কিন্তু যদি কখনো চাও—আইনগত ব্যবস্থা নিতে, আমি রাজি।মিথিলা মাথা নাড়িয়ে বলল—আমি পালিয়ে আসিনি, আমি বাঁচতে শিখেছি। এবার পালিয়ে যাবো না।
রিয়াজ এবার আর থেমে থাকেনি।সে একটা লোকাল সংবাদপত্রে মিথ্যে খবর ছাপায়—স্ত্রী রেখে পালিয়ে, নিজের অতীত লুকিয়ে সমাজে নারী হিরো সাজছে এক মেয়ে!
আবির অফিসে বসে সংবাদপত্রে সেই খবর দেখে রাগে কাঁপে।সে বলল—এবার যথেষ্ট হয়েছে। তুমি চুপ থাকলে ওরা জিতে যাবে, মিথিলা।মিথিলা চুপ করে ছিল।তার চোখে তখন ভয়ের জায়গায় আগুন।আমি এবার কথা বলব, পুরো দেশের সামনে। ওর নাম নিয়েই বলব—কে সে, কী করেছে, কীভাবে আমাকে ভাঙতে চেয়েছে।
মিথিলা এবার নিজের কলামে লিখবে তার আসল কাহিনি, প্রথমবার নামসহ—প্রাক্তন স্বামীর নির্যাতনের বর্ণনা, সমাজের নীরবতা, আর তার নিজস্ব উত্তরণের গল্প।
আবির তার হাত ধরে বলল—তোমার ভয় নেই। যত বড়ই ঝড় আসুক, তুমি একা না।মিথিলা তাকিয়ে বলল—এই গল্প শুধু আমার না, এই গল্প হাজার নারীর। আমি ভাঙব, কিন্তু এবার চুপ থাকব না।
সকালের রোদটা অন্যরকম ছিল সেদিন।মিথিলা জানত—আজ সে যা লিখবে, সেটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধের অস্ত্র হবে।কেউ কেউ তাকে সাহসী বলবে, কেউ আবার নির্লজ্জ।কিন্তু সে এবার আর চুপ থাকবে না।
মিথিলা লিখল তার কলামে—আমি একজন ধর্ষণের শিকার মেয়ে ছিলাম।তারপর পরিবারের চাপে বিয়ে হয়েছিল এমন একজনের সাথে, যে আমাকে বাসর রাতেই গর্ভসহ অবস্থায় পেটে লাথি মেরে বলেছিল—তুই একটা নষ্ট মেয়ে।আমাকে গর্ভপাত করাতে বাধ্য করা হয়।দিনের পর দিন সে মদ্যপ অবস্থায় আমাকে মারধর করত, রাতের অন্ধকারে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত।আমি চেয়েছিলাম জীবন, আর সে আমাকে দিল কেবল যন্ত্রণা।আমি তার নাম বলছি আজ, কারণ আমি লজ্জা পাওয়ার কিছু করিনি—লজ্জা ওর প্রাপ্য।তার নাম রিয়াজ হোসেন।সে এখন আবার ফিরে এসেছে, আমাকে থামাতে।কিন্তু আমি থামব না।আমি চাই, যারা এই লেখাটা পড়ছে, তারা বুঝুক—ভুক্তভোগী কোনোদিন লজ্জার নয়, অপরাধী লজ্জার।
এই লেখাটি প্রকাশ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভাইরাল হয়।সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় তুমুল আলোচনা।
এক পক্ষ বলে—এমন মেয়েরা সাহসের প্রতীক।ওকে সম্মান জানানো উচিত।হাজার মিথিলার কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়িয়েছে সে।
অন্য পক্ষ বলে—এরা এখন সমাজ নষ্ট করে দিচ্ছে।
নিজের ইজ্জত নেই, এখন নাম কামাতে এসব গল্প বলছে!
রিয়াজ তেতো মুখে ফোন করে মিথিলা কে।তুই আমার নামে লিখেছিস? এখন তুই দেখবি আমি কী করতে পারি। মামলায় ফাঁসাবো তোকে। সমাজে মুখ দেখাতে দিব না।
মিথিলা শান্ত কণ্ঠে বলল—আমার মুখেই ভয় পেয়েছো? আগে আমার শরীর নষ্ট করেছিলে, এখন ভয়ে কাঁপছো আমার কলমে?চেষ্টা করো রিয়াজ, এবার আমি একা না। আমার সাথে পুরো দেশ আছে।
আবিরের বিশ্বাস, প্রেম আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়
রাতের বেলা আবির মিথিলার চোখে চোখ রেখে বলল—
তুমি জানো? আজ আমি যতটা গর্বিত, জীবনে কখনো হইনি।তুমি শুধু আমার স্ত্রী না, তুমি এই সময়ের কণ্ঠ।
আমার প্রেম তোমার সাহসে আরও গভীর হয়ে গেলো।”
মিথিলা হেসে বলল—তোমার এই ভালোবাসা না থাকলে, আমি হয়তো সত্যের মুখেই যেতে পারতাম না।
আবির তাকে জড়িয়ে ধরে বলল—তুমি শুধু লেখা না, তুমি বেঁচে থাকা—আমার সবটুকু ভালোবাসা।
কলাম প্রকাশের কয়েকদিন পর মিথিলা জানতে পারে, রিয়াজ তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিন্তু এবার মিথিলা ভয় পায় না।সে বলল—যদি দরকার পড়ে, আমি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলব সব। জিজ্ঞেস করুক সমাজ—বাসর রাতেই গর্ভবতী স্ত্রীর পেটে লাথি মারার বিচার কই?
আবির বলল—আমি তোমার পাশে আদালতের গেট পেরিয়ে যাব, আর পেছনে তাকাব না। এবার লড়াই শুধু তোমার না—আমাদের।
মিথিলার কলাম ভাইরাল হওয়ার এক সপ্তাহ পর…
সকালে দরজায় কড়া নাড়ল কোর্ট থেকে আসা একটি নোটিশ।মিথিলা চুপচাপ বসে সেটি পড়ল।আপনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করা হয়েছে। শুনানির তারিখ নির্ধারিত…আবির কাগজটা হাতে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,সে আসলেই মামলা করে ফেলেছে। অবাক হইনি। বরং আশা করেছিলাম, সে এমনটাই করবে।
মিথিলা চোখ বন্ধ করে ধীরে বলল—আমার সত্য কথা বলাটা যদি মানহানি হয়, তাহলে আমি গর্ব করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াব।
মামলার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সোশ্যাল মিডিয়া, প্রতিবেশী, অফিস কলিগদের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে—ওই মেয়েটা তো মামলায় গেছে!সব নাটক! এখন কোর্ট-ফোর্ট করছে নাম কামানোর জন্য!
মিথিলা নিজের কাজে অনড়। প্রতিদিন সে, আলোর পথে হেল্পলাইনে মেয়েদের সাহায্য করছে, কলাম লিখছে।
কিন্তু একদিন, আবির কে অফিস থেকে ডেকে পাঠায় তাদের বস।তোমার স্ত্রী নিয়ে চারদিকে খবর। এই ইমেজ কোম্পানির পক্ষে ভালো না। তুমি না বদলি হও, না চাকরি ছেড়ে দাও।
আবির বাসায় ফিরে এসে চুপচাপ ব্যাগ গোছাতে লাগল।
মিথিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—তুমি কী করছো?
চাকরি ছেড়ে দিলাম। আমি আর তাদের অফিসে যাচ্ছি না।
তুমি… আমার জন্য নিজের চাকরি হারালে?
তুমি আমার সম্মান। যদি তোমাকে নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে, আমি সেখানে কাজ করব না। আমি আবার নতুন চাকরি খুঁজে নেব, কিন্তু তোমার পাশে না থেকে এক মুহূর্তও থাকব না।মিথিলার চোখ ভিজে উঠল।সে বলল—তুমি আমার ভালোবাসা নও শুধু, তুমি আমার আত্মবিশ্বাস।
শুনানির দিন মিথিলা সাদা সালোয়ার পরে হাজির হয় কোর্টে। পাশে আবির, আর আইনজীবী।রিয়াজ তার দামী পোশাক আর উকিল নিয়ে আসে। চোখেমুখে জিদ।জজ কেস শুনে মিথিলা কে জিজ্ঞেস করেন—আপনি কি আপনার স্বামী রিয়াজের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশ করেছেন?
মিথিলা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল—আমি সত্যি লিখেছি। সে আমাকে গর্ভাবস্থায় লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল। গর্ভপাত করিয়েছিল। দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে।
আমি পালিয়ে আসিনি, লড়তে এসেছি।
আবির তখন আদালতের বেঞ্চে বসে ফিসফিস করে বললো,তুমি জিতেই গেছো, মিথিলা। সাহসিকতা কখনো হারায় না।
কেস চলতে থাকে, সাক্ষী নেওয়া হয়, প্রমাণ হাজির হয়।
রিয়াজের অতীত খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে আরও নারীর অভিযোগ, যার মধ্যে একজন পুরনো অফিস কলিগও সাহস করে মুখ খোলে।এই প্রেক্ষাপটে আদালত মিথিলার বিরুদ্ধে করা মানহানির মামলাটি প্রাথমিক পর্যায়েই খারিজ করে দেয়।
রাতের বেলা মিথিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল।চাঁদের আলোয় তার মুখে স্বস্তি, শান্তি, আর গর্ব।আবির পাশে এসে বলল—
এটা তো কেবল শুরু। এখন তুমি অনেক কিছুর মুখ হতে চলেছো। ভয় পাচ্ছো?
মিথিলা মাথা নাড়িয়ে বলল—না। কারণ, আমি জানি আমি একা না। আমি জানি, আমি ভালোবাসা পেয়েছি, আর তাতেই আমি অজেয়।
ঢাকার সবচেয়ে বড় সম্মেলন কেন্দ্র। হাজার মানুষের সমাগম। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, মিডিয়ার ভিড়, আর মঞ্চের সামনে সাজানো গৌরবের আসন।জাতীয় নারী সাহসিকতা সম্মাননা ২০২৫”এই পুরস্কারের একজন মনোনীত নারী—মিথিলা রহমান।
মিথিলা আয়নায় তাকিয়ে নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখে।
একটা সময় সে আয়নার দিকে তাকাতে ভয় পেত।
আজ সে চোখে চোখ রেখে বলে—তুই লড়েছিস। এখন মুখ তুলে দাঁড়ানোর সময়।
আবির পেছন থেকে এসে বলল—তুমি শুধু আমার স্ত্রী না, তুমি এই দেশের শক্তির নাম।মিথিলা হেসে বলল—তুমি যদি আমার পাশে না থাকতে, আমি আজ এ মঞ্চে দাঁড়াতাম না।
মঞ্চে উঠে মিথিলা মাইক ধরে ভাষণ শুরু করল—আমি কোনো লেখিকা হয়ে জন্মাইনি।আমি একটা গর্ভবতী মেয়ে ছিলাম, যাকে বাসর রাতে পেটের বাচ্চাসহ লাথি মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।আমি ছিলাম এক ধর্ষিতার ছোট বোন, এক জোর করে বিয়ে দেওয়া কন্যা, এক নির্যাতিত স্ত্রী।কিন্তু আমি আজ এখানে এসেছি—জিততে নয়, জেগে থাকতে শেখাতে।ভিকটিম বলে কিছু নেই। ভিকটিমকে সমাজ বানায়।আমি আজ কোনো পুরস্কার চাই না, আমি চাই একটা সমাজ—যেখানে কোনো মেয়ে আর আমার মতো ভাঙবে না।সবাই দাঁড়িয়ে তালি দেয়। মঞ্চ কাঁপে। চোখ ভিজে যায় শত শত নারীর।
পুরস্কার নিয়ে যখন মিথিলা বাইরে আসছে, ঠিক তখনই একজন এসে পথ আটকে দাঁড়ায়।রিয়াজ।মুখ শুকনো, চোখে আগুন। চারপাশে সাংবাদিকরা ছবি তুলছে, কিন্তু সে চিৎকার করে বলল—তুই যা হ, সব আমার কারণে। আমার নাম না থাকলে তোর গল্প হত না।
মিথিলা এবার তার দিকে সোজা তাকিয়ে দাঁড়ায়।তুই আমার গল্প না, তুই আমার কষ্টের ছায়া।আমি তোর কারণে আজ এখানে দাঁড়াইনি, আমি তোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আজ মানুষ হয়েছি।তুই আমাকে ভাঙতে চেয়েছিলি, আমি পাথর হয়েছি।আজ থেকে তুই আমার জীবনের সবচেয়ে দরকারি অনুপস্থিতি। বিদায়, রিয়াজ।
রাতে বাসায় ফিরেই আবির মিথিলার হাত ধরে বলল—তুমি আজ ইতিহাস হয়ে গেলে। এখন চল, একটা নতুন জীবন শুরু করি। যেখানে ভয় থাকবে না, শুধু আমাদের ভালোবাসা, আমাদের পথ।
মিথিলা হেসে বলল—তবে শেষ একটাই কথা—আমি আর ভাঙব না, কারণ তুমি আমার সবচেয়ে বড় জোড়া লাগানো অংশ।
বছর খানেক কেটে গেছে…আলোর পথে,এখন শুধু একটা হেল্পলাইন নয়, একটা পূর্ণাঙ্গ নারী সহায়তা কেন্দ্র।
মিথিলা আর আবির মিলে এটা চালায়।এখানে আসে নির্যাতিত নারীরা, একাকী কিশোরীরা, হতাশ মায়েরা—মিথিলা সবার গল্প শোনে, কাউন্সেলিং করে, সাহায্য দেয়।
এক সকাল।আবির ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত।মিথিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্য উঠতে দেখছে।সে পেছন থেকে ডেকে বলল—
এই দেখো, আলোটা কেমন নরম… ঠিক যেন নতুন করে শুরু করার মতো।আবির পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললতুমি নিজেই একটা সকাল, মিথিলা। আমি প্রতিদিন তোমার ভেতরেই আলো খুঁজি।
সন্ধ্যায় মিথিলা একটা চিঠি নিয়ে বসে ছিল। ডাক্তার দেখানোর রিপোর্ট।আবির এসে বলল—সব ঠিক তো?
মিথিলা একটু লাজুক হাসি দিয়ে বলল—হ্যাঁ। তুমি বাবা হতে চলেছো।আবির হতভম্ব! তারপর এক ঝটকায় মিথিলাকে জড়িয়ে ধরল।তুমি সত্যি বলছো? আমি… আমি বাবা হচ্ছি!
মিথিলার চোখে জল, গলায় কান্না আর ভালোবাসার মিশ্র স্বর—হ্যাঁ… এবার আমার গর্ভের বাচ্চাকে কেউ আর লাথি মারবে না। এবার সে জন্মাবে ভালোবাসায়।
একটা শেষ লেখা, সবার জন্য,সেই রাতে মিথিলা আবার লেখে, গল্পের শেষ কলাম:আমি একসময় ভেঙে ছিলাম।
আমার শরীর, আত্মা, বিশ্বাস—সব।কিন্তু ভাঙা মাটির ভেতর থেকেই তো গাছ জন্মায়।আমি এখন আর শুধু একটা নাম নই—আমি একটা পথ, একটা প্রতিরোধ, একটা প্রেম।আমি মিথিলা রহমান।আমি ভয় পেতাম।এখন আমি ভয় পাইয়ে দেই, অন্যায়কে।আমি হারিনি—আমি শুধু ফিরে দাঁড়িয়েছি।
নতুন একটা ছোট্ট বাড়ি।বারান্দায় আবির চেয়ার পেতে বসে আছে।মিথিলা তার পাশে এসে বসে।একটা শিশু মিথিলার পেটে লাথি দেয়।আবির হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলল—
—ওকে আমি শেখাব, কীভাবে ভালোবাসতে হয়। আর তুমি ওকে শেখাবে, কীভাবে লড়তে হয়।মিথিলা হেসে বলল—
তবে এবার লড়াই নয়… এই বাচ্চাটা শুধু আলোয় হাঁটবে।
চাঁদের আলো পড়ে তাদের মুখে।ভাঙনের গল্পটা শেষ হয় ভালোবাসার ঘ্রাণে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প