কারন আমি জানি,আমি ওখানে থাকলে সে আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে।
ঘরে এসে ব্যাগ পত্র গুচ্ছাচ্ছিলাম,বিজয় এসে আমাকে সজোরে একটা চর মারলো।
– কি নাটক শুরু করেছো তুমি?চাকরি করো বলে যা খুশি তাই করবে?তোমার দুবাই যাওয়া কেন্সেল।আমি তোমাকে যেতে দিবো না।তুমি এক পা ও বাসা থেকে বেরোতে পারবেনা।আজ থেকে তোমার চাকরি করাও বন্ধ।মনে থাকে যেনো কথাটা।ভুলে যেওনা আমি এখনও তোমার স্বামী।
– ভুলে যাইনি তুমি আমার স্বামী,খুব ভালো করেই মনে আছে।তুমিতো আমার ঐ স্বামী যে নতুন বৌ পেয়ে,বাসর রাতে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলে।তুমি তো আমার ঐ স্বামী যে আমার সতীনের দুই বাচ্চার বাবা।তুমিতো আমার ঐ স্বামী যে মায়ের কথা রাখতে গিয়ে,আমাকে ময়লার মত ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেছিলে। এতো ভালোবাসার স্বামীকে আমি কিভাবে ভুলতে পারি।
বিজয় একটু কাছে এসে বললো,
– আমি পুরোটাই বাধ্য হয়ে করেছি সুফিয়া,সেটা তুমিও জানো।আর তুমিই আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলে।
– বাধ্য হয়ে হোক আর মন থেকেই হোক করেছো তো?আমি তোমাকে বিয়ে করতে বলেছিলাম, কিন্তূ আমার থেকে দূরে যেতে তো বলিনি।কখনো কি ভেবে দেখেছো আমি এসব কিভাবে সহ্য করেছি?
কতরাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি,কতবার মৃত্যু আহ্বান করেছি।তোমাকে একটু পাশে পাবার জন্য ছট্ফট করেছি,কেদেছি,চিৎকার করেছি,মাঝে মাঝে বেহুষ ও হয়ে পড়েছিলাম,কই তুমিতো তখন আমার একবারও খোজ নাওনি।
তুমি তোমার মায়ের মন রাখতে,গিয়ে আমাকে দূরে ঠেলেছো।তুমি তোমার সন্তানের মুখ দেখবে বলে,আমাকে দূরে ঠেলে ছোটোকে আপন করে নিয়েছো।এসবের মধ্যে কি কখনো আমার কথা ভেবেছো?ভাবনি।দায়িত্ব হিসেবে বললে ভুল হবে,হয়তো গরীবের মেয়ে হিসেবে আমার জন্য কিছু টাকা আর এই বাড়িটা বরাদ্দ করেছো।আসলে তুমি আমাকে নিয়ে শুধু খেলেছো। আমি কি তোমার কাছে এসব চেয়ে ছিলাম?আমি এখন হাপিয়ে গেছি,ক্লান্ত হয়ে গেছি এমন জীবন নিয়ে।রোজ রোজ তোমার অপমান,তোমার বৌ এর অপমান আমি এসব আর মেনে নিতে পারছিনা।ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড,আমাকে যেতে দাও,না হলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।
– প্লিজ সুফিয়া তুমি এমনটা করোনা।আমি তোমাকে ছাড়া বাচতে পারবোনা।এই বলে বিজয় আমাকে জড়িয়ে ধরলো,কিন্তু আজ তার এই জড়িয়ে ধরার কোনো রিএকশন আমার মধ্যে হচ্ছেনা।আমিযে মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।আমাকে যেতেই হবে এখান থেকে দূরে,বহু দূরে।
আমি বিজয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
– তুমি যদি আমাকে যেতে না দাও তাহলে আমি তোমাকে ডিবর্স দিতে বাধ্য হবো।
– সুফিয়া তুমি এমনটা বলতে পারলে?
– তুমিই বলতে বাধ্য করলে।
আচ্ছা তোমার যা খুশী করো,আমি আর তোমাকে বাধা দিবো না।
বিজয় ঘর থেকে চলে গেলো,আমি বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম।আজ জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষটার সাথে এভাবে কথা বলেছি,হয়তোএটাই জীবনের শেষ।আর কখনো তার সাথে কথাই হবেনা।
সারারাত ঘুম হয়নি, বড্ডো খারাপ লাগছে সব কিছু ছেড়ে যেতে।কত স্বপ্ন নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিলাম আজ একবুক হতাশা নিয়ে চলে যাচ্ছি। পরী টার জন্য খুব মন খারাপ হচ্ছে,খুব মিস করবো মেয়েটাকে।মায়ের জন্যও খারাপ লাগছে, বয়স্ক মানুষ প্রায় অসুস্থ থাকে, ছোটো তো ওর বাচ্চাদের কে সামলাতেই হিমশিম খায়,উনাকে কিভাবে দেখবেন।বিজয়ের জন্যও খারাপ লাগছে,এখনও যে ভালোবাসি তাকে।সে যে আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।আশা করি ছোটোও ওর বাচ্চাদের নিয়ে ভালো থাকবে।অবশ্য আমি চলে গেলে ওরা এমনিতেই ভালো থাকবে।ওদের সংসার টা ভালোবাসায় পুর্ণ হবে।এসব ভাবছিলাম আর খুব কাদছিলাম।কেনো এতটা কষ্ট হচ্ছে আমার।ভাবতে ভাবতে কখন যেনো চোখটা লেগে গেলো।
ফজরের আযানের শব্দে ঘুম ভাঙলো।উঠে ফ্রেশ হয়ে পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলাম।তারপর ব্যাগ পত্র নিয়ে নিচে নামলাম।নাহ কাওকে আর বলার দরকার নেই।শুধু শুধু সিনক্রিয়েট করবে। কালকে তো বলেছি, এখন কাওকে না বলেই চলে যাবো। যত সকাল সকাল সম্ভব বাসা থেকে বের হতে হবে,বেলা হয়ে গেলে আবার বিজয় ঘুম থেকে উঠে পরবে,আমি চাইনা যাওয়ার সময় আর কোনো ঝামেলা হোক।দরজা খুলে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম,পেছন থেকে একজন বলে উঠলো
– পালাচ্ছো????
– আমি পেছন ফিরে দেখি, ছোটো।
– কি ভাবো তুমি নিজেকে?এসব করে কি প্রমাণ করতে চাও?
– কিছু প্রমাণ করতে চাইনা তো,শুধু চাই তোরা ভালো থাক।
– তুমি এখান থেকে চলে গেলেই কি আমরা ভালো থাকতে পারবো?
– আমিতো তাই মনে করি,আর কেও ভালো না থাকলেও তোর বর ঠিকই ভালো থাকবে কারন সে এটাই চেয়েছিলো।
– তুমি তার মুখের কথাটাই শুনলে,তার মনের ভেতরটা একবারও বুঝলেনা?
– তার মনের ভেতর তো আমি নেই,সেখানে এখন শুধু তোরই বসবাস।
– নাহ বুবু তুমি ভুল।তার ঘরে আমার বসবাস হলেও তার মনে শুধু তোমার জায়গাই আছে।আমি তার স্ত্রী হলেও তার মনের মানুষ না।
– তাতে কি আসে যায়,তুই ওর সন্তানের মা।
– সন্তানের মা হলেই কি সব হয়?হয়না বুবু, আমিতো ওর সন্তান দেওয়ার একটা মেশিন মাত্র,ওর সাথে তো আমার মনের কোনো সম্পর্ক নাই।তুমি না বলো আমি দেখতে সুন্দর আর তুমি শেমা।কিন্তু দেখো তোমার কি ভাগ্য শেমা হয়েও তুমি তোমার স্বামীর মন জুড়ে আছো আর আমি সুন্দর হয়েও তার মনে জায়গা পেলাম না।এই সুন্দর্যের কি দাম,যদি স্বামির মনে জায়গায় না পেলো।মেশিনের যেমন কোনো মন থাকেনা,তবুও কাজ করে যায় নিরলস ভাবে, আমরাও বলতে পারো একটা মেশিনের মত শুধু নিজেদের চাহিদা পূরণ করছি,আমাদের বাচ্চার দরকার এটাই বড় কথা,বাকি সব কিছুতো শুধুই …।
বুবু আমি কখনোই চাইনি তুমি এখান থেকে চলে যাও,এ বাড়িটা তো তোমার,গেলে আমি যাবো,তোমার তো যাওয়ার কথা না।এখনও বলছি থেকে যাও আমার সতীন হয়ে না,আমার পরীর মামনি হয়ে। সে যে তোমাকে ছাড়া খেতে চায়না,ঘুমাতে চায়না,তুমি না থাকলে পরী কে সামলাবে কে?
– আমিতো ওর সৎ মা কিন্তূ তুই তো ওর আসল মা, তোর কাছে পরী অনেক ভালো থাকবে।
– আর তোমার বর,তার কি হবে?
– তুইতো আছিস,দেখে রাখিস।
– বুবু,চলো একসাথেই থাকি,কথা দিলাম তোমাকে আর কষ্ট দিবো না।
– না রে ছোটো তুই আমাকে কখনোই কষ্ট দিসনি,তুই তোর জায়গা থেকে ঠিকই ছিলি।আমার তোর উপর কোনো রাগ নেই। আমিতো শুধু নিজের মতো বাঁচতে চাইছি।
বিজয় আর পরী কে নিচে নামতে দেখে,আমি তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইলাম কিন্তূ পেছন থেকে পরী এসে আমাকে মামনি বলে জড়িয়ে ধরলো।
– মামনি তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমাকে ও তোমার সাথে নিয়ে যাবে?
– না মা,তুমি চলে গেলে তোমার ভাইদের কে কে দেখবে?তোমার দাদুকেও তো তোমার দেখতে হবে তাইনা?শুনো বাবু লক্ষ্মী মেয়ের মত থাকবে,মা কে একদম জ্বালাবে না।ভাইদের দেখে রাখবে,আর বাবা কেও।
– মামনি বাবা সারারাত ঘুমায় নি,শুধু কেদেছে,আর বলেছে তুমি নাকি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো।বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসে মামনি,আমার থেকেও বেশি।
আমি পরী কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলাম।
বিজয় পাশে এসে বললো
– আমি কালকে তোমার গায়ে হাত তুলেছি,আমাকে ক্ষমা করে দিও।
– না বিজয় এভাবে বলো না।তুমিতো আমার স্বামী,আমাকে যেমন ভালোবাসার অধিকার আছে, আমাকে মারার ও অধিকার তোমার আছে।বরং আমিই কালকে তোমার সাথে খুব খারাপ ব্যাবহার করেছি,তুমিই আমাকে মাফ করে দিও।
– সুফিয়া কোনো ভাবে কি থেকে যাওয়া যায়না?
– না বিজয়,তুমিই না চেয়ে ছিলে আমি মাথা উচু করে বাচি,এখন সময় এসেছে বাচার।
– তাহলে কোনোভাবেই আর তোমাকে আটকাতে পারলাম না!
– তুমি কি আমাকে পাখির মত খাচায় আটকে রাখতে চাও?
– না,আমি চাই তুমি স্বাধীন ভাবে আকাশে ওড়ো।
– তাহলে পাগলামি করছো কেনো?
– অনেক ভালোবাসি তোমায় তাই।
– তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে না,আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি কি না,সত্যি বলবো?
– হুম।
– ভালোবাসি তোমায় অনেক ভালবাসি।ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।
– তাহলে থেকে যাওনা আমার কাছে।
– সেটা এখন আর সম্ভব না।
– চলেই যখন যাবে,কোনো ভাবেই যখন আর আটকাতে পারবোনা,তাহলে আমাকে ও তোমার সাথে নিয়ে চলো না।
– তোমার তো চলে গেলে চলবেনা।তোমার তো পরিবারের পাশে থাকতে হবে।মা, ছোটো আর বাচ্চাদের যে তোমাকে প্রয়োজন।
– আর তোমার?তোমার কি আমাকে কোনো প্রয়োজন নেই?
– আমি তো চিরো জীবনেরই একা,আমার একা থাকতে কষ্ট হবেনা।আর কে বলেছে তোমাকে আমার দরকার নেই,তুমি তো আমার স্বামী,এটাই আমার সব চেয়ে বড় পরিচয়,আমি না হয় তোমার পরিচয় টুকু নিয়েই বাঁচবো।
আমি কাদছি, পরী,মা বিজয় সবাই কাদছে।আশ্চর্যের বিষয় ছোটোর চোখেও আজ পানি।আমি বিজয় কে বললাম শেষ বারের মত একটু জড়িয়ে ধরবে আমায়?
বিজয় আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বাচ্চাদের মত কাদতে লাগলো। আমিও বিজয় কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি।আমি ওর কাছ থেকে ছুটতে চাইলাম কিন্তূ ও ছাড়ছেনা,আরো শক্ত করে ধরছে।যেনো পালাতে না পারি।আমি জোর করেই ওর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম।চোখের পানি মুছে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।
পা বাড়ালাম অজানা এক দেশের উদ্দেশ্যে।জানিনা ওই জিবনটা আমার জন্য কেমন হবে,জানিনা আগামী দিন গুলোতে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে।তবুও একবুক ভালো থাকার প্রয়াস নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।জানিনা এদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না,জানিনা মনের স্বপ্ন গুলো পূরণ হবে কিনা তবুও পা বাড়িয়েছে অনেক আশা নিয়ে,যদি এই কালো মেঘ ভেঙে কখনো নতুন সূর্যের আগমন ঘটে।
শেষ বারের মত একবার পিছু ফিরে চাইলাম, পরী আর তার বাবা এখনো কাদছে।যতক্ষণ চোখের আড়াল হইনি, ঠায় দাড়িয়েই ছিলো….
আজ অনুপম রায়ের একটা গান খুব মনে পড়ছে
আমাকে আমার মত থাকতে দাও,আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি,
যেটা ছিলোনা,ছিলোনা সেটা না পাওয়াই থাক।সব পেলে নষ্ট জীবন….